বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিবর্ণ দেশ, বিপন্ন স্বাধীনতা

নূরে আলম সিদ্দিকী

বিবর্ণ দেশ, বিপন্ন স্বাধীনতা

আমরা তখন মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ছিলাম। হলি আর্টিজানে তখন জঙ্গিবাদের পাশবিকতা ও নৃশংসতার বীভৎস উল্লাস শুরু হয়েছে। খবরটি মসজিদেই বন্ধুবর ড. মিজানুর রহমান মিজান আমাকে প্রদান করেন। পুরো খবর তখন তারও অজানা। তাই আমি শুনলাম, হলি আর্টিজানে গোলাগুলি হচ্ছে। কে বা কারা জানতে না পারলেও একটা অজানা আতঙ্কে সমস্ত অনুভূতিটা কেমন যেন দুমড়ে-মুচড়ে গেল। মানুষ হিসেবে আমি গণতান্ত্রিক মননশীলতার অধিকারী বলেই যে কোনো ধরনের গোলাগুলি ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডকে আমি অন্তর থেকে ঘৃণা করি। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার মৌলিক অধিকারের প্রতি আমার সহমর্মিতা সর্বজনবিদিত। হত্যা তো দূরে থাক, যে কোনো মানুষের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষার জন্য আমি কতটুকু প্রত্যয়দৃঢ়, অকুতোভয়— তা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ, প্রায় অসম্ভব।

হলি আর্টিজানে ইসলামের নামে যে বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ড চলেছে তা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু পাপাচারই নয়; সম্পূর্ণ হারাম হারাম হারাম। একজন মুসলমান হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, অতি ক্ষুদ্র একটা বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট, হতাশাগ্রস্ত অংশ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান সন্ত্রাসের বিপক্ষে প্রত্যয়দৃঢ় অভিমত পোষণ করেন। আসলে পৃথিবীজুড়ে মুসলমানদের মধ্যে জরিপ চালালে শতকরা ৯৯.৯০ ভাগ মুসলমান জঙ্গি-সন্ত্রাসকে হারাম এবং বিকৃত ও ভ্রান্ত মস্তিষ্কের পাপাচার বলে মন্তব্য করবেন। এ প্রশ্নে মুসলিম উম্মাহ কেবল দ্বিধাহীন ও নিঃসংশয় চিত্তই নয়, প্রত্যয়দৃঢ়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বের সমস্ত মুসলিম বিদ্বেষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে এই অপপ্রচারে বদ্ধপরিকর যে, যে কোনোভাবে জগৎ জোড়া মুসলমানদের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে হবে এবং যে নিন্দনীয় ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে তার মধ্যে নিকৃষ্টতম বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার আত্মঘাতী বিমান হামলা। ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল-কায়েদা নির্লজ্জতা ও আত্মম্ভরিতার সঙ্গে এর দায়ভার গ্রহণ করে। ওসামা বিন লাদেনের স্রষ্টা কারা, অনুপ্রেরক ও পৃষ্ঠপোষক কারা এটাও বিশ্ববাসীর অজানা নয়। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ সব সময় করেছে, করছে এবং করবে ইনশাল্লাহ। আল কোরআন এবং কোরআনের জীবন্ত দৃষ্টান্ত হজরত মুহাম্মদ (সা.) সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে কখনো প্রশ্রয় দেননি। এর ভূরি ভূরি উদাহরণ না দিয়ে একটিমাত্র দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই। ওহুদের জিহাদের সময়কালে নবী (সা.) কাফেরদের প্রস্তুতি নিরূপণের জন্য একজন বিশ্বস্ত সাহাবাকে গুপ্তচর হিসেবে রেকি করতে পাঠিয়েছিলেন। সে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্ভাব্য সব তথ্য সংগ্রহ করে নবী (সা.) এর কাছে পেশ করার পর শিশুর মতো কাঁদতে থাকে। তার কান্নার কারণ জানতে চাইলে, সে বিলাপ করতে করতে বলল, কাফেরদের প্রধান আবু জেহেলকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় গভীর নিদ্রারত পেয়েও হত্যা না করে ফিরে এসেছি। নবী (সা.) তাকে বললেন, আবু জেহেলকে হত্যা না করায় তোমার ভুল হয়নি বরং নিরস্ত্র নিদ্রারত আবু জেহেলকে হত্যা করলে তুমি জাহান্নামি হতে। বোধ করি এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, জঙ্গি-সন্ত্রাস তো বটেই একটি নিরস্ত্র মানুষ, সে যত বড় শত্রুই হোক না কেন; তাকে অস্ত্রাঘাত করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা জাতি অবহিত, হলি আর্টিজান এবং শোলাকিয়ার ঘটনায় যারা জড়িত তারা প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমি নিশ্চিত, ওই যুবকদের পার্থিব জীবনে প্রচণ্ড হতাশা জড়িয়ে ছিল। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ঘটনাচক্রে তারা জড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে। সেখানে তাদের মগজ ধোলাই করা হয়— জঙ্গি সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানুষ মারতে পারলে বেহেশত অনিবার্য। একে তো হতাশা, অন্যদিকে পরকালে বেহেশতের হাতছানি তাদের অন্ধ করে ফেলে। হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি আক্রমণকারীদের সম্পর্কে গণমাধ্যমে দেখে আমার ধারণা হয়েছে— জঙ্গিরা নামাজ পড়ত কি না, রোজা রাখত কি না, জাকাত দিত কি না তা সন্দেহজনক। ধনী পরিবারের সদস্য হওয়ার পরও কেউ তো হজ করেনি। এসব প্রশ্ন মানুষের মনকে এতটাই নাড়া দিয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ তাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরা শুধু অনুতপ্তই নন, জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

এই ঘোর দুর্দিনেও আমি আল্লাহর প্রতি শোকর আদায় করি, সেদিন চেকিং পয়েন্টে জঙ্গিরা ধরা না পড়লে এবং শোলাকিয়ার ঐতিহাসিক ঈদগাহের জামাতে নাশকতায় সক্ষম হলে লাখো লাখো আতঙ্কিত মুসল্লির হাজার হাজার মুসল্লি পদপিষ্ট হয়েই ইন্তেকাল করতেন।

বাংলাদেশের আমজনতা, যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘোর-প্যাঁচগুলো উপলব্ধি করতে পারেন না এই আইএস আজকের আল-কায়েদার মূল পৃষ্ঠপোষক ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, এখন যার প্রধান ইয়োসি কোহেন এবং তার পূর্বসূরি তামারো পার্দো। হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন এই আত্মঘাতী সংগঠনগুলো গড়ে তুলতে এবং পরিচালনা করতে। এর প্রমাণার্থে আমি একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে চাই। কেজিবি প্রধান মিকাইল গর্বাচেভ (যিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন) তিনি সিআই-এর বেতনভুক্ত স্থায়ী এজেন্ট ছিলেন। রাশিয়ার প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিচার ব্যবস্থাকে তিনি সম্পূর্ণ বিকলাঙ্গ করে দেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায় এবং প্রশাসন খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন মাফিয়াদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পরবর্তীতে বরিস ইয়েলতসিন গর্বাচেভের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারলেও সোভিয়েত ইউনিয়নকে তো একত্রিত রাখতে পারেননিই বরং সেদিন থেকে আজকের পুতিন পর্যন্ত প্রশাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেননি, এটাও সিআই-এর কর্মকৌশলেরই ফলশ্রুতি। আজকে পুতিন আমেরিকার হাতের পুতুল মাত্র। যদিও ছোটখাটো কূটনৈতিক বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে, বোধকরি এটিও লোক দেখানো।

এবার পুনরায় দেশের কথায় আসা যাক। আমি এর আগে একটি নিবন্ধে এই বাংলাদেশ প্রতিদিনেই লিখেছিলাম— ‘সন্ত্রাস দমনে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নাই’। বাংলাদেশে সংঘটিত বীভৎস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর আমার ধারণা হয়েছিল, আতঙ্কিত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা ও বিশ্ব জনমতকে আতঙ্কের আবর্তের বাইরে আনার জন্য সরকারি জোট নিঃস্বার্থভাবে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু আশ্চর্যান্বিত ও বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করলাম, এখন পর্যন্ত সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি! 

হলি আর্টিজানে উদ্ধার অভিযানে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো পাঠকের জানাই আছে। এমনকি উদ্ধারকাজে বিলম্বের জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কোনো কর্মকর্তাও নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন। থাক সে কথা। এই নৃশংস ঘটনার পর সরকারের তরফ থেকে সব রাজনৈতিক দলমত, সুশীল, সমাজ, বুদ্ধিজীবী সবাইকে নিয়ে জঙ্গি দমনের লক্ষ্যে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো আন্তরিক উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে না তা ভেবে বিস্মিত ও আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি। সরকারি জোটকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, দেশের জনগণ আজ আতঙ্কিত। গণতন্ত্র তো অনেক আগেই মৃত। সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাও আজ বিপন্ন। সব রাজনৈতিক জোটের কাছে অনুরোধ, বিদেশি কূটনীতিক বা বিশেষজ্ঞ যারা আসছেন, তাদের কাছে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার না করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান রেখে কথা বলুন। 

বিএনপি এতটাই বিকলাঙ্গ, মেরুদণ্ডহীন ও জনগণ থেকে সম্পর্কবিচ্যুত যে, প্রথমদিকে তাদের দুটি কার্যালয় থেকে তারা ঐক্যের কথা বললে (সংবাদ মাধ্যমগুলো তাদের কোনোরকমে জিইয়ে রেখেছে) দুয়েকদিন পরই তারা থলের বিড়াল আর থলের মধ্যে রাখতে না পেরে মধ্যবর্তী নির্বাচন চেয়ে বসলেন! খালেদা জিয়া এই ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে খুব লম্ফ-ঝম্প করছেন। উনি কি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ৬৩ জেলার ৫০০ স্থানে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ এবং দেশের অভ্যন্তরে ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র চালানের কথা একদমই ভুলে গেছেন। ধিক্ তাদের এই নির্লজ্জতাকে, ধিক্ তাদের ক্ষমতায় আসার এই হীন প্রবণতাকে!

আমেরিকা, জাপান ও ভারত জঙ্গি দমনে বাংলাদেশকে সক্রিয় সমর্থন দেওয়ার নানা প্রস্তাব দিচ্ছে। প্রস্তাবগুলো বর্জনীয় যেমন নয়, সূক্ষ্ম, দক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এবং দেশের সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রেখে যতটুকু গ্রহণ করা সম্ভব, অবশ্যই তা নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক বিষয়ে আমার পরামর্শ, বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পুলিশ ও র‌্যাবের। তাদের কৌশলগত উন্নয়ন ও আরও উন্নততর প্রশিক্ষণ দরকার এবং অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আরও মজবুত হওয়া প্রয়োজন। উনাদের মধ্যে বিবৃতি ও বক্তৃতার অসংলগ্নতা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। রাজনীতিবিদদের মতো বক্তৃতা, বিবৃতি কৌশলগত বিবেচনায় অনভিপ্রেত।

যেটুকু জনগণের জানা দরকার সেটুকু লিপিবদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিলে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেটি গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করবেন। নিবন্ধটির সারকথা হলো, দেশ আজ এমন একটি ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে, যা বিগত ৪৬ বছরে কখনো হয়নি। এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলীয় চিন্তা, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা অথবা ক্ষমতায় আসা, দলীয় সংকীর্ণতার আবর্ত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা আগুন নিয়ে খেলার মতোই ভয়ঙ্কর হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে আমার বিনম্র অনুরোধ, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সময় এটা নয়। জাতি এখন মহাদুর্যোগে নিপতিত। তাই দলীয় সংকীর্ণতার আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে দেশের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার খাতিরে ন্যূনতম দেশপ্রেমের পরিচয় দিন। এর ব্যত্যয় হলে যে মারাত্মক পরিণতি আসবে, তা থেকে কেউই রেহাই পাবেন না। ইতিহাস একদিকে যেমন নিষ্কলুষ, অন্যদিকে দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তেমনি নির্মম ও নিষ্ঠুর।

লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর