বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

দেশ-বিদেশে প্রেমের প্রাসাদ

অনন্ত প্রেমের সাক্ষ্য বহন করে দেশ-বিদেশে গড়ে উঠেছে বহু অট্টালিকা। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে এমন কয়েকটি অট্টালিকা নিয়ে লিখেছেন- মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.), পিএইচডি

দেশ-বিদেশে প্রেমের প্রাসাদ

মিষ্টি প্রেমের অপূর্ব সৃষ্টি সুইট হার্ট অ্যাবে [স্কটল্যান্ড]

স্কটল্যান্ডে মায়াময় এক উপাসনালয়ের নাম সুইট হার্ট অ্যাবে। ১৩ শতকে ডারভোরগুইল্লা নামের এক মহান প্রেমিকা তার স্বামীর স্মরণে স্কটল্যান্ডের শান্ত-সিগ্ধ জলাশয় পাওবার্নের তীর ঘেঁষে গড়ে তোলেন সুইট হার্ট অ্যাবে। জন্মসূত্রে রাজ পরিবারের সদস্য ছিলেন ডারভোরগুইল্লা। তার সঠিক জন্মতারিখ জানা ছিল না কারও। তবে সবার ধারণা মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়, যা সে যুগেও বাল্যবিয়ে হিসেবে বিবেচিত হতো।

স্বামী স্যার জনের তুলনায় অধিক সম্পদশালী হলেও স্বামীকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতেন ডারভোরগুইল্লা। প্রকৃতির এক বিরূপ আচরণে ১২৬৯ সালে প্রিয় স্ত্রীকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ওপারে পাড়ি জমান স্যার জন। স্বামীর এই মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি ডারভোরগুইল্লা। তাই তার হৃৎপিণ্ডকে একটি মূল্যবান আইভোরি পাথরের পাত্রে প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ করেন এবং রুপা দিয়ে আবৃত করে রাখেন। ডারভোরগুইল্লা তার জীবদ্দশায় আর কখনো হাতছাড়া করেননি এই বিশেষ পাত্রটি। দেশ-বিদেশে যেখানে যেতেন, সেখানেই নিয়ে যেতে ভুলতেন না প্রিয় স্বামীর এই স্মৃতি। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বর্তমানে প্রচলিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের ১৭ দিন আগে অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি ১২৯০ সালে মৃত্যু ঘটে এই স্বামীভক্ত ডারভোরগুইল্লার। মৃত্যুর পর সুইটহার্ট অ্যাবেতে স্বামীর পাশেই সমাহিত করা হয় ডারভোরগুইল্লাকে। একই কবরে সমাহিত করা হয় তার স্বামীর সংরক্ষিত হৃৎপিণ্ড। স্থানীয় লাল রঙের বালি পাথরে নির্মিত এই উপাসনালয় কিছুটা ধ্বংস হলেও প্রেমের অমর সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এর অংশবিশেষ।

 

প্রেমের প্রলয়ে গড়া প্রবাল প্রাসাদ  [যুক্তরাষ্ট্র]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক রোমাঞ্চকর স্থান ফ্লোরিডার মায়ামি। এই মায়ামিতে আগত দর্শনার্থীদের বাড়তি আকর্ষণ অমর প্রেমের অপার নিদর্শন কোরাল ক্যাসেল। যাকে বাংলায় বলা যায় প্রবাল প্রাসাদ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অ্যাডওয়ার্ড লিড স্ক্যাল নিল নামের এক যুবকের জীবনে নেমে আসে হৃদয়ভাঙা এক করুণ অধ্যায়। ২৬ বছর বয়সী  অ্যাডওয়ার্ড ভালোবাসতেন তার শোড়ষী প্রেমিকা লাটভিয়ায় বসবাসরত অ্যাগনেস স্কাভস্টকে। প্রেমের সফল পরিণতির প্রত্যয়ে উভয়ে সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বিয়ের নির্ধারিত তারিখের এক দিন আগে শ্রেফ না বলে দেন প্রেমিকা অ্যাগনেস। মনের দুঃখে লাটভিয়া ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান অ্যাডওয়ার্ড। যুক্তরাষ্ট্রে এসেই হতভাগ্য অ্যাডওয়ার্ড যক্ষা রোগে ভুগতে থাকেন। রোগ থেকে সেরে উঠে অ্যাডওয়ার্ড তার হারানো প্রেমের স্মরণে অতি গোপনে প্রবাল পাথরের এক প্রাসাদ গড়ার শপথ নেন। ঐতিহাসিকদের মতে ১৯২১ সালে এই প্রবাল প্রাসাদ তৈরির কাজ শুরু করেন অ্যাডওয়ার্ড। এরপর প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২৮ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় নির্মিত হয় এই প্রবাল প্রাসাদ। ১০০ পাউন্ড ওজন আর ৫ ফুট উচ্চতার এই মানুষটিই প্রবাল পাথরের ব্লক কেটে কেটে গোপনে নিয়ে এসে তৈরি করেন এই প্রবাল প্রাসাদ। অপূর্ব শৈলীতে গড়া এই কোরাল ক্যাসেল পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। চলচ্চিত্র, টিভি সিরিয়ালসহ বহু নান্দনিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় এই প্রবাল প্রাসাদে। তবে উল্লেখযোগ্য হলো, অ্যাডওয়ার্ডের এই ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াসের বিষয়টি গোপনে দেখে ছিলেন ওরভাল ইরউইন। তার দেখা অ্যাডওয়ার্ডের এই প্রেমের সংগ্রামের বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছে তার একটি বইয়ে, যার নাম Mr. Can’t is Dead অর্থাৎ ‘পারিব না সাহেবের মৃত্যু ঘটেছে।’ আর প্রেমিক-প্রেমিকাদের একবার হলেও দেখা উচিত এই প্রবাল প্রাসাদ।

 

প্রেমিক-প্রেমিকা ও ভূতের পছন্দ থর্নউড ক্যাসেল  [যুক্তরাষ্ট্র]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের যান্ত্রিক জীবনে প্রেমময় শান্তির মার্কিন পরশের আশায় প্রেমিক-প্রেমিকারা এক নজর চেয়ে দেখেন থর্নউড ক্যাসেলের প্রাসাদ। অনেক মার্কিনির ধারণা আজো অসংখ্য প্রেমিক-প্রেমিকার অশরীরী আত্মা ঘুরে বেড়ায় এই প্রাসাদে। তাই কেউ কেউ বলেন ভূতের বানানো প্রাসাদ। অনেকেরই মনে হয় ভালোবাসার প্রাসাদ। এই প্রাসাদটি নির্মাণের পেছনে রয়েছে এক রোমান্টিক বাস্তবতা। ১৯ শতকের শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধনী ব্যাংকার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন চেস্টার থর্ন নামের এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ। স্ত্রী এন্নাথর্নকে অন্ধের মতো ভালোবাসতেন তিনি। এন্না এক সময় প্রাসাদপম একটি বাড়িতে বসবাসের ইচ্ছা পোষণ করেন। স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণে কোনো কার্পণ্য করেননি স্বামী চেস্টার থর্ন। ইংল্যান্ডে গিয়ে স্ত্রীর পছন্দ অনুসারে একটি পুরনো প্রাসাদ কিনে ফেলেন। তারপর তিনটি জাহাজে ভর্তিকরে পুরো প্রাসাদের প্রতিটি ইট থেকে শুরু করে সবই নিয়ে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে। এর মধ্যে ৪০০ বছরের পুরনো ইটও ছিল। এরপর শুরু হয় প্রাসাদ তৈরির মহাযজ্ঞ। স্থপতি কির্কল্যান্ড কার্টারের তত্ত্বাবধানে অতি নিখুঁতভাবে এই নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯০৮ সালে। চার বছরের মাথায় ২৮টি বেডরুমসহ মোট ৫৪টি রুম আর ২২টি বাথরুম নিয়ে গড়ে ওঠে স্ত্রী এন্নার মনের মতো এক প্রাসাদ। প্রাসাদের বাড়তি সৌন্দর্য দিতে চতুর্দিকের ৩৭ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় ব্রিটিশ ঐতিহ্যে বাাগান। এক শুভক্ষণে চেস্টার থর্ন তার প্রিয়তমা স্ত্রী এন্না এবং কন্যা অনিতাকে নিয়ে প্রাসাদে ওঠেন। প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২৮ জন মালি, ৪০ জন কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। ২০০২ এ এবিসি টেলিভিশনের জনপ্রিয় সিরিজ ‘রোজ রেড’ অভিনীত হয় এই প্রাসাদে।

 

কন্যার প্রতি বাবার ভালোবাসার প্রতীক পরী বিবির মাজার

ভালোবাসার গণ্ডি কেবল স্বামী-স্ত্রী কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে আবদ্ধ থাকার মতো নয়। দেশে দেশে ভালোবাসার ফল্গুধারা বয়ে গেছে আপন-পর-নির্বিশেষে সবার মাঝে। কন্যার প্রতি বাবার প্রচণ্ড  ভালোবাসার এক অপূর্ব নিদর্শন রয়েছে আমাদের এ দেশেই। তাও আবার খোদ ঢাকায়। সপ্তদশ শতকে মোঘল শাসনামলে বাংলার সুবেদার ছিলেন শায়েস্তা খান। সুশাসক ও প্রজাবৎসল শাসক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। প্রচলিত আছে যে, তার আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। প্রজাবৎসল এই সুবেদার ছিলেন প্রবল কন্যাবৎসল। তার আদরের কন্যা ছিলেন ইরান দুখত্ রহমত বানু ওরফে পরি বিবি। বেশ ঘটা করেই শায়েস্তা খান তার কন্যা পরি বিবির বিয়ে দেন মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সুযোগ্য পুত্র প্রিন্স মোহাম্মদ আজমের সঙ্গে। এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ১৬৬৮ সালের ৩ মে। তখন এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য করে এই বিয়ে হয়। মোঘল রাজপুত্র আজম পরি বিবিকে নিয়ে ঢাকায়ই থাকতেন। বাবার সংসার এবং সুবেদারি শাসন তথা রাজনীতিতে পরি বিবির প্রভাব ছিল লক্ষ্য করার মতো। কিন্তু মাত্র ১৬ বছরের বিবাহিত জীবনের মাথায় কন্যাবৎসল বাবা শায়েস্তা খান ও স্বামী মোহাম্মদ আজমকে রেখে অকাল মৃত্যুবরণ করেন পরি বিবি। এই মৃত্যুর আগে থেকেই ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য লালবাগের দুর্গ নির্মিত হচ্ছিল। কন্যার মৃত্যুতে দুর্গের অবশিষ্ট নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন শায়েস্তা খান। প্রিয় কন্যার অন্তিম ঠাঁই হয় লালবাগ দুর্গের মসজিদের পূর্ব পাশে। এরপর কবরের ওপর শায়েস্তা খান নির্মাণ করেন এক-গম্বুজ বিশিষ্ট সমাধি। যার নাম পরি বিবির মাজার। এর কেন্দ্রীয় কক্ষে রয়েছে পরিবিবির কবর। যার চতুর্পাশে রয়েছে আটটি পৃথক কক্ষ। এ যেন প্রিয় কন্যা পরি বিবির প্রতি পিতা শায়েস্তো খানের হৃদয় থেকে অষ্ট প্রহরব্যাপী বহমান স্নেহ আর ভালোবাসার এক জীবন্ত উপাখ্যান।

 

ভালোবাসার তীর্থভূমি তাজমহল

পৃথিবীর সেরা প্রেমের নির্দশন রূপে পরিচিত ভারতের উত্তরপ্রদেশের আগ্রায় ৪২ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা স্মৃতিসৌধ ও সমাধি তাজমহল। ইরানের স্থপতি ওস্তাদ আহমদ লাহোরির নেতৃত্বে দেশ-বিদেশের একদল স্থপতি তাজমহলের নকশা করেন। তাজমহলের প্রতিটি পাথর, ধূলি, বালি ও কণায় যেন জড়িয়ে আছে মোঘল বংশের পঞ্চম সম্রাট মির্জা সাহাব উদ্দিন, বেগ মোহাম্মদ খান খুররম ওরফে সম্রাট শাহজাহান আর তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী আরজুমান্দ বানু ওরফে মুমতাজ মহলের ঐশ্বরিক প্রেমের জীবন্ত ছবি। বর্তমানে প্রচলিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের ১৫ দিন আগে অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি ১৬০৭ সালে শাহজাহান ও মমতাজের শুভ বাগদান অনুষ্ঠিত হয়। তখন শাহজাহানের বয়স ১৫ আর মমতাজের ১৪। বাগদানের পাঁচ বছর পর তাদের বিয়ে হয়। ভালোবেসে শাহজাহান স্ত্রীর খেতাব দেন মমতাজ মহল, যার অর্থ মহলের সর্বশ্রেষ্ঠ। এ ছাড়াও শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে মালিকা-ই জাহান অর্থাৎ এই পৃথিবীর রানী নামে ডাকতেন। প্রায় ১৯ বছরের বৈবাহিক জীবনে এই সুখী দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় আটটি পুত্র ও ছয়টি কন্যাসন্তান। ১৬৩১ সালের ১৭ জুন। সম্রাট শাহজাহান তখন দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের ডিকান প্ল্যাটো  উপত্যকায় যুদ্ধে নিয়োজিত। শত্রুর শত সহস্র আঘাতকে মোকাবিলা করলেও প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর আঘাতে পরাজিত হন সম্রাট শাহজাহান। সন্তান প্রসবের পর প্রায় ৩০ ঘণ্টা রক্তক্ষরণ হয় স্ত্রী মমতাজের শরীর থেকে। ফলে বোরহানবাদের তাপতি নদীর তীরে জৈনা বাগানে প্রাণ হারান প্রেমের কিংবদন্তি মমতাজ। ওই বাগানেই প্রথমে তাকে দাফন করা হয়। সম্রাট শাহজাহান দিল্লি থেকে এত দূরে স্ত্রীর কবরও মেনে নিতে পারেননি। ফলে তাদেরই সন্তান শাহ সুজার মাধ্যমে স্বর্ণের বাক্সে মমতাজের দেহাবশেষ আবৃত করে আগ্রায় নিয়ে আসেন এবং যমুনা নদীর তীরে সমাহিত করেন। এরপর স্ত্রীর স্মৃতি রক্ষায় গড়ে তোলেন অপূর্ব স্মৃতিসৌধ  তাজমহল। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতিও পায় এই প্রেমের সমাধি। প্রচলিত আছে যে, তৎকালে প্রায় ৫০ লাখ রুপি খরচ করে দেশ-বিদেশের ২০ হাজারেরও  বেশি স্থপতি, প্রকৌশলী, নির্মাণ শ্রমিক ও শিল্পী প্রায় ২২ বছর শ্রম দিয়ে গড়ে তোলেন এই তাজমহল।

সর্বশেষ খবর