মাঠঘাট চেনা পথ সবই তলিয়ে গেছে। চারিদিকে অথৈ পানি। বাধ্য হয়ে পুরো পরিবার আশ্রয় নিয়েছে টিনের ঘরে। বন্যাদুর্গত এলাকায় খুবই পরিচিত দৃশ্য।
স্মরণকালের এই ভয়াবহ বন্যায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে বৃদ্ধ ও শিশুরা। খাবারের সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাবে রোগব্যাধিও বাড়ছে। চারদিকে শুধু সমস্যা আর সমস্যা। ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ¥ীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জসহ আরও বেশ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন স্থানে রীতিমতো মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে তীব্র স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে গবাদি পশু। হাজারো গরু পানিতে ভাসছে। ছাগল-ভেড়ার মৃতদেহ এখানে সেখানে ভাসছে। অথচ এই গবাদি পশুর ফার্ম করেই হয়তো বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন হাজারো তরুণ উদ্যোক্তা। সে স্বপ্ন এখন সর্বনাশা বানের জলে বিলীন হয়ে গেল। মহামূল্যবান জীবনই যেখানে বিপন্ন সেখানে আর স্বপ্ন কী? স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যায় জীবন এবং স্বপ্ন যেন একসঙ্গে ভেসে যাচ্ছে।
ফেনি শহরে পানিতে ডুবে গেছে বাড়ি। কলা গাছের ভেলায় চড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধা। ছবিগুলো গতকাল তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন
খাবার ও পানির সংকট : বন্যার্তদের সহযোগিতা করতে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অথৈ পানির কারণে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য তারা হাহাকার করছেন। মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে অনেকে যে বিপদে আছেন সে খবর কাউকে জানাতে পারছে না।
নেই পর্যাপ্ত নৌকা : ভয়াবহ এই বন্যায় প্রধান যানবাহন হচ্ছে নৌকা। কিছু কিছু এলাকায় এত বেশি পানি যে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়াই যাচ্ছে না। গতকাল আমাদের প্রতিনিধিকে কুমিল্লার বুড়িচংয়ের খাড়াতাইয়া গ্রামের রেহানা বেগম জানান, আমি তো উঁচু একটা স্থানে আছি। আমার বাড়িতে গলা সমান পানি। গ্রামে অনেকেই বাড়ির ছাদে অবস্থান করছে। তারা কোথাও যেতেও পারছে না। এসব মানুষকে উদ্ধার করতে নৌকা প্রয়োজন।
সাপের কামড়ের আতঙ্ক : দুর্গত এলাকায় সাপের কামড় রীতিমতো আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। থইথই পানির কারণে বসতবাড়ির যেটুকু অংশ ভেসে আছে সেখানে সাপও আশ্রয় নিচ্ছে। গত দুই দিনে শুধু নোয়াখালীতেই ৩৫ জন সাপের কামড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
বাড়ছে ডায়রিয়া : বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারণে বেড়েছে ডায়রিয়া। কোথাও কোথাও স্যালাইনও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন হাসপাতাল দুর্গত এলাকা ভাগ করে মেডিকেল টিম গঠন করেছে। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা দুর্গত এলাকায় গিয়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছেন।
উদ্ধারের আকুতি : এমন কিছু দুর্গত এলাকা আছে যেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালানোও কঠিন হয়ে গেছে। বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে মানুষ। কুমিল্লা প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেক বাড়িতে গলা সমান পানি, তারপরও বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না মানুষ। ফেনীর কোথাও কোথাও বাড়ির একতলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। মানুষ ছাদে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে উদ্ধারের ক্ষণ গুনছেন।
পানি কমছে, বাড়ছে দুর্ভোগ : বন্যার পানি কোথাও কোথাও কমতে শুরু করেছে। হবিগঞ্জের নদনদীর পানি বিপৎসীমার নিচে। বৃষ্টি কম হওয়ায় আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন জেলার সাধারণ মানুষ। কিন্তু পানি কমলেও বেড়ে গেছে অন্যান্য দুর্ভোগ।
পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় শিফুকে : ফেনী সদর উপজেলায় দাফনের জায়গা না পেয়ে বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে শিফু (৪০) নামে এক প্রতিবন্ধী নারীর লাশ। আমাদের ফেনী প্রতিনিধিকে শিফুর ভগ্নিপতি শাহেদুল হক জুয়েল জানিয়েছেন, বন্যায় পুরো এলাকা তলিয়ে গেছে। দাফনের কোনো জায়গা না পেয়ে আমরা বাধ্য হয়েই শুক্রবার সন্ধ্যায় শিফুর লাশ বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছি।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধি)