রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিষ্ঠুর এক শাসক অ্যাডলফ হিটলার

সাইফ ইমন

নিষ্ঠুর এক শাসক অ্যাডলফ হিটলার

অ্যাডলফ হিটলার এমন এক নাম যে নামের আগে-পরে কোনো বিশেষণের দরকার নেই। পুরো ইউরোপের প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করা হয় শুধু তারই নির্দেশে। তিনি পদ্ধতিগতভাবে ইহুদিদের হত্যা করতে বানিয়েছিলেন অসংখ্য ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’। এসব ক্যাম্পে গণহারে ইহুদিদের ধরে এনে নানা নির্মম পদ্ধতিতে হত্যা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। হিটলারের কারণে সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কোটি মানুষের প্রাণহানির জন্য দায়ী তিনি...

 

অ্যাডলফ হিটলার ইতিহাসের এক ঘৃণিত নাম। এই একনায়কের নিষ্ঠুর প্রতিহিংসার কারণেই এ পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে তার নির্মমতায় রক্তে ভেসে গিয়েছিল পৃথিবীর বিশাল জনপদ। চরম ইহুদি বিদ্বেষী হিটলার হত্যা করেছিলেন পৃথিবীর প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ ইহুদিকে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী দ্বারা যে ব্যাপক হারে ইহুদি হত্যা করা হয়েছিল, তা ইতিহাসে হলোকাস্ট নামে পরিচিত। এ হলোকাস্টে ৬০ লাখের ওপর ইহুদি হত্যা করা হয়েছে বর্বরোচিতভাবে, যা থেকে অবোধ শিশু ও বৃদ্ধরাও রক্ষা পায়নি। তার খুনের বর্ণনা পড়লে এখনো ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে অনেকের। হিটলারের জন্ম ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল অস্ট্রিয়ায়। পরে হিটলার হয়ে ওঠেন ইতিহাসের ঘৃণিত এক ব্যক্তি হিসেবে। অনেক মানুষ এখনো জীবিত আছেন, যারা তার নিষ্ঠুরতার সাক্ষী।

তিনি ১১ থেকে ১৪ মিলিয়ন মানুষ হত্যার জন্য দায়ী। এর মধ্যে ছয় মিলিয়নই ছিল ইহুদি। তিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর এবং ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সে দেশের ফিউরার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিনি সবচেয়ে বড় খলনায়ক ছিলেন। সেই হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণটা সব সময়ই হিটলারের ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হিটলার একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে কাজ করেন এবং যুদ্ধ শেষে জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। দলের মধ্যে তিনি নিজের আসন পাকাপোক্ত করতে থাকেন। ১৯২০ সালে এই দলের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয় নাৎসি পার্টি। সে বছরই একটি ডানপন্থি সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য বার্লিনে সামরিক ক্যু করার চেষ্টা করে নাৎসিরা। কিন্তু এই ক্যু ব্যর্থ হয়। ১৯২১ সালে তিনি নাৎসি পার্টির নেতৃত্ব লাভ করেন। তার চিন্তাধারায় ছিল একটা নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার, যার নেতৃত্ব দেবে নাৎসি জার্মানরা। ১৯২৩ সালে মিউনিখে অভ্যুত্থান করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে তাকে জেলও খাটতে হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোহনীয় বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ও সমাজতন্ত্র বিরোধিতা ছড়াতে থাকেন তিনি। এভাবেই এক সময় জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন হিটলার। জেল খাটার ঠিক ১০ বছর পর ভোটে জিতে জার্মানির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৩৩ সালে তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন। তারই নির্দেশে নাৎসিরা তাদের বিরোধী পক্ষের অনেককেই হত্যা করে। তিনি রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজান, সামরিক বাহিনীকে নতুন নতুন সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেন। সর্বোপরি একটি সমগ্রতাবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। নাৎসিবাদের প্রবক্তা ১৯৩৪ সালে নিজেকে সমগ্র জার্মানির প্রভু হিসেবে ঘোষণা করেন। জাহির করেন নিজের ক্ষমতা। নাৎসিরা তাদের বিরোধী পক্ষের অনেককেই হত্যা করেছিল। ১৯৩৯ সালে ক্ষমতাসীন নাৎসিরা পোল্যান্ড অধিকার করে এবং ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের অক্ষশক্তি তথা জার্মানির নেতৃত্বাধীন শক্তি ইউরোপ মহাদেশীয় এবং আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু অবশেষে মিত্রশক্তি বিজয় লাভ করে। ১৯৪৫ সালের মধ্যে জার্মানি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হিটলারের রাজ্য জয় ও বর্ণবাদী আগ্রাসনের কারণে লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। হারাতে হয় ঘরবাড়ি। এককথায় বলতে গেলে গোটা দেশ হয়ে ওঠে শরণার্থী শিবির। জনশ্রুতি আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর ভয়াবহতা, লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু, গুপ্তহত্যা এসব কিছুর গোড়াতেই রয়েছে ষড়যন্ত্রকারী এক টেলিফোন। এমনটাই দাবি করছেন ইতিহাসবিদদের একাংশ। এসব ঐতিহাসিকদের মতে, এই টেলিফোনের মাধ্যমেই নাকি একের পর এক নিষ্ঠুরতম সব নির্দেশ দিয়েছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। এ কারণে অনেকেই হিটলারের এই ফোনকে অভিশপ্ত বলে থাকেন। ফোনটি বানিয়েছিল সে সময়ের স্বনামধন্য সিমেন্স কোম্পানি। যতটুকু জানা যায়, জার্মানির নাৎসিদের সমন্বিত বাহিনী ওয়েহারমাচ থেকে এই টেলিফোনটি হিটলারকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। টেলিফোনটি হিটলার স্বয়ং ব্যবহার করতেন। যেখানেই যেতেন, সেখানেই তিনি এই ফোনটি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এই ফোনের মাধ্যমেই তিনি যাবতীয় নির্দেশ প্রদান করতেন।

এই টেলিফোনটিকে বলা হচ্ছে ‘ডিভাইস অব ডেসট্রাকশন’ বা ‘ধ্বংসের যন্ত্র’।

১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বাঙ্কারেই ছিলেন সস্ত্রীক হিটলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী সময়ে এই জায়গা হয়ে উঠেছিল হিটলারের প্রধান কর্মক্ষেত্র। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এখান থেকেই টেলিফোনের মাধ্যমে অসংখ্য ইহুদি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন হিটলার। যুদ্ধের নানা পরিকল্পনা সাজানো থেকে শুরু করে তিনি তার শ্যালককে হত্যা করার নির্দেশও দেন এই টেলিফোনের মাধ্যমে।

১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষ দিকে মিত্রবাহিনী যখন বার্লিন শহর দখল করে নিচ্ছিল, তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে ৩০ এপ্রিল হিটলার নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পর তার লোকেরা তারই নির্দেশ মোতাবেক লাশকে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। এভাবেই শেষ হয় বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও আগ্রাসী এক শাসকের উপাখ্যান। 

 

ছেলে সন্তান ছিল!

হিটলার নিঃসন্তান হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু হিটলারের কিছু ঘটনা, ছবি ও যাতায়াত সম্পর্কে গবেষণা করে কেউ কেউ দাবি করেছেন তার সম্ভবত এক জারজ ছেলে ছিল। যার কথা গোপন করা হয়ে থাকতে পারে। হিটলার যখন জার্মান সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তখন এক ফরাসি মেয়ের দেখা পান। মেয়েটির নাম ছিল লবোজোয়ি শার্লট। তখন শার্লটের বয়স ছিল ১৬। তার সঙ্গে কয়েক বছর সময় পার করেছিলেন হিটলার। শার্লটের একটি ছেলে সন্তান হয়, নাম জ্যা মারি লরেট। লরেট ১৯৪৮ সালে তার মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ব্যাপারে কিছু জানতে পারেননি। পরে তিনি এ ব্যাপারে তথ্য জানতে পারেন এবং জন্মের সময়টিকে মিলিয়ে দেখেন। এরপর থেকে তার মধ্যে একটা প্রবল বিশ্বাস কাজ করত যে হিটলার তার পিতা। Your Fathers Name Was Hitler  নামে একটি আত্মজীবনীমূলক বইও লিখেছিলেন তিনি। এটা নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছিল এক সময়। পরে এ বিষয়ে ফ্রান্স ও জার্মানির গবেষকরা গবেষণা করে এর সত্যতার পক্ষে প্রমাণও পেয়েছেন বলে দাবি করেন। এরপর এটা নিয়ে বেশ মাতামাতিও শুরু হয়েছিল। এদিকে যুদ্ধের পর হিটলার বংশের যারা জীবিত ছিলেন তাদের সবাই নিজেদের নাম পাল্টিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ হিটলার শব্দটির প্রতি মানুষের এত ঘৃণা ছিল যে, এই নামে পরিচয় দিতেও তাদের লজ্জা হতো। তার বোন ‘পলা হিটলার’ থেকে নাম পাল্টিয়ে হয়েছেন ‘পলা উল্ফ’। ভাইপো উইলিয়াম প্যাট্রিক হিটলার নিজের নাম পাল্টিয়ে হয়ে যান ‘উইলিয়াম স্টুয়ার্ট হিউস্টন’। তার সন্তান  সন্ততির নামও স্টুয়ার্ট হিউস্টন দিয়েই রাখেন। অ্যাডলফের বাবা-মায়ের মোট ছয়টি সন্তান ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অ্যাডলফ ও তার বোন পলাই পূর্ণ বয়স্ক হতে পেরেছেন। বাকি চারজন শিশুকালেই মারা যান। অ্যাডলফের জন্মের আগে ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গুস্তাভ এবং আইডা মৃত্যুবরণ করেন। হাইড্রোসেফালাসে আক্রান্ত হয়ে তার আরেক ভাই অট্টো মৃত্যুবরণ করেন। ৬ বছর বয়সে অ্যাডমন্ড নামে আরেক ভাই মৃত্যুবরণ করেন ১৯০০ সালে। ওই সময়ে শিশুমৃত্যুর হার বেশি ছিল।

 

যে কারণে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন হিটলার

অ্যাডলফ হিটলার। পৃথিবীর ইতিহাসে তার নামটি নাৎসিদের নেতা ও স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে উল্লেখ হলেও জামার্নিদের কাছে তিনি মহানায়ক। তার উগ্র জাতীয়তাবাদই এ জনপ্রিয়তার কারণ। কিন্তু কী কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন একজন ইতিহাসবিদ। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে তা নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়েছে। সেই গবেষণার অংশ হিসেবে এক বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন ওই ইতিহাসবিদ। তিনি জানান, নাৎসি পার্টির প্রধান হওয়ার পেছনে হিটলারের মনে ছিল অন্য এক রাজনৈতিক দল থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার যন্ত্রণা। গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একাধারে কুখ্যাত এবং বিখ্যাত এই  স্বৈরাচার প্রথমে জার্মান সোশালিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ থমাস ওয়েবার বলেন, যদি সেই সময় জার্মানির ডানপন্থি সোশালিস্টরা হিটলারকে নিতেন, তবে দলের ছোট কোনো দায়িত্বেই বসানো হতো তাকে। কিন্তু নাৎসিদের থেকেও অনেক বড় হতো সেই ভূমিকা। হিটলার তার আগে যোগ্য নেতৃত্বের কোনো গুণাবলি দেখাতে পারেননি। ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনা পালন করেই অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু হিটলারের কাছ থেকে ভালো কিছু পাওয়ার আশা বা আত্মবিশ্বাস মেলেনি সোশালিস্টদের। যদি হিটলার ওই দলে যোগ দিতেন, তবে সোশালিস্টরা হয়তো নাৎসিকে নিজের মধ্যে নিয়ে নিতেন। তখন নাৎসিদের ইতিহাস হয়তো এমন হতো না। তারা অন্য কোনো পথে চলত, বলেন ওয়েবার। যদি তাই ঘটত, হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই ঘটত না। হতো না হলোকাস্ট। ইউনিভার্সিটি অব অ্যাবারডিন ওয়েবার ইনডিপেনডেন্টকেও জানান এসব কথা। ১৯১৯ সালে মিউনিখের এক আর্কাইভে বলা হয়, জার্মান সোশালিস্টরা হিটলারকে নিজেদের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে নেয়নি। এমনকি ওই দলের কোথাও কিছু লেখারও সুযোগ মেলেনি তার। পরে হিটলার নাজিদের সঙ্গে যোগ দেন। ১৯২১ সালে তাদের নেতা হয়ে ওঠেন। পরের বছর জার্মান সোশালিস্ট পার্টিকে বিলুপ্ত করা হয়। আসন্ন বইয়ে ওয়েবার লিখেছেন, হিটলার তার শত্রুদের বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিশোধের খেলায় মেতে ওঠেন। কিন্তু কেন সোশালিস্টরা হিটলারকে নিজেদের দলে টানেনি? ওয়েবারের মতে, হিটলার মতামত প্রকাশে স্পষ্টবাদী ছিলেন। হয়তো দলটি এমন কোনো সদস্যকে চায়নি যে কিনা তাদের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেবে।

 

২৭ বার হত্যার চেষ্টা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কারণে ঘৃণিত এই ব্যক্তিকে কম করে হলেও ২৭ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে! এটাই স্বাভাবিক ছিল। যার কারণে বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় তাকে মারার চেষ্টা হবেই। এ রকমই একটি ঘটনা ২০ জুলাইয়ের বিস্ফোরণ নামে পরিচিত। হিটলারকে যতবারই হত্যার চেষ্টা করা হয়ে থাকুক না কেন প্রতিবারই তা ব্যর্থ হয়েছে। তবে ২০ জুলাইয়ের বিস্ফোরণ ছিল বেশ গুরুতর। সেদিন কাউন্ট স্টাফেনবার্গ হিটলারকে প্রায় খুনই করে ফেলেছিলেন এবং তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি হিটলারের গায়ে কিছুটা হলেও আঁচড় ফেলতে পেরেছিলেন! দিনটি ছিল ২০ জুলাই। হিটলারের টপ সিক্রেট কনফারেন্স রুম ‘ওলফ’স লেয়ার’-এ ঢোকার সুযোগ পান কাউন্ট স্টাফেনবার্গ, যেখানে ফুয়েরার তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকদের নিয়ে সামরিক কলাকৌশল পর্যালোচনা করেন। স্টাফেনবার্গ তার সঙ্গে ব্রিফকেস ভর্তি বিস্ফোরক নিয়ে আসেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ‘ওলফ’স লেয়ার’-এর এক রুমে একফাঁকে ঢুকে ব্রিফকেস থেকে বিস্ফোরকের ফিউজ জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করতেই এক কর্মচারী তাকে ডাকা শুরু করেন। স্টাফেনবার্গ তাড়াহুড়ো করে মাত্র একটা বিস্ফোরকের ফিউজই জ্বালাতে পারেন এবং তা নিয়েই কনফারেন্স রুমে ঢুকে পড়েন। তিনি টেবিলের নিচ দিয়ে যতটা সম্ভব হিটলারের দিকে ব্রিফকেসটা ঠেলে দেন। বিস্ফোরণ ঘটে ঠিকই কিন্তু একটা বিস্ফোরক হিটলারকে পরপারে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। স্টাফেনবার্গকে ধরে ফেলা হয় এবং পরে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সেই বিস্ফোরণের আঘাতে চারজন মারা গিয়েছিলেন।

 

প্রথম প্রেম

হিটলারের প্রথম প্রেম ছিল এক ইহুদি কিশোরী। যার মনে এতটা ইহুদি বিদ্বেষ তার কি না প্রথম প্রেম ছিল এক ইহুদি কিশোরী! অস্ট্রিয়ার লিনজে স্কুলে পড়ার সময় স্টেফানি রাবেচ নামের এই কিশোরীর সঙ্গে হিটলারের পরিচয়। হিটলারের বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। কৈশোরের প্রথম এ প্রেমটি ঘটে ১৯০৫ সালের বসন্তে। তবে অ্যাডলফ হিটলারের ঘনিষ্ঠ নারীদের কথা বলতে গেলে সবার আগে অবধারিতভাবে যে নামটি চলে আসবে তিনি ইভা ব্রাউন। ১৭ বছর বয়সী ইভার সঙ্গে পরিচয়ের সময় হিটলার ছিলেন ৪০ বছরের এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। তবুও হিটলারের মাঝে এমন কিছু একটা ছিল, যা ২৩ বছরের ব্যবধানকেও তুচ্ছ প্রমাণ করেছিল ইভার কাছে। হিটলার তার মায়ের প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল ছিলেন। তাই সব সময় মায়ের ছবি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। হিটলারের মা ক্লারা হিটলার নিজের সন্তানদের প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন। প্রতিদিন তিনি সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে গির্জায় যেতেন। মায়ের সঙ্গে হিটলারের সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো। ১৯০৭ সালে মায়ের মৃত্যুর পর হিটলার মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। একটি বইতে হিটলারের বন্ধু অগাস্ট ক্যবিজেক বলেন, যখন আমরা ভিয়েনাতে একসঙ্গে ছিলাম, তখন সব সময়ই সে তার মায়ের ছবি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। হিটলারের চরিত্রে আরও কিছু বিশেষ দিক ছিল। যেমন বিশ্বে প্রথম ধূমপানবিরোধী প্রচারণা করেন হিটলার। এক জার্মান ডাক্তার ধূমপান ও ফুসফুস ক্যান্সারের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক আবিষ্কারের পর ধূমপানের ঘোর বিরোধী হয়ে পড়েন হিটলার। ১৯৩০ সালে তিনিই প্রথম অ্যান্টি- স্মোকিং ক্যাম্পেইন করেন। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত নিজস্ব মিলিটারিদের মধ্যেও কঠোরভাবে ধূমপান নিষিদ্ধ করেন তিনি। নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন হিটলার। ১৯৩৯ সালে নোবেল প্রাইজের জন্য সুইডিশ পার্লামেন্টের ই.জি.সি. ব্র্যান্ড নামের এক সদস্য হিটলারকে মনোনীত করেন। কিন্তু রাজনৈতিক সংকটের কারণে এই মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

কারণ অ্যাডলফ হিটলারকে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম রাজনৈতিক নেতা ও ঘৃণ্যতম যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়। জার্মানির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে শুধু জার্মানিতেই তাকে সম্মান করা হয়।

 

হিটলার গুজব

আলোচিত বা সমালোচিত কাউকে নিয়ে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এসব গুজব একসময় মানুষ বিশ্বাস করতেও শুরু করে। যেমন অনেকে বলেন, চার্লি চ্যাপলিনকে পছন্দ করতেন বলেই হিটলার অমন গোঁফ রেখেছিলেন। বিচিত্র এ গোঁফের জন্য চার্লি যতটা বিখ্যাত, ঠিক ততটাই কুখ্যাত হয়ে আছেন হিটলার। আরও একটি গুজব হলো- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারকে ছেড়ে দিয়েছিলেন এক ব্রিটিশ সেনা। ঘটনা হলো প্রাইভেট হেনরি ট্যান্ডি নামে এক ব্রিটিশ সৈনিকের দায়িত্ব পড়েছিল মার্কোনিং নামে ফ্রান্সের এক গ্রামের কাছাকাছি এলাকায়। সেখানেই ট্যান্ডি সন্ধান পেয়ে যান আহত এক জার্মান তরুণ সেনার। আহত সৈন্যটিকে ছেড়ে দেন তিনি। ওই  সৈন্যটিই ছিলেন ‘অ্যাডলফ হিটলার’!

এমন কাহিনির সত্যতা যে কতটুকু তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহই আছে। অনেকে বলেন, চাঁদে হিটলার গোপন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন।

১৯৪২ সালের শুরুর দিকে ছড়িয়ে পড়া এ গুজবে দাবি করা হতে থাকে হিটলার ও তার গঠিত নাৎসি বাহিনী কেবল মহাকাশ জয়ের অভিযানই চালাচ্ছে না, পাশাপাশি চাঁদে তাদের গোপন এক সামরিক ঘাঁটিও আছে! হিটলার বাহিনীর চাঁদে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের কথাটি অনুর্বর মস্তিষ্কের উর্বর কল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। অনেকে আবার বলেন, হিটলারের ছিল বিশাল এক ইউএফওর বহর! এটিও গুজব বলা বাহুল্য। এসব আজগুবি কল্পনার উৎস মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়ে। সে সময় হিটলারের পরীক্ষামূলক নানা জেট এয়ারক্রাফটের সন্ধান পেয়ে যায় মিত্রবাহিনী। যেগুলো দেখেই এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। অ™ভুত শোনালেও সত্যি যে, অনেকের দাবি হিটলারের কেবলমাত্র একটি অন্ডকোষ ছিল। এ গুজব অনুযায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সমের যুদ্ধে আহত হয়েই একটি অন্ডকোষ হারান হিটলার। তবে এর পেছনে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেননি। আরও একটি অ™ভুত গুজব হচ্ছে- হিটলারের জননাঙ্গ ছোট ছিল। তবে এমন দাবির স্বপক্ষেও কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। এদিকে এক গবেষণার ফলাফলে বলা হয় যে, সম্ভবত হিটলারের পূর্বপুরুষ ইহুদি ছিলেন। এখানেও বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর