রবিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

যেভাবে বিশ্বজয় করেছিলেন আলেকজান্ডার

রণক ইকরাম

যেভাবে বিশ্বজয় করেছিলেন আলেকজান্ডার

প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনের রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। তিনি অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। বলিষ্ঠ চেহারায় রূপ আর শক্তির মিশেলে তিনি অন্য সব রাজার থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র। সিংহের মতোই বিক্রম ছিল তাঁর। মাথায় সব সময় সিংহের চামড়া জড়িয়ে রাখতেন। মাত্র ৩০ বছরের মধ্যেই অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। তাঁকে নিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরি হতে থাকে নানা রোমাঞ্চকর গল্প...

 

অর্ধেক পৃথিবীর রাজা

যিশুখ্রিস্ট জন্মের ৩০০ বছরেরও বেশি সময় আগের ঘটনা। পৃথিবী দেখেছিল এক বিশাল মাপের রাজাকে। তিনি প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনের রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ সালে তাঁর জš§। মাত্র ২০ বছর বয়সে পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের স্থলাভিষিক্ত হন তৃতীয় আলেকজান্ডার। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডারকে বলা হতো ‘অর্ধেক পৃথিবীর রাজা’। কারণ গ্রিসের ছোট্ট রাজ্য ম্যাসিডন ছাপিয়ে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী জয় করেছিলেন তিনি। অল্প বয়স হলেও সিংহাসন সামলানো তাঁর পক্ষে কঠিন হয়নি। কারণ, লিওনিদাসের মতো একজন যোগ্য প্রশিক্ষকের কাছ থেকে তিনি শরীর বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। আর মাত্র ১৩ বছর বয়সে শিক্ষা পেয়েছিলেন মহান গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে। মূলত এই সুশিক্ষার কারণেই আলেকজান্ডার প্রচণ্ড শারীরিক দৃঢ়তা ও মেধার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ছেলেবেলায় আলেকজান্ডারের বাবা ফিলিপ বলেছিলেন, ‘ম্যাসিডন বড়ই ছোট তোমার পক্ষে। একদিন সারা পৃথিবী জয় করবে তুমি।’ বাবার সেই কথাটা সত্যি প্রমাণ করেছিলেন আলেকজান্ডার। তাঁর শাসনামলের বেশির ভাগ সময় তিনি উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়াজুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি মিসর থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই আমলের মানচিত্রে চোখ বুলালেই অনুমান করা যাবে কত বড় বীর ছিলেন আলেকজান্ডার। সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালে বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলই জয় করেন তিনি। কয়েক হাজার বছর আগে মৃত্যু হলেও এই বীরের সমাধি আজও রহস্য আর নতুন নতুন প্রশ্নের জš§ দিয়ে চলেছে মানুষের মনে। অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন আলেকজান্ডার। বলিষ্ঠ চেহারায় রূপ আর শক্তির মিশেলে তিনি অন্য সব রাজার থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র। সিংহের মতোই বিক্রম ছিল তাঁর। মাথায় সব সময় সিংহের চামড়া জড়িয়ে রাখতেন। মাত্র ৩০ বছরের মধ্যেই অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। তাঁকে নিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরি হতে থাকে নানা রোমাঞ্চকর গল্প। তিনি নাকি সাক্ষাৎ দেবতা জিউসের বংশধর। আলেকজান্ডার নিজেও ভাবতে শুরু করেন তাই। সেই আমলে গ্রিসের দেবী আর্টেমিসের মন্দির ছিল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। আলেকজান্ডারের জন্মের দিন সেটি পুড়ে যায়। কথিত হয়ে যায়, স্বয়ং আর্টেমিস নাকি এসেছিলেন আলেকজান্ডারের জন্মের সাক্ষী থাকতে। এ রকম নানা কিংবদন্তিতে ভরপুর সম্রাট আলেকজান্ডারের জীবন। আলেকজান্ডারের বিশ্ব অভিযান তখন চলতেই থাকল। এর মধ্যেই তিনি পারস্য সাম্রাজ্য জয়ের আশায় দারদানেলিস প্রণালি অতিক্রম করেন। এ প্রণালিটি মরমরা সাগর ও এয়িজিন সাগর (অর্থাৎ গ্রিসের পূর্বাংশে ভূমধ্যসাগরের একটি বর্ধিতাংশকে) যুক্ত করেছে। আলেকজান্ডার তিনটি বড় ধরনের যুদ্ধ করে ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বে পারস্য-নেতা তৃতীয় ডরিয়াসকে হত্যা করেন। আলেকজান্ডার পারস্যবাসীর পরাজয় ঘটান ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বে। এরপর তিনি অগ্রসর হন আরও পূর্বদিকে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিকে। যে বা যারাই আলেকজান্ডারের কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, আলেকজান্ডার তাঁকেই পরাভূত করেন। অভিযান চালিয়ে যেতে মুখিয়ে ছিলেন আলেকজান্ডার। কিন্তু সেনাবাহিনী বাদ সাধল। বিশাল সেনাবাহিনীর বাধার মুখে পূর্বমুখী অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য হলেন আলেকজান্ডার।

 

ভারতবর্ষে এসে জানলেন ব্যাবিলনই তাঁর শেষ গন্তব্য

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দের মে মাস। সারা বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া এই বীরের বয়স তখন ৩৩। সিংহাসনে আরোহণের পর এক যুগেরও বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন চেনা পৃথিবীর অনেকটা জয় করতে। আলেকজান্ডারের স্বপ্ন ছিল, তাঁর বিশাল এ সাম্রাজ্যের আরও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটাবেন। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন কখনই বাস্তবে রূপ নেয়নি। সেনাবাহিনীর বাধার মুখে কয়েক বছরের সামরিক অভিযান শেষ করে আলেকজান্ডার ফিরে এলেন বাগদাদে। এই সুযোগে তিনি বিশ্রামে গেলেন। সেই সঙ্গে তাঁর পরবর্তী অভিযানের ছকও আঁকতে লাগলেন। ২৯ জুন তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর আমন্ত্রণে এক ভোজসভায় যোগ দেন। দিনব্যাপী এ আয়োজনে আলেকজান্ডার প্রচুর মদপান করেন। এক সময় অস্বস্তি বোধ করেন। ‘তাঁর ভালো লাগছে না’, এ কথা বলে ঘুমাতে চলে যান আলেকজান্ডার। কাঁপুনি দিয়ে প্রচণ্ড জ্বর ওঠে তাঁর। দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। তিনি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েন যে, বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। বিশ্বজয়ী এই বীর এর ১০ দিন পর মারা যান। তবে আলেকজান্ডারের মৃত্যু নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। ভারতবর্ষ জয় করতে এলে সেখানকারই এক জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ব্যাবিলনই আলেকজান্ডারের শেষ গন্তব্য। ভারতবর্ষ থেকে ব্যাবিলনে যাওয়ার কোনো পূর্বপরিকল্পনা না থাকলেও নিয়তিই যেন তাঁকে সেখানে নিয়ে যায়। সাধারণভাবে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ঘটনা এভাবে বলা হলেও তাঁর মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো অজানা।

 

সাম্রাজ্য ভাগবাটোয়ারা করে নেন তাঁরই জেনারেলরা

ইতিহাসবিদরা বছরের পর বছর ধরে এ নিয়ে নানা বিতর্ক করে চলেছেন। কারও কারও মতে, মদ কিংবা জ্বর নয়, বিষ প্রয়োগে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। আবার কেউ বলছেন, ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন আলেকজান্ডার। এক দলের দাবি টাইফয়েডে। আবার অনেকেই অন্যান্য রোগের নাম বলেছেন। তবে সবাই এ ব্যাপারে একমত, আলেকজান্ডার মারা যান খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে। আবার অধিকাংশ সূত্র এটাও নিশ্চিত করেছে যে, মৃত্যুর আগে তিনি প্রচণ্ড জ্বরে ভুগেছিলেন। টানা ১০ দিন চলে এ জ্বর। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য খণ্ড খণ্ড করে ভাগবাটোয়ারা করে নেন তাঁর জেনারেলরা। মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তাঁর গড়া বিশাল সাম্রাজ্য। গ্রিক ইতিহাসবিদ অ্যারিয়ান আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ৩৫০ বছর পর মহাবীরের মৃত্যুর একটা বর্ণনা দিয়ে গেছেন। অ্যারিয়ান যদিও আলেকজান্ডারের সমসাময়িক ছিলেন না, তবু তাঁর এই বর্ণনার আলাদা একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কারণ তিনি নাকি আলেকজান্ডারের রয়্যাল ডায়েরি অনুসরণ করে লিখেছিলেন। এই রয়্যাল ডায়েরিতে আলেকজান্ডারের সব অভিযানের সমকালীন কালপঞ্জির পুঙ্খানুপুঙ্খ উল্লেখ রয়েছে। অ্যারিয়ানের সেই লেখা অনুসারে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ঘটনাপঞ্জি এ রকম।

 

কেমন ছিল মৃত্যুর আগের দিনগুলো

বিশ্রামে আসার পর আলেকজান্ডার ডিভাইন সেক্রিফাইস বা ঐশ্বরিক উৎসর্গগুলো শেষ করেন। মূলত সৌভাগ্য অর্জনের লক্ষ্যে যাজকদের পরামর্শে এসব করেন তিনি। রাতে তিনি তাঁর কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে প্রচুর মদপান করেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি চেয়েছিলেন মদের আসর ছেড়ে বিছানায় যেতে। কিন্তু তখন মেডিয়াসের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। মেডিয়াস ছিলেন আলেকজান্ডারের সঙ্গীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত। মেডিয়াস তাঁকে আসর ছেড়ে না যাওয়ার অনুরোধ করেন। কারণ আলেকজান্ডারকে ছাড়া আসর জমবে না।

প্রথম দিন : ‘রয়্যাল ডায়েরিজ’ থেকে জানা যায়, তিনি প্রচুর মদপান করেন। এ সময় মেডিয়াসের সঙ্গে হৈহুল্লোড় করে মদোৎসব পালন করেন। এক সময় আসর ভাঙে। উঠে গিয়ে গোসল করে শুতে যান ও ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর আবার ফিরে আসেন মেডিয়াসের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে। গভীর রাত পর্যন্ত প্রচুর মদপান করেন। পান শেষে আবার গোসল করে সামান্য খাবার খেয়ে শুতে যান। এরই মধ্যে তার শরীরে জ্বর উঠে গেছে।

দ্বিতীয় দিন : কাস্টমারি সেক্রিফাইসের জন্য আলেকজান্ডারকে প্রতিদিনই কোচে করে বহন করে নেওয়া হতো। এটি সম্পাদনের পর তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত শুয়ে থাকতেন মেনস অ্যাপার্টমেন্টে। এ সময় তিনি তাঁর অফিসারদের আগামী অভিযান ও সমুদ্রযাত্রা সম্পর্কে নির্দেশনা দেন। নির্দেশনার মধ্যে ছিল স্থলবাহিনী প্রস্তুত করা, পরদিন তাঁর সঙ্গে নৌযাত্রা শুরু ইত্যাদি। এরপর আলেকজান্ডারকে কোচে করে নদীতীরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি একটি নৌকায় ওঠেন। এ নৌকা করে চলে যান বাগানে। সেখানে গোসল করে আবার বিশ্রামে যান।

তৃতীয় দিন : পরদিন আবার গোসল করে নির্দেশিত সেক্রিফাইস বা উৎসর্গ সম্পন্ন করেন। এরপর নিজের কক্ষে ঢোকেন। শুয়ে শুয়ে কথা বলেন মেডিয়াসের সঙ্গে। অফিসারদের পরদিন সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দিয়ে সামান্য খাবার খান। তাঁকে বহন করে নেওয়া হয় তাঁর কক্ষে। সারা রাত শুয়ে থাকেন জ্বর নিয়ে।

চতুর্থ দিন : সকালে গোসল করেন এবং সেক্রিফাইস বা বলিদান সম্পাদন করেন। নিয়ারকাস ও অন্যান্য অফিসারকে নির্দেশ দেন দুই দিন পর সমুদ্র অভিযানের জন্য তৈরি হতে।

পঞ্চম দিন : পরদিন তিনি আবার গোসল সেরে সেক্রিফাইস সম্পন্ন করেন। এর পরও তাঁর দেহে জ্বর অব্যাহত থাকে। তার পরও তিনি অফিসারদের ডেকে আনেন এবং অভিযানে যাওয়ার জন্য সবকিছু তৈরি করতে বলেন। বিকালে গোসলের পর তিনি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

ষষ্ঠ দিন : পরদিন তাঁকে ড্রাইভিং প্লেসের হাউসে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি সেক্রিফাইস সম্পন্ন করেন। শরীর খারাপ সত্ত্বেও ঊর্ধ্বতন অফিসারদের ডেকে আনেন এবং অভিযানের ব্যাপারে নতুন করে নির্দেশনা দেন।

সপ্তম দিন : পরদিন দুর্বল থাকা সত্ত্বেও কোনোমতে সেক্রিফাইস সম্পন্ন করেন। তিনি জেনারেলদের হলে থাকতে বলেন। ব্রিগেডিয়ার ও কর্নেলরা থাকবেন সামনের দরজার কাছে। এবার তিনি খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে বাগান থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় রয়্যাল অ্যাপার্টমেন্টে। অফিসাররা যখন প্রবেশ করেন, তখন তিনি তাদের চিনতে পারলেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে একটি কথাও বলেননি।

অষ্টম নবম দিন : রাতে তাঁর শরীরে খুব বেশি জ্বর ওঠে। আরেকটা দিন কাটল এভাবেই। পরের দিন, এর পরের দিনও জ্বর থামেনি।

 

মহাবীরের শেষ যাত্রা

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্লুটার্কের বর্ণনায় পাওয়া যায়, মৃত্যুর পর ছয় দিন ধরে আলেকজান্ডারের দেহটি একটি সাধারণ কফিনে ফেলে রাখা হয়েছিল। কেননা, রাজার মৃত্যুর পর সবাই ব্যস্ত ছিল শোকে আর পরবর্তী সরকার গঠনের রাজনীতি নিয়ে। হঠাৎ সবার খেয়াল হলো যে, আসল কাজটিই তারা করেননি। যে তাঁবুর ভিতরে সাধারণ কফিনটি রাখা হয়েছিল সবাই ছুটে গেলেন সেখানে। সাধারণত এত দিনে মৃতদেহ পচে যাওয়ারই কথা। তবে সেখানে গিয়ে সবাই নাকি হতবাক হয়ে যান। কফিন খুলে দেখা গেল, মৃতদেহটির কোনো ক্ষতি তো হয়ইনি বরং সেটি বেশ অক্ষতই রয়েছে। আলেকজান্ডারের অনুসারীরা শেষ বিদায়ের কাজে লেগে পড়লেন। মহাবীরের মৃতদেহের জন্য অতি যত্নে প্রায় দুই বছর ধরে তৈরি করা হলো সুদৃশ্য মানবাকৃতির শবাধার। এই দুই বছর নাকি তাঁর মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হয়। তৈরি করা হয় এক বিশাল সোনার শববাহী গাড়ি। সোনার কফিনের মধ্যে তাঁর মৃতদেহ রেখে দ্বিতীয় একটি সোনার কাসকেটে ভরা হয়। তারপর সব অস্ত্রশস্ত্রসুদ্ধ কফিনটি তোলা হয় গাড়িতে। সে এই জমকালো ব্যাপার। ডিওডোরাস নামে এক প্রাচীন ঐতিহাসিকের লেখায় রয়েছে এই মহাযজ্ঞের বিশদ বিবরণ। সেনাপতি পারডিকাসের নেতৃত্বে শববাহী গাড়ি চলতে লাগল মেসিডোনিয়ার উদ্দেশে। কিন্তু গ্রিসে যাওয়ার আগেই চুরি হয়ে যায় আলেকজান্ডারের মৃতদেহ বহনকারী কফিনটি। ধারণা করা হয়, শবযাত্রাটি সিরিয়া পৌঁছলে টলেমি লগোস, যিনি কি না আলেকজান্ডারেরই বাহিনীর সাবেক এক সেনাধ্যক্ষ ছিলেন, সিরিয়ান বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন এবং লাশবাহী কফিনটিকে মেসিডোনিয়ার দিকে নিয়ে যান। সেখানে যে ছোটখাটো একটি যুদ্ধ হয়েছিল, এর প্রমাণও পাওয়া যায়।

সমাধিবাহী গাড়িটি বেমালুম ছিনতাই করে প্রথমে সিরিয়া, তারপর মিসরের মেমফিসে চলে গেলেন। আসলে এই অভিনব চুরির পেছনে রয়েছে এক ভবিষ্যদ্বাণী। আলেকজান্ডারের রাজজ্যোতিষী অ্যারিস্টান্ডার বলেছিলেন, ‘যেখানে তাঁর সমাধি হবে, সেই দেশ হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী।’ আর এ ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মাথায় রেখেই চুরির কাণ্ড ঘটান টলেমি। ভেবেছিলেন, মিসরে সম্রাটের দেহ সমাধিস্থ করলে এর উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। তারপর তিনি এখানকার রাজা হয়ে বসবেন। টলেমির ইচ্ছা অবশ্য ফলেছিল। টলেমির বংশ অনেক দিন রাজত্ব চালায় মিসরে। বহুদিন পরে যে বংশের বিখ্যাত রানি হন ক্লিওপেট্রা। যাই হোক, এসব ভেবেই আলেকজান্ডারের শেষ যাত্রা বাধাপ্রাপ্ত হলো। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো- মিসরীয় প্রথায় সমাধিস্থ করা হলো গ্রিক সম্রাটকে। এটুকু পর্যন্ত হলে না হয় কথা ছিল না। কিন্তু এর পরও আলেকজান্ডারের শবদেহ নিয়ে চলে টানাহেঁচড়া। খ্রিস্টপূর্ব চারের শেষ বা তিন শতকের প্রথম দিক। তখন প্রথম টলেমির ছেলে দ্বিতীয় টলেমি মিসরের ফারাও হলেন। তাঁর নির্দেশে আলেকজান্ডারকে মেমিফস থেকে আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে আসা হলো। এবার আলেকজান্ডারকে সমাধিস্থ করা হলো তাঁরই নামে রাখা শহরে। তারও কিছুদিন পর বর্তমানে রাজার মনে হলো প্রয়াত রাজার প্রতি আর একটু বেশি সম্মান দেখানো উচিত। তখন শহরের মাঝখানে ‘সোমা বা সেমা’ (গ্রিক ভাষায় দেহ) নামে একটি মসোরিয়াম (সৌধ) করে তাঁকে চিরকালের মতো বিশ্রাম দেওয়া হয়।

স্ট্রাবো, প্লুটার্ক এবং আরও অনেক পৌরাণিক যুগের লেখকের লেখায় প্রমাণ পাওয়া যায়, আলেকজান্ডারকে আলেকজেন্দ্রিয়ায়ই সমাহিত করা হয়। আলেকজান্ডারের সমাধিকে ঘিরে বানানো হয় এক সমাধিমন্দির, যেটিকে ডাকা হতো সোমা বা সেমা নামে। গ্রিক ভাষায় যার অর্থ সমাধি। কিন্তু পরে কোনো এক কারণে সমাধিমন্দিরটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। গবেষকদের ধারণা, এর বাইরেও ঘটেছে নানা ঘটনা। এবারের ঘটনার পেছনে মূল রহস্য আলেকজান্ডারের দেহাবশেষ নয়, বরং সেটি রাখার জন্য তৈরি সোনার কফিন। সমাধিসৌধের বড় বড় পাঁচিলের আড়ালে আলেকজান্ডারের সোনার কফিন কোথায় হারিয়ে গেল? শোনা যায় টলেমিদেরই এক উত্তরাধিকারী, নবম টলেমি নাকি আলেকজান্ডারের সোনার কফিন পাল্টে দেন ক্রিস্টালে। এরপর পুরনো সোনার কফিনটি গলিয়ে মুদ্রা করে নেন লোভী রাজা। আলেকজান্ডারের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। আর তাই যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৪৫ বছর আগে তাঁর সমাধি দেখতে অগাস্টাস, ক্যালিগুলা, জুলিয়াস সিজারের মতো ডাকসাইটে রোমান সম্রাটরা আলেকজান্দ্রিয়ায় এসেছিলেন বলে জানা যায়। সম্রাট ক্যালিগুলা নাকি তাঁর সারকোফেগাসের (মানুষের মতো দেখতে শবাধার) বুক থেমে বর্ম ছিঁড়ে স্মারক হিসেবে রেখেও দেন। আর রাজা অগাস্টাস সমাধির ওপরে ফুল ছড়িয়ে দেন, মমির মাথায় পরিয়ে দেন মুকুট।

তবে তিনি নাকি সারকোফেগাসের ওপর ঝুঁকে রাজাকে চুমু খেতে গিয়ে তাঁর নাকও ভেঙে দিয়েছিলেন! যদিও এ ধরনের সম্মান জানানো অনেকেরই পছন্দ হয়নি।

তখনো আলেকজান্ডারের সমাধি নিয়ে খুব একটা গণ্ডগোলের কথা শোনা যায়নি। তৃতীয় শতক পর্যন্ত এ সৌধ সাধারণ জনগণকে দেখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এ মহান বীরের মৃতদেহ যদি সেখানেই চিরকালের জন্য থাকত, তাহলে তো আর কথা ছিল না। কিন্তু আবারও ঘটল এক দুর্ঘটনা।

 

গ্রিসে আলেকজান্ডারের সমাধি খুঁজে পাওয়ার দাবি করা হলেও নিশ্চিত নন গবেষকরা

কোথায় আলেকজান্ডারের সমাধি

(৩৭৯-৩৯৫) সময়কালে আলেকজান্দ্রিয়ায় ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। পঞ্চদশ শতকে এ শহরের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এর পাঁচ দশক পরই হঠাৎ আলেকজান্ডারের সমাধি অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু বিখ্যাত এ গ্রিক সম্রাটের দেহাবশেষ কোথায় রাখা আছে- তার উত্তর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অনেকের দাবি, গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের দেহাবশেষ চলে যায় বহুদূরে বেনিসের সেন্টমার্ক গোরস্থানে। কিন্তু কেন? ইতিহাস তার উত্তর পায়নি। অসংখ্য অনুসন্ধান চালিয়েও মিসরের পুরাতত্ত্ববিদরা বলতে পারেননি, কোথায় রয়েছে রাজার শেষ স্মৃতি। তবে মাঝে-মধ্যে হঠাৎই এক-আধটা আবিষ্কারে চমকে ওঠেন সবাই। সম্প্রতি যেমন হলো এক সময় যেখানে ম্যাসিডন ছিল, সেখানে প্রাচীন শহর অ্যামপিফোলিসের কাস্তা সমাধিক্ষেত্রে পাওয়া গেল মার্বেলে মোড়া এক রাজকীয় সমাধির খোঁজ। সবাই বলাবলি করতে লাগল- পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে! এটির সঙ্গে আলেকজান্ডারের সম্পর্ক আছে কি না তা খতিয়ে দেখছেন এখন তাঁরা। ধারণা করা হচ্ছে, এই সমাধিমন্দিরটি নির্মাণ করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫ থেকে ৩০০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। তবে অনেকেই এখন মনে করছেন, সমাধিমন্দিরটি আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াসের। সমাধিমন্দিরের ভিতর পাওয়া মার্বেল পাথর দিয়ে বানানো স্ত্রী-মূর্তিটি সে কথাই বলে। তখনকার অভিজাত নারীদের কবরে পাওয়া যেত এই মূর্তি। একই সমাধি নিয়ে রয়েছে আরও মত। বলা হয়, রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা ছিলেন আলেকজান্ডারের শৌর্যবীর্যের খুব ভক্ত। তিনি মিসরে রাজার সমাধির গল্পে দুঃখ পান। তাই দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সসম্মানে তাঁকে স্বদেশ গ্রিসে এনে সমাধিস্থ করেন। এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। অনেকেই বলেন, সমাধিটি আলেকজান্ডারের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু টলেমি সম্রাটের শববাহী গাড়ি নিয়ে কেটে পড়ায় এটি পরিত্যক্ত ছিল। পরে রাজপরিবারেরই কাউকে এখানে সমাধিস্থ করা হয়। ফলে আজও এ কাহিনির ইতি টানা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা এখনো হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন রাজা আলেজান্ডারের সমাধি। অবশ্য ১৮৮৭ সালে লেবানন থেকে একটি শিল্পকীর্তি আবিষ্কার হয়। সেটি একটি শবাধার, যা বর্তমানে রাখা আছে ইস্তাম্বুল জাদুঘরে। সেটির নামফলকে লেখা ‘আলেকজান্ডার সারকোফেগাস’। অর্থাৎ আলেকজান্ডারের শবাধার। সেই হিসেবে আলেকজান্ডারের শবাধার মিলেছে বলে স্থাপত্যবিদরা দাবি করলেও ইতিহাসবিদরা একমত নন। তাঁদের মতে, এটি সম্ভবত সিডনের রাজা ‘আবদালোনিমাস’র। সম্ভবত শবাধারটির গায়ে আলেকজান্ডার ও তাঁর সেনাবাহিনীর ছবি খোদাই থাকায় এটি জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে। যাকে সবাই চেনে আলেকজান্ডারের সমাধি হিসেবে।

তাহলে কোথায় আলেকজান্ডারের প্রকৃত সমাধি? ইতিহাসবিদদের ধারণা, গ্রিক বীরের শেষ সমাধিটি সম্ভবত ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ভেঙে ফেলে দুষ্কৃতকারীরা। অবশ্য এর পরও অনেকেই আলেকজান্ডারের সমাধি দেখার দাবি করেছেন। এদের মধ্যে আছেন ইতিহাসবিদ ও পর্যটক ইবনে আবদেল হাকাম, আল মাসুদি, লিও দ্য আফ্রিকানসহ অনেকেই। কিন্তু এরা শুধু দেখার কথাই বলেছিলেন। কোথায় দেখেছিলেন তার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। আর এভাবেই এখনো রহস্য হয়ে রয়েছে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সমাধি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহাসিক স্থানসমূহের পরিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন দেশের মানচিত্রেও এসেছে নানা পরিবর্তন। তাই অনেক ঐতিহাসিক স্থানেরই এখন আর অস্তিত্ব নেই। অনেক স্থানেই তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। এর ফলে দিন দিন এ রহস্যের উন্মোচন করা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।

তার পরও বিজ্ঞানীদের মতো আমরাও আশায় আছি একদিন না একদিন হয়তোবা এ রহস্যের যবনিকাপাত ঘটবে। আর ততদিন পর্যন্ত এ রাজকাহিনির শেষটা হয়ে থাকবে এক রহস্যের আধার।

 

মৃত্যুশয্যায় তিন ইচ্ছা

মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতিদের ডেকে বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর তিনটি ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। এতে যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে। প্রথম অভিপ্রায়, শুধু চিকিৎসকরা আমার কফিন বহন করবেন। দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন যে পথ দিয়ে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথে কোষাগারে সংরক্ষিত সোনা, রুপা ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর ছড়িয়ে দিতে হবে। শেষ ইচ্ছা, কফিন বহনের সময় আমার দুই হাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।’ তাঁর মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত লোকজন মহাবীর আলেকজান্ডারের এই অদ্ভুত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছিলেন না কেউ। তখন আলেকজান্ডারের একজন প্রিয় সেনাপতি তাঁর হাতটা তুলে ধরে চুম্বন করে বলেন, ‘হে মহামান্য, অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে; কিন্তু আপনি কেন এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?’ দীর্ঘ একটা শ্বাস গ্রহণ করে আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমি দুনিয়ার সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। আমার চিকিৎসকদের কফিন বহন করতে বলেছি এ কারণে যে, যাতে লোকে অনুধাবন করতে পারে চিকিৎসকরা আসলে কোনো মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারেন না। তাঁরা ক্ষমতাহীন আর মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম। গোরস্থানের পথে সোনা-দানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি কারণ মানুষকে এটা বোঝাতে যে, ওই সোনা-দানার একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক ধন-সম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের অপচয় মাত্র। কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা জানাতে যে, খালি হাতে আমি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম, আবার খালি হাতেই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি।’

সর্বশেষ খবর