বুধবার, ২৯ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

ব্রেক্সিট গণভোট : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ভাঙনের সুর

হাসান তারিক চৌধুরী

ব্রেক্সিট গণভোট : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ভাঙনের সুর

একসময় বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। বালক বয়সে কথাটির অর্থ বুঝতে পারতাম না। আমার দাদি পারুল বেগম চৌধুরী আমাকে সেটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য ডুবেছে বহু আগেই।  কিন্তু এবার বোধ হয় একেবারে ব্রিটিশ সূর্যের ভরাডুবি হতে চলেছে। বিশেষ করে ব্রেক্সিট গণভোটের ফলাফল ঘোষণার পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে চূড়ান্ত ভাঙনের সুর বেজে উঠেছে। লন্ডনের নতুন মেয়র সাদিক খান ইতিমধ্যেই ব্রিটেন থেকে লন্ডনকে বিচ্ছিন্ন করতে গণভোট দাবি করেছেন। বলেছেন, বিচ্ছিন্ন লন্ডন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেবে। ব্রিটেনের ডেইলি মিরর পত্রিকা গত ২৫ জুন লিখেছে পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজার ভোটার সাদিক খানের এই দাবিকে সমর্থন করে একটি দরখাস্তে সই করেছেন। বিচ্ছিন্ন হওয়ার আওয়াজ তুলেছে স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডও। ব্রেক্সিট গণভোটের ফলাফলেও এর প্রতিফলন দেখা গেছে, এ দুটি দেশের মানুষ যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। ফলে এ গণভোটে স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নে জোটভুক্ত থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছে। স্কটল্যান্ডে ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট পড়েছে ৬২% এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে একই মতের পক্ষে ভোট পড়েছে ৫৫.৭%। এ দুটি রাজ্যও এখন ইংল্যান্ডের অধীন থাকতে চায় না। তারা এ বিষয়ে পুনরায় গণভোট দাবি করেছে। ধারণা করা যাচ্ছে, ব্রিটেনে আগামী দিনগুলোতে এ বিচ্ছিন্নতার দাবি ও আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হবে।

ব্রেক্সিট গণভোটের ফলাফলে আজ উত্তাল ইউরোপ। একই রকম সংকট সৃষ্টি হয়েছিল গ্রিসের আর্থিক মন্দার সময়। সৃষ্টি হয়েছিল ‘গ্রেক্সিট ইস্যু’ নামের এক সংকট। এই একই সংকট আজ তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ব্রিটেনকেও এখন ঘিরে ধরেছে চরম আর্থিক সংকট। কোহিনুর হীরকখচিত রানী এলিজাবেথের মুকুট আজ ম্লান হতে চলেছে। কিন্তু নিজ দেশের অর্থনৈতিক সংকটের দায়ভার ব্রিটিশ রক্ষণশীল রাজনীতি আজ বহন করতে নারাজ। তাই তারা তাদের সমাজের এ ক্ষত আড়াল করতে চাইছে। মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে চাইছে অন্যদিকে। ব্রেক্সিট গণভোট ব্রিটিশ শাসকশ্রেণির সৃষ্ট সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ। গত ২৩ জুন ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এই ব্রেক্সিট গণভোট। অর্থাৎ ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে কিনা? এ প্রশ্নে গণভোট। এ গণভোট নিয়ে ইউরোপজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলেছে। গণমাধ্যমগুলোতে চলেছে বিশেষজ্ঞদের নানা তর্কবিতর্ক। ইউরোপের আগামী নিয়ে এখনো চলছে নানা তর্ক, নানা বিশ্লেষণ। ব্রিটেনের ৭২% মানুষ এ ব্রেক্সিট ভোটে অংশ নিয়েছিল। গণভোটের ফলাফলে দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিতর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতামতই ব্রেক্সিট গণভোটে ৫১.৯ শতাংশ ভোটে জয়যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট দেয় ৪৮.১ শতাংশ ব্রিটিশ ভোটার। এ ভোটের ফলাফল আজ শুধু ব্রিটেনই নয়, সারা ইউরোপ এমনকি দুনিয়াজুড়ে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটেনে পাউন্ডের দাম গত ৩১ বছরের রেকর্ডকে অতিক্রম করে ১ দশমিক ৩৫ ডলার কমে গেছে। দরপতন হয়েছে ব্রিটিশ শেয়ারবাজারেও। রাজনীতিতেও চলছে চরম অস্থিরতা। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এরই মধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী অক্টোবরের মধ্যেই তার পদত্যাগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সংকট সৃষ্টি হয়েছে ব্রিটেনের লেবার পার্টির ভিতরেও।

ব্রেক্সিট গণভোটে ব্রিটিশ রাজিনীতি কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একপক্ষ ব্রেক্সিটের পক্ষে। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। অপরপক্ষ ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে। যাদের ব্রেমিন নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাই ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবেই ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ইতিহাসটিও যৎসামান্য উল্লেখ করতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ঐক্যের নীতি গ্রহণ করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক ‘রোম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। গঠিত হয় ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়, সংক্ষেপে ইইসি। যা পরবর্তীকালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুর দিকে ব্রিটেন এই রোম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ঐক্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে যথাক্রমে ১৯৬৩ এবং ১৯৬৭ সালে এ সংস্থার সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে। কিন্তু তৎকালীন ফরাসি রাষ্ট্রপতি শার্ল দ্য গলের ভেটোর কারণে ব্রিটেন সেসময় এর সদস্য হতে পারেনি। শার্ল দ্য গলের বিদায়ের পর ১৯৭৩ সালে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। প্রতিষ্ঠার সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল বক্তব্য ছিল, ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যকার অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও জোরদার করা। এ লক্ষ্যে ইউরোপজুড়ে অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠা করা, একক মুদ্রা চালু করা এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে জনগণ ও পণ্যের মুক্ত চলাচল নিশ্চিত করা। এরকম ইতিবাচক লক্ষ্য নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যাত্রা শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি আর সে জায়গায় থাকেনি।  বিভিন্ন বিষয়ে একসময় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি থাকলেও আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিতরে নানা সংকট নানা মাত্রায় বেড়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে ইউরোজোন সংকটের মতো বিরাট আর্থিক সংকট। শ্রমিকশ্রেণির ওপর নানা সংকট নেমে এসেছে। সামাজিক সুবিধা বৃৃদ্ধির বদলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামাজিক সুবিধা কর্তন করা হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে ব্রিটেনের কেউ কেউ মনে করছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলে এ সংস্থার আর্থিক সংকটের দায় থেকে ব্রিটেন অনেকটা মুক্ত হবে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদ্যমান আইনের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে ব্রিটেন তার সমস্যা একাই সুরাহা করতে পারবে। আসলে কি তাই? নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক স্টিভেন ফিল্ডার্সের মতো পণ্ডিতরা বলেছিলেন, ব্যাপারটি মোটেই সেরকম হবে না। গণভোটের প্রচারণায় ব্রেক্সিটের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনই এ বিপদ ডেকে এনেছেন। কারণ,  নিজের সরকারের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য তিনি একসময় ব্রেক্সিট গণভোটের মতো ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ব্রিটেনের বর্ণবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সমর্থন কুড়িয়েছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা গত এপ্রিল মাসে রানীর জন্মদিন উপলক্ষে ব্রিটেন সফরকালে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসলে যুক্তরাজ্য মার্কিনের বাণিজ্য তালিকার পেছনের দিকে চলে যাবে। আজ সে কথাই সত্যি হতে যাচ্ছে। তাহলে কারা ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনতে চায়? এ প্রশ্নের সুন্দর উত্তর দিয়েছেন ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন। তিনি বলেছেন, ব্রিটেনের ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীই ব্রেক্সিট গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে নিয়ে আসতে চায়। এর পেছনে কাজ করছে তাদের নয়া ফ্যাসিস্ট ও বর্ণবাদী মানসিকতা। তারা মনে করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিতরে থাকলে অন্য ইউরোপীয় দেশের নাগরিকরা যুক্তরাজ্যে ঢুকে সেখানকার শ্রমিকদের শ্রমবাজার নষ্ট করে দেবে। মুসলমানরা যুক্তরাজ্যকে বিরাট সমস্যায় ফেলবে ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি ৪৮ হাজার ইউরোপীয় নাগরিক এবং ১৫ লাখ মুসলমান ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বেশ ইতিবাচক অবদান রাখছে।  করবিন বলেছেন, ‘আমরা বহু জাতির এবং বহু ধর্মের মানুষের ব্রিটেনে বিশ্বাস করি। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলরা তা করে না। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী নেতা, উগ্র ডানপন্থি নাইজেল ফারাগে রিফিউজিদের ছবি দিয়ে শত শত ব্যানার বানিয়ে ব্রিটেনকে রিফিউজি প্লাবনের ভয় দেখাচ্ছে। তার সঙ্গে রয়েছে রক্ষণশীল দলের নেতা মাইকেল বোল্ড এবং বরিস জনসন। আসল কথা হলো, এর পেছনে কাজ করছে তাদের সংখ্যালঘু বিদ্বেষী মতাদর্শ। অন্যদিকে বামপন্থি অবস্থান থেকেও বেশ কিছু বাম নেতা এই ব্রেক্সিট এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তাদের অবস্থানটা প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো নয়। সে বাম বন্ধুদের উদ্দেশে আমি বলি, ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাখার পক্ষে ভোট দেওয়ার প্রশ্নটি কোনো নিঃশর্ত বিষয় নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য এটি প্রয়োজন। আমাদের বুঝতে হবে, এখনো ব্রিটেনের অর্থনীতির অর্ধেকেরও বেশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রচলিত আইন শ্রমজীবী মানুষের জন্য চার সপ্তাহ ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং নানারকম বৈষম্যবিরোধী আইন বহাল রেখেছে। এটিকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে হবে। সর্বোপরি ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নাফটার মতো ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপের মতো সাম্রাজ্যবাদী চুক্তির মাশুল গুনতে হবে।’

তাই দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা ব্যর্থতার অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে আজ এ ব্রেক্সিটের মাধ্যমে অভিবাসী শ্রমিক ও ব্রিটেনে বসবাসরত বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের খড়গ নেমে আসার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে ব্রিটেনের এ গণভোটের ফলাফলের প্রভাব বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির ওপরও ব্যাপক মাত্রায় পড়বে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর ফলে শুধু বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ই কমবে না। উপরন্তু দেশের রপ্তানি আয়ও বিরাট পরিমাণে কমে যাবে। ১৯৭১ সাল থেকে ইউরোপের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে শুল্ক সুবিধা ভোগ করত তা এখন বাধার সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে ইইউ দেশগুলোর পরেই ছিল ব্রিটেনের স্থান। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেওয়া তথ্যমতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও ব্রিটেনে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩.২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।  বাংলাদেশের পোশাক ব্যবসায়ীদের মতে, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে নিশ্চিতভাবেই ব্রিটেন আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়বে। ফলে যেহেতু তাদের ওপর এখন আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন আইনের বাধ্যবাধকতা নেই ফলে তারা নিজেদের আর্থিক সংকট ঠেকাতে বাংলাদেশের ওপর শুল্ক আরোপে বিলম্ব করবে না।’ তাই বিভক্ত ইউরোপের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থনীতিকে নতুন আঙ্গিকে ভাবতে হবে।

লেখক : রাজনীতিক ও আইনজীবী।

ই-মেইল: [email protected]

সর্বশেষ খবর