সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বরফের রাজ্য অ্যান্টার্কটিকা

আবদুল কাদের

বরফের রাজ্য অ্যান্টার্কটিকা

পৃথিবীর বুকে ১৮২০ সালে প্রথম মানব সভ্যতা মহাদেশটির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। তবে বরফের এ রাজ্যটি মানুষের বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য।  প্রবল শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম এমন উদ্ভিদ ও প্রাণীরাই কেবল এই মহাদেশে টিকে থাকতে পারে। আজও অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে এই মহাদেশের...

 

অ্যান্টার্কটিকা মানেই বরফের রাজ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম মহাদেশ। বছরজুড়ে সারি সারি সাদা বরফের দেখা মেলে এই মহাদেশে। দক্ষিণ গোলার্ধের অঞ্চলটি একই সঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম, শুষ্কতম এবং উচ্চতম মহাদেশ। রুশ অভিযাত্রী মিখাইল লাজারেভ ও ফাবিয়ান গটলিয়েব ফন বেলিংশসেন সর্বপ্রথম এর অস্তিত্ব উদ্ভাবন করেন। অ্যান্টার্কটিকা শব্দটি গ্রিক যৌগিক শব্দ। যার সহজ মানে হলো উত্তরের বিপরীতে অবস্থিত। ১ কোটি ৪২ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর এই পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশে নেই কোনো দেশ। আস্ত একটা মহাদেশ হলেও এখানে স্থায়ীভাবে মানুষ বসবাস করে না। তেমন সুযোগও নেই। এমনকি এই মহাদেশের অনেকাংশে এখনো পা পড়েনি মানুষের। তবে অ্যান্টার্কটিকায় গ্রীষ্ম মৌসুমে ৪ হাজারের মতো পর্যটক আসেন এবং শীত মৌসুমে এই সংখ্যাটা হাজারের নিচে নেমে আসে। কারণ শীতকালে এখানে তাপমাত্রা মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়! এর বাইরেও বরফের রাজ্যটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা  রিসার্চ স্টেশনগুলোয় গবেষণার সুবাদে বছরে অন্তত ৫ হাজার মানুষ অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থান করে থাকেন। তবুও অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে এই মহাদেশের।

 

অ্যান্টার্কটিকার বরফ কত পুরু?

অ্যান্টার্কটিকা মূলত কঠিন বরফের এলাকা। বরফের রাজত্ব প্রায় ৫৪ লাখ বর্গমাইলেরও বেশি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এবং এ কারণে এ মহাদেশ হয়ে উঠেছে পৃথিবীর পঞ্চম বড় মহাদেশ। অ্যান্টার্কটিকার বরফের প্রধান পুরুত্ব প্রায় ২১৬ কিলোমিটার; যা ৭ হাজার ফুটেরও বেশি। এখানে বরফের যে স্তর রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে কম পুরু স্তর হচ্ছে প্রায় এক কিলোমিটারের। অ্যান্টার্কটিকার ভূমি প্রকৃতপক্ষে বরফের স্তর থেকে অনেক নিচে।

 

মিলেছে গোপন হ্রদের সন্ধান :

এখান পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকায় প্রায় ৩০০টি হ্রদের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানিদের মতে, অ্যান্টার্কটিকার একটি গোপন হ্রদ রয়েছে- বাস্তবে এর সংখ্যাটা অনেক বেশি। অর্থাৎ অনেক গোপন হ্রদ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা হ্রদ খুঁজে পেতে অ্যান্টার্কটিকার ওপরে ঘন হিমবাহের বরফের নিচে ড্রিল করেছিলেন। দর্শনীয় লুকানো হ্রদগুলো এই অঞ্চলের অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি মাত্র। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো- এসব হ্রদে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা হ্রদের পানির নমুনাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন যে, এ রকম কঠোর পরিবেশে কীভাবে ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো বেঁচে থাকে।

 

অ্যান্টার্কটিকার বিশাল পর্বতমালা :

‘দ্য ট্রান্স্যান্টার্কটিক পর্বতমালা’ নামের বিশাল একটি পর্বত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে পূর্ব এবং পশ্চিম অঞ্চলে বিভক্ত করেছে। এর একটি বড় অংশ বরফ এবং তুষারের নিচে চাপা পড়ে আছে। এর মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পর্বতমালাও রয়েছে। আয়তনে যা ২ হাজার মাইলেরও বেশি বিস্তৃত।

 

অ্যান্টার্কটিকায় শহর!

আসলে অ্যান্টার্কটিকায় কোনো অধিবাসী নেই। এটি একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, যা কিনা ভূমি, জলবায়ু এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতায় পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা। অ্যান্টার্কটিকায় ভ্রমণকারী প্রায়শই ক্রুজ জাহাজে অবস্থান করেন। বিজ্ঞানী ও গবেষকরা রিসার্চ স্টেশনগুলোয় কাজ করেন। তবে এখানে একটি শহর রয়েছে- যা চিলির অধিবাসীদের গবেষণার স্থান। মধ্য অ্যান্টার্কটিকার একটি শহরের নাম ভিলা লাস এস্ট্রেলাস। ইংরেজিতে এই শহরকে ‘দ্য স্টারস টাউন’ও বলা হয়। অ্যান্টার্কটিকার কিং জর্জ দ্বীপের বিচ্ছিন্ন একটি শহর এটি। একে তুলনা করা হয় আর্জেন্টিনার এসপেরেঞ্জা বেজের সঙ্গে। এসপেরেঞ্জার চেয়েও বড় এই দ্বীপ শহরটি।

 

বরফে আগ্নেয়গিরি!

অ্যান্টার্কটিকায় প্রচুর বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে, তবে দুটি সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষকরা এই অঞ্চলে বরফের নিচে অবিশ্বাস্যভাবে আকর্ষণীয় এবং বিরল ধরনের আগ্নেয়গিরির সন্ধান পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা পশ্চিম আন্টার্কটিকার জমাট বরফের নিচে একসঙ্গে ৯১টি আগ্নেয়গিরির সন্ধান পেয়েছেন। গবেষকদের মতে, এগুলো তুলনামূলক নতুন এবং কোনো দিনই দিনের আলো দেখেনি। তাদের শঙ্কা, এগুলোতে অগ্ন্যুৎপাত হলে বরফ স্তরে ধস নামতে পারে। যার প্রভাবে পানির স্তর বাড়তে পারে। ফলে ভূপৃষ্ঠের একটা বড় অংশ জলের তলায় যেতে পারে। তবে কিছুটা আশার আলোও পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বর্তমানে আগ্নেয়গিরিগুলো সুপ্ত অবস্থাতে রয়েছে। এই মুহূর্তে এগুলোর জেগে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। আসলে আগ্নেয়গিরিগুলো সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে।  আগ্নেয়গিরিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির উচ্চতা প্রায় ৪ হাজার মিটার। যা উচ্চতায় সুইজারল্যান্ডের ইগার আগ্নেয়গিরির সমান। নতুন আবিষ্কৃত এই আগ্নেয় পার্বত্য অঞ্চলে ১০০ থেকে ৩৮৫০ মিটারের পাহাড়ের সন্ধান মিলেছে। ম্যাক্স ভ্যানের কথায়, ‘আগ্নেয়গিরিগুলোর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০-৪০০০ মিটার পর্যন্ত। সবগুলোই বরফে ঢাকা। ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু বরফের নিচে ঢাকা রয়েছে এসব আগ্নেয়গিরি।’ এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলটির প্রধান ম্যাক্স ভ্যান সতর্ক করে বলেছেন, ‘উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলতে শুরু করলে অগ্ন্যুৎপাত এড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।’

 

মিঠাপানির রাজ্য

পৃথিবীর মিঠাপানির সবচেয়ে বড় উৎস অ্যান্টার্কটিকা। পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ স্বাদু পানি রয়েছে এই মহাদেশে। তবে অধিকাংশ পানি বরফ আকারে আছে। তাই অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলিয়ে পানও করা যাবে। পানযোগ্য পানির ক্রমাগত হ্রাসের এই দুরবস্থায় অনেকেই সমাধান হিসেবে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলিয়ে পানের পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু সে চেষ্টা করা উচিত হবে না একদমই। কারণ অ্যান্টার্কটিকা এত বিশাল আর এখানে এত পরিমাণ বরফ আছে যে, অ্যান্টার্কটিকার বরফ যদি গলে যায় তাহলে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ ২০০ ফুট বৃদ্ধি পাবে। ফলে স্থলভাগ যেখানে আমরা বসবাস করি তার অনেক স্থানই পানির নিচে তলিয়ে যাবে।

 

অসংখ্য রিসার্চ স্টেশন

অ্যান্টার্কটিকার বাতাসে নেই কোনো আর্দ্রতা। ফলে খুব সহজেই মানুষ আক্রান্ত হতে পারে চর্মরোগ ও ডিহাইড্রেশনে। এ ছাড়াও এই মহাদেশের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯৫০০ ফুট উঁচুতে। ফলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণও স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তাই সত্যিকার অর্থে এখানে কোনো স্থায়ী বসতি নেই। অ্যান্টার্কটিকায় গ্রীষ্মকালের ৩০টি ক্যাম্প ছাড়াও প্রায় ৪৫টি স্থায়ী রিসার্চ স্টেশন বা গবেষণাগার রয়েছে। যেখানে উষ্ণ মৌসুমে সর্বোচ্চ ১২০০ জন পর্যন্ত থাকেন। এসব গবেষণাগারে এই মহাদেশীয় প্রাণীদের জীবন-ব্যবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান, তাপমাত্রা এবং ভূকম্পণ নিয়ে নানা রকমের গবেষণাগুলো করা হয়। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া অ্যান্টার্কটিকার দুর্গম বরফের ওপর স্থাপন করেছিল ভস্টক নামের এক গবেষণা কেন্দ্র। ভস্টক স্টেশন নামেই এর পরিচিতি। এটি দক্ষিণ মেরুর কাছে, ‘পোল অব কোল্ড’ বা শীতল বিন্দুতে স্থাপন করা হয়েছে। এখানকার তাপমাত্রা -৮৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই বিন্দুটাই হলো পৃথিবীর শীতলতম স্থান। প্রতিটি স্টেশনের রয়েছে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য। তবে এগুলো এমনভাবে তৈরি যেন প্রচন্ড বৈরী পরিবেশ থেকে গবেষকদের রক্ষা করতে পারে। ইন্টারনেট সুবিধাও রয়েছে অ্যান্টার্কটিকায়। তবে তা খুবই সীমিত। কঠিন পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও মহাদেশটি গবেষক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য আদর্শ স্থান। গ্রীষ্মকালে তো বটেই, শীতকালেও এখানকার আকাশ পরিষ্কার থাকে। ফলে পৃথিবীর কক্ষপথ, গ্রহ-নক্ষত্র, তারকা স্পষ্ট দেখা যায়। ২০১৯ সালে ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি নেওয়া ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের একাংশ রয়েছে এই মহাদেশেই।

 

নেই কারও মালিকানা

১৯৫৯ সালে অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি সই হয়েছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে ওই মহাদেশকে যুদ্ধ, অস্ত্র ও পরমাণু বর্জ্য থেকে মুক্ত রাখতে একমত হয়েছিলেন বিশ্বের নেতারা। অ্যান্টার্কটিকা চুক্তিতে বলা হয়, এই অঞ্চলে কোনো একক দেশের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। বরং সব দেশের বিজ্ঞানীরা মিলেমিশে সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করবেন। তাই অঞ্চলটির ‘শান্তি ও বিজ্ঞানের জন্য নিয়োজিত প্রাকৃতিক সংরক্ষিত এলাকা’ হিসেবে ধরে রাখতে একমত হন নেতারা। এরপর ১৯৭৬ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে অ্যান্টার্কটিকায় প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ চালানোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

সর্বশেষ খবর