শুক্রবার, ২০ জুন, ২০১৪ ০০:০০ টা

সৃজনশীল কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই

বাংলা ভাষার অন্যতম সফল কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই। তার উপন্যাস \'সুলতান\', \'নভেরা\', \'পানেছার বানুর নকশীকাঁথা\', ভ্রমণকাহিনী \'আন্দালুসিয়া\', \'ইতালিয়া\' কিংবা গবেষণাগ্রন্থ \'সবার জন্য নন্দনতত্ত্ব\' পাঠকপ্রিয় হয়েছে। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় তিনি লেখেন। ছোটগল্পের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য একুশে পদক লাভ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-শেখ মেহেদী হাসান

সৃজনশীল কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই

শৈশবে আপনি বেশ পড়ুয়া শিক্ষার্থী ছিলেন। লেখালেখির শুরুটা কীভাবে?

আমি তখন ফরিদপুর জেলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন প্রধান শিক্ষক বললেন, আমাদের একটা বার্ষিক পত্রিকা বের করতে হবে, তুমি এর সম্পাদক হও। যেহেতু আমি ক্লাসের প্রথম ছাত্র ছিলাম সে জন্য তিনি দায়িত্বটা আমাকে দিলেন। ওই পত্রিকায় আমার লেখা একটা ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হয়। এর আগের বছর বয়েজ স্কাউট হিসেবে পুরো ভারতবর্ষ এবং পশ্চিম পাকিস্তান ঘুরে এসেছিলাম। সেই স্মৃতি মনে করে শুধু দিলি্ল শহরের বিভিন্ন স্থান, বিভিন্ন স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে লেখাটি লিখেছিলাম। সেটিই ছিল ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত আমার প্রথম সাহিত্যকর্ম। আমার সাহিত্যচর্চা শুরু ১৯৫৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে। তখন থেকে শুরু করে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বেশকিছু ছোটগল্প, দুটো উপন্যাস বেরিয়েছিল পত্রিকায়। কিন্তু কোনো বই বের হয়নি। তখন প্রকাশকরা সাহিত্যের বই বের করতেন খুব কম। মাঝখানে অবশ্য চার-পাঁচ বছর বিদেশে ছিলাম। এ সময় কিছুই লিখিনি। আবার যখন আমি সরকারি চাকরিতে ঢুকে '৬৫ থেকে '৭০ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে দায়িত্বরত ছিলাম তখনো কিছু লেখা হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর থেকে আমি নিয়মিত লিখছি। ১৯৭৮ সালে প্রথম উপন্যাস বই 'আমার আততায়ী' বের হয়। এর পরের বছর বের হয় দুটো গল্পের বই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ ২৪ বছর অপেক্ষার পর আমার প্রথম বই বের হয়, যা আজকালকার লেখকরা কল্পনাই করতে পারে না।

আপনার লেখালেখিই কি বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়?

মানসিকভাবে প্রেরণা জোগায়, আর্থিকভাবে নয়। উপন্যাস-গল্প-কবিতা লিখে আমি তেমন কোনো সম্মানী পাই না; কিন্তু লেখা মানসিকভাবে বাঁচতে সহায়তা করে। কথাশিল্পের মাধ্যমে সমাজের কাছে আমার যে দায়বদ্ধতা তা পালন করতে পারি। নিজের বিনোদনের জন্য লিখি না। ছাত্রজীবনে, তরুণ বয়সে বিনোদনের জন্য লিখেছি। স্বাধীনতার পর থেকে আমি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরার জন্য, তাদের আশা-নিরাশার কথা বলার জন্য, তাদের শোষণ-বঞ্চনা তুলে ধরার জন্য লিখেছি। যারা দেশ পরিচালনায় আছেন, দেশের শীর্ষস্থানে বিভিন্ন পেশায় আছেন তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে চেয়েছি। তারা যেন শুধু নিজের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জন্যও কিছু করতে আগ্রহী হয় সেই উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছি।

বাংলা ভাষায় জীবনীভিত্তিক উপন্যাসের সংখ্যা কম। তারপরও আপনার লেখা 'নভেরা' 'সুলতান' 'একজন আরজ আলী', 'লড়াকু পটুয়া' বাংলা সাহিত্যে যোগ করেছে নতুনমাত্রা। জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লেখার অনুপ্রেরণা পেলেন কীভাবে?

আমার প্রায় ৪০-৪৫টি উপন্যাস বই আকারে বের হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি জীবনীভিত্তিক। বাংলা ভাষায় জীবনীভিত্তিক উপন্যাস কমই লেখা হয়েছে। এ জন্য আমি জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লিখতে উৎসাহী হই। আমি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ও তার বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখতে আগ্রহী হই। এস এম সুলতান সম্পর্কে শুধু অবগত নয়, তাকে নিজের চোখে যখন দেখলাম তখন আমার কাছে খুব চমকপ্রদ মনে হলো তার জীবনযাত্রা। তার মতো অন্যদের বৈচিত্র্যময় ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে উপন্যাসের চরিত্র আঁকা হয়েছে। এদের জীবন শুধু ঘটনাবহুল আর চমকপ্রদই নয়, তারা সময়ের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। উজানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। শিল্পী নভেরাও সুলতানের মতো। দুজনই বোহেমিয়ান জীবনযাপন করেছেন। নিজের খেয়ালখুশি মোতাবেক চলেছেন, কোনো নিয়ম-কানুন মানেননি। কিন্তু তাদের যে আসল কাজ ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি করা এ থেকে কখনোই তারা দূরে থাকেননি। সুলতান হয়তো কিছুদিন ছবি আঁকেননি, তারপরও যখন ছবি আঁকতে শুরু করেছেন এক নাগাড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও শিল্প মানসম্পন্ন ছবি এঁকেছেন। এই দুজনই শিল্পী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং শক্তিসঞ্চয় করেছেন। এ জন্যই এদের নিয়ে লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। জীবনীভিত্তিক উপন্যাসে বাস্তব যে চরিত্র-তা শতকরা ৮০ ভাগ উপস্থিত থাকে। বাকি ২০ ভাগ আমার কল্পনার মিশেল। যদি পুরোপুরি বাস্তবজীবন নিয়ে লিখি তাহলে তা বায়োগ্রাফি হয়ে যাবে। আমি তো বায়োগ্রাফি লিখতে চাই না। লিখতে চাই ফিকশনালাইজড বায়োগ্রাফি। জীবনীভিত্তিক উপন্যাস অর্থাৎ তার মধ্যে বাস্তবতা থাকবে কল্পনাও থাকবে। এখানে কল্পনার অংশ বেশি করে দিলে সেটা অবাস্তব হয়ে যাবে। সুতরাং আমি যেটা কল্পনা করেছি তার সঙ্গে বাস্তব চরিত্রের একটা মিল থাকতে হবে, সামঞ্জস্য থাকতে হবে। একেবারে বিদঘুটে কিছু করলে হবে না। আরজ আলী মাতুব্বরের নির্মোহ বৌদ্ধিক জীবন আমাকে আকর্ষণ করেছিল, আর এ জন্য লিখেছিলাম 'একজন আরজ আলী'। কামরুল হাসানকে নিয়ে লেখা 'লড়াকু পটুয়া' সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়।

আপনার 'পানেছার বানুর নকশীকাঁথা' একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, এটি সম্বন্ধে কিছু বলুন।

গল্প-উপন্যাস সবই লেখকের সন্তান-সন্ততির মতো। কারও প্রতি পক্ষপাত দেখানো কঠিন, তবে আমি মনে করি 'পানেছার বানুর নকশীকাঁথা' আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। এ উপন্যাস হোমারের ওডিসি অবলম্বনে লেখা। কিন্তু এর সমাপ্তি হয়েছে আমার নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী। দ্বিতীয় কারণ পানেছার বানুর মধ্যে আমি একজন নির্ভীক স্বাধীনচেতা এবং আধুনিক মনস্কা গ্রামীণ মেয়ের চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছি বলে মনে করি।

আপনি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেন। কোন শাখায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান?

আমি গবেষণা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, সমালোচনা, কলাম লিখি। আমি কবিতা লিখি না। আমার কাছে সব শাখাই প্রিয়। মাথায় যখন একটি চিন্তা আসে তখন সে নিজেই ঠিক করে নেয় কীভাবে সে প্রকাশিত হবে, কোনটা উপন্যাস হবে, কোনটা প্রবন্ধ হবে। দুই ভাবে লেখা হয়- নিজের গরজে এবং অন্যের তাগিদ থেকে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে অনুরোধ এলে তখন তাদের চাহিদামাফিক লেখা তৈরি করে দিই। অন্য সময় নিজ থেকে বিভিন্ন লেখা লিখি। আমি মনে করি সৃজনশীল লেখার মধ্যে ছোটগল্প লেখার চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। একটা সীমিত পরিসরে একটি কাহিনী পূর্ণরূপে ফুটিয়ে তুলতে হয়। ছোটগল্প লেখার এই চ্যালেঞ্জ নিতে আনন্দ পাই।

চিত্রকলা বিষয়ে বিভিন্ন সমালোচনা আপনি লিখেছেন; এ সম্বন্ধে জানতে চাই।

আমাদের দেশের অগ্রণী শিল্পীদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক। মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর এবং পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই। তাদের যখন প্রদর্শনী হয় এবং সে উপলক্ষে যে ক্যাটালগ প্রকাশ পায় সেখানে আমি পরিচিতিমূলক নিবন্ধ লিখি। শিল্পকলা সম্পর্কে আমার আগ্রহ থেকে এসব লিখি। বিদেশি শিল্পকলা নিয়েও আমি বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছি।

আপনি লেখার উপকরণ কীভাবে পান?

আমি লেখার উপকরণ পাই বিভিন্ন সূত্র থেকে। বেশ কিছু উপকরণ পাই সংবাদপত্রের সংবাদ পড়ে। সংবাদপত্রে মফস্বল পাতায় যে সংবাদ প্রকাশ হয় সেখানে লেখার নানা উপকরণ থাকে। সেগুলো পাঠ করে আমি বেশ কিছু গল্প লিখেছি। আরেকটি সূত্র হলো আমার নিজের অভিজ্ঞতা- ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা কর্মজীবনের। আবার অন্যের জীবনের অভিজ্ঞতা যেটা আমি জানতে পেরেছি সেটাও আমার লেখায় নানাভাবে তুলে ধরেছি। সে অভিজ্ঞতাগুলো আমার গল্প উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রে স্থান পায়। লেখার তৃতীয় সূত্র আমার কল্পনা।

আপনি নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে বই লিখেছেন। এ বিষয়ে লেখার উদ্দেশ্য কী ছিল?

আমি দেখলাম নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অনেক বই বাজারে রয়েছে কিন্তু একটি বইতে সবকিছু নেই। এ জন্য আমি ভেবেছিলাম একটি বই পড়ে নন্দনতত্ত্বের ইতিহাস, দর্শন, থিওরি, তুলনামূলক আলোচনা ইত্যাদি যেন পাঠক জানতে পারে।

তাছাড়া একজন পাঠকের পক্ষে সব বই কেনাও সম্ভব হয় না। এ জন্য আমি এ বিষয়ে দেশ-বিদেশ থেকে বহু বই সংগ্রহ ও পাঠ করে টানা দুই বছর ধরে লিখলাম 'সবার জন্য নন্দনতত্ত্ব'। বইটি প্রকাশ করেছিল কাগজ প্রকাশনী। এটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে এক বছরে সব বই বিক্রি হয়ে যায়। গত বইমেলায় সন্দেশ প্রকাশনী নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে। এটি একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার হচ্ছে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা হয়েছে 'চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব'। বইটির অংশ 'শিল্প ও শিল্পী' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে।

সম্প্রতি কী লিখছেন?

এ বছর দুটি উপন্যাস লিখব ভেবেছিলাম এবং লেখাও শেষ পর্যায়ে। কিন্তু একটি পত্রিকার অনুরোধে আরও একটি উপন্যাসে হাত দিতে হবে।

অবসর সময় কীভাবে কাটে?

অবসর বলে আমার কিছু নেই। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, ইতালিয়ান, বাংলাসহ প্রচুর ডিভিডি, সিডি আমার সংগ্রহে। ইংরেজি ক্লাসিক, রবীন্দ্র, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, গজল, বাউল, ব্যান্ড সবই শুনি। পড়াশোনা করি। দোকানে কফি খেতে যাই।

জীবনের অপূর্ণতা কিছু রয়েছে কি?

আমি যা কিছু করতে চাই, তা সবটা এখনো পেরে উঠতে পারিনি। এ পর্যন্ত বাংলাতেই বেশি লিখেছি; ইংরেজিতেও কিছু লিখেছি; যেমন তিন খণ্ডে স্মৃতিকথা, একটি ভ্রমণকাহিনী, হাইকু কবিতা। আমি চাই ইংরেজিতে আরও বেশি লিখতে যেন বাংলাদেশের কথা বাইরের পৃথিবীতে জানাতে পারি। এই একটা অপূর্ণতা আমার রয়ে গেছে। যত কিছুই করি সবসময় মনে সেই প্রশ্ন জাগে, 'জীবন এত ছোট ক্যানে'।

 

 

সর্বশেষ খবর