শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভালো কাজ করতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে

নাফিজ বিন জাফর

ভালো কাজ করতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে

অস্কার মঞ্চে নাফিজ বিন জাফর

পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ান চলচ্চিত্রটির ভক্ত নেহাতই কম নয়। এই ছবির নায়ক বা খলনায়ক যাই বলেন মূল ভূমিকায় থাকা জ্যাক স্প্যারোর অসাধারণ সব কর্মকাণ্ড মনে পড়লেই হেসে কুটিকুটি হন বা ভয়ে শিউরে ওঠেন অনেকেই। তার বৈচিত্র্যময় ও পুলকিত চরিত্রের সঙ্গে মিশে আছে নানা ধরনের অসম্ভব কাজের নমুনা। তবুও আগ্রহ নিয়ে ছবিটি দেখা। কিন্তু এই কাজগুলো কি সত্যিই তিনি করেছেন! উত্তর, না। এগুলোর সবই সমাধান হয়েছে ভিজুয়াল অ্যাফেক্টেসের মাধ্যমে। অবিশ্বাস্য এসব দৃশ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক পদ্ধতি যাকে বলা হয়ে থাকে ফ্লুইড সিমুলেশন সিস্টেম। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বা সিস্টেমের মাধ্যমে সিনেমার যে কোনো চরিত্র পানির গভীর বা দুর্গম যে কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। যেমনটি দেখা গেছে পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানের দ্বিতীয় পর্ব ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড অ্যান্ডসে। পুরো বিশ্বকে চমকে দেওয়া এই কাজটি সম্ভব হয়েছে আমার নিরলস পরিশ্রমে।

আমার জন্ম বাংলাদেশে, বর্তমানে মার্কিনমুলকে বাস করছি। এ দেশে নাগরিকত্ব পেয়েছি। আমার আবিষ্কার বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণমাধ্যম চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রে দিয়েছে নতুন মাত্রা। ফলে বাস্তব আর কৃত্রিমতার মাঝে সাধারণ দর্শকের পক্ষে এসব ফারাক খোঁজা একেবারেই সম্ভব না। ‘ফ্লুইড সিমুলেশন’ নামের কম্পিউটার গ্রাফিক্স টুলসের ব্যবহারে পানি, আগুন কিংবা ধোঁয়ার মতো পদার্থের দ্বারা সৃষ্ট কোনো অ্যানিমেশন কয়েকগুণ জীবন্ত মনে হয়। এই আবিষ্কারে আমার সহযোগী ছিলেন আরও দুই প্রোগ্রামার ডউগ রোবল এবং রায়ো সাকাগুচি।

আমাদের আবিষ্কৃত এই বিশেষ গ্রাফিক্স টুলটি ব্যবহূত হয় ২০০৭-এ মুক্তি পাওয়া দুনিয়া কাঁপানো চলচ্চিত্র ‘পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ানের অ্যাট ওয়ার্ল্ডস অ্যান্ড সিকুয়ালে’। এ ছবির স্পেশাল ইফেক্টের জন্য আমি পেয়েছিলাম অস্কারের সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাওয়ার্ড। শুধু তাই নয়, এই পুরস্কারের পর আমার সুযোগ আসে খ্যাতনামা পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের প্রতিষ্ঠান ‘ড্রিম ওয়ার্কস অ্যানিমেশন’-এ কাজের।

আমাদের অবিশ্বাস্য গ্রাফিক্স আর ভিজুয়াল ইফেক্টের ব্যবহারে চলচ্চিত্রকে করেছে খুবই জনপ্রিয়। একই সঙ্গে নতুনের স্বাদে দর্শকের দৃষ্টি কাড়তে রেখেছে দারুণ ভূমিকা। পাশাপাশি সিনেমাগুলো পেয়েছে ব্যবসায়িক সফলতা। আমাদের মতো এমন কাজ যারা করে থাকেন তাদের মূল্যায়ন করা হয় চলচ্চিত্রবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার অস্কারে। দেওয়া হয়ে থাকে সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল অ্যাওয়ার্ড। সে তালিকায় একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে আমার নাম লেখা হয়েছে ২০০৭ এবং ২০১৫ সালে দুবার।

আমার জন্ম ১৯৭৮ সালের ৮ অক্টোবর। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী এবং অ্যানিমেশন বিশেষজ্ঞ। পেশাজীবনে চীনের সাংহাইয়ের ওরিয়েন্টাল ড্রিম ওয়ার্কসের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছি। আমার বাবা জাফর বিন বাশার ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল। মায়ের নাম নাফিসা জাফর। মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি সৃষ্টিশীলতার অনুপ্রেরণা। বাবার কাছ থেকে পেয়েছি ম্যাথ ও সায়েন্স পড়ার আগ্রহ। আপনারা আমার প্রপিতামহের নাম নিশ্চয় শুনে থাকবেন, তিনি কবি গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪)। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে খ্যাতিমান। তার জন্ম ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকুপা থানার অন্তর্গত মনোহরপুর গ্রামে। কলকাতা রিপন কলেজ থেকে ১৯১৮ সালে তিনি স্নাতক হয়েছিলেন। পরে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২০ সালে জানুয়ারি মাসে ব্যারাকপুর সরকারি হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সূচনা হয়। ১৯২৪ সালে ব্যারাকপুর হাইস্কুল থেকে তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুলে বদলি হন। দীর্ঘদিন এখানে শিক্ষকতা করার পর তিনি কলকাতা মাদ্রাসায় বদলি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৩৫ সালে বালিগঞ্জ সরকারি ডিমনেস্ট্রেশন হাই স্কুলে বদলি হয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন। পরে ওই স্কুলে তিনি প্রথম মুসলিম প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। দীর্ঘ ৩০ বছর শিক্ষকতা করার পর  ১৯৫০ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। তার বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘হাসনা হেনা’, ‘খোশরোজ’, ‘সাহারা’, ‘বুলবুলিস্তান’, ‘একমণ এক প্রাণ’ ইত্যাদি। কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ অত্যন্ত প্রশংসিত ও বহুল প্রচারিত বই। সংগীতের ক্ষেত্রেও তাঁর উজ্জ্বল প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি পাকিস্তান সরকারের সিতারা ই ইমতিয়াজ ও প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল লাভ করেছিলেন। তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার বিখ্যাত পাপেটনির্মাতা ও চিত্রশিল্পী হিসেবে।  আমার মামা জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন। আমার কেরিয়ার শুরু করার পর হলিউডের পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান : অ্যাট ওয়ার্ল্ডস অ্যান্ড চলচ্চিত্রে ফ্লুইড অ্যানিমেশনের জন্য সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল বিভাগে ডিজিটাল ডোমেইন নামে ভিজুয়াল ইফেক্টস ডেভেলপার কোম্পানির হয়ে একটি পুরষ্কার জিতেছিলাম। আমাকে কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট সিনেমার জন্য নয়, এ পদক দেওয়া হয় চলচ্চিত্রে প্রয়োগ উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য। ওই সময় আমি আবিষ্কার করেছিলাম ‘ড্রপ ডেস্ট্রাকশন টুলকিট’ নামের একটি প্রযুক্তি।

আমি আমার বাবার কথা বলতে চাই, বাবার চাকরির সুবাদে ছেলেবেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার স্মৃতি আজও আমাকে নাড়া দেয়। বিশেষ করে খাগড়াছড়ি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কঠোর পরিশ্রম, তাদের জীবনাচরণ আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সত্যি বৈচিত্র্যময় তাদের জীবন। তাদের সংস্কৃতি, ভিন ভাষায় তাদের শিশুদের পড়াশোনা, পাহাড়ে জুম চাষ সত্যিই বৈচিত্র্যময়। আমার স্কুল জীবন একেবারে সাধারণ বাঙালি শিক্ষার্থীদের মতো। কুমিল্লার ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলে শুরু হয় প্রাথমিক পড়াশোনা। তারপর ঢাকায় এসে শহীদ আনোয়ার স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। পরবর্তীতে ৬ গ্রেডের আগ পর্যন্ত পড়াশোনা করি মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। ১৯৮৯ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে পাড়ি জমিয়েছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর সাউথ ক্যারোলিনেই পড়াশোনা শেষে আমার পেশাগত জীবনের সূচনা।

আমার যখন ২০ বছর বয়স তখন চার্লসটন কলেজ থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ালেখা শেষ করি। বর্তমানে লস অ্যাঞ্জেলসে পেশাগত জীবন নিয়ে বেশ ব্যস্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার ছাত্র জীবন অত্যন্ত আনন্দের ছিল। বিশেষ করে আমি যখন নাসাতে ইন্টার্নশিপ করছিলাম ওই সময়। দারুণ সময় কাটিয়েছি সেখানে। সেখানে যেন শেষ নেই। পৃথিবীর কত অসাধারণ বিজ্ঞানী রাত দিন কাজ করছেন নাসায়। সে এক মজার অভিজ্ঞতা, যা আমার জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছে।  সেখানেই মূলত আমার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে কাজের শুরু। এরপর জেমস ক্যামেরুনের তৈরি ডিজিটাল ডোমেইনে প্রথম চাকরি নিয়েছিলাম। কম্পিউটার সফটওয়্যারে পড়াশোনা করলেও আমার আগ্রহ ছিল গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রতি। তখন সেখানে ভিডিও গেমস আর মুভিতে কাজের দুটি অপশন আসে। আমি বেছে নিয়েছিলাম মুভিতে কাজ করার অপশন। তারপর জয়েন করি ড্রিম ওয়ার্কসে।

টেকনিক্যাল অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ফিল্ম মেকিং প্রসেসিং এ অবদানের জন্য। সেখানে একটা প্রসেস তৈরি বা উন্নীতকরণ অধিকাংশ ছবিতে প্রভাবিত করেছে। বর্তমানে পুরো ফিল্ম মেকিং আর্টই চেঞ্জ হয়েছে। ওই ধরনের কাজের জন্য আমি পুরস্কার পেয়েছি।

এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ২০১২ ছবির মধ্য দিয়ে। এরপর এই ‘ড্রপ ডেস্ট্রাকশন টুলকিট’ ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হলিউডি ছবিতে। তার চলচ্চিত্রে অনেক বড় ধরনের কাজ করা হয়। রিয়েল অনেক কিছু সিনেমাতে ধ্বংস করলে অনেক টাকা খরচ হয়। কিন্তু আমার প্রযুক্তি ব্যবহার করেন ভিজুয়ালে। তারপর হলিউডের একের পর এক সিনেমায় আমি কাজ করেছি। বিভিন্ন টেকনিক্যাল ক্যাটাগরিতে তার প্রয়োগ দেখা গেছে। প্রধান প্রকৌশলী বা জ্যেষ্ঠ সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন একাধারে মাদাগাস্কার, ইউরোপস, মোস্ট ওয়ান্টেডে পুস ইন বুটস ও কুংফু পান্ডা ২ ও ২ থাওজেন্ড ডলসহ দুই ডজন চলচ্চিত্রে।

আমি মনে করি, নবীনদের ক্যারিয়ার ভালো করার পেছনে অবশ্যই পরিবারের উৎসাহ দরকার। শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিলকে ভালো ক্যারিয়ারের আওতায় না রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রকে যুক্ত করা যায়। এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ক্যারিয়ার তৈরি করা যায়। এ ছাড়াও বড় পরিসরে অবদান রাখা যায়। অভিবাসী পরিবার থেকে ছেলেমেয়েদের একটি পারিবারিক চাপ থাকে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, উচ্চ বেতনে উচ্চ পদে চাকরি করতে হবে। এক কথায় আর্থিক সামর্থ্য আনার জন্য থাকে অনেক বড় একটি চাপ। সে জন্য আমার মতে সৃষ্টিশীল ক্ষেত্রে কাজ করা যেতে পারে। ভালো কাজ করতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রমকে আমি সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করি। 

নাফিজ বিন জাফরের উল্লেখযোগ্য সিনেমা : মাদাগাস্কার ৩ : ইউরোপস মোস্ট ওয়ান্টেড (প্রধান প্রকৌশলী), পুস ইন বুটস (জ্যেষ্ঠ সফটওয়্যার প্রকৌশলী), কুংফু পান্ডা ২ (জ্যেষ্ঠ সফটওয়্যার প্রকৌশলী), মেগামাইন্ড  জ্যেষ্ঠ প্রোডাকশন প্রকৌশলী), শ্রেক ফরেভার আফটার (জ্যেষ্ঠ প্রোডাকশন প্রকৌশলী ), পার্সি জ্যাকসন অ্যান্ড দ্য লাইটেনিং থিফ (সফটওয়্যার প্রকৌশলী), দ্য সিকার : দ্য ডার্ক ইজ রাইজিং, পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান : অ্যাট ওয়ার্ল্ডস অ্যান্ড ফ্ল্যাগস অব আওয়ার ফাদার স্টিলথ।

 

লেখক : অস্কারজয়ী বাংলাদেশি।

অনুলিখন : তানিয়া জামান

সর্বশেষ খবর