অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে দেশ, শিক্ষার হার বাড়ছে। সার্বিকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার মানও বাড়ছে। কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক অঙ্গনে অশান্তি এবং অস্থিরতাও বাড়ছে সমানতালে। শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে সততা। আপাত ভদ্রলোক বাড়ছে, কমছে নিখাদ ভালো মানুষ। জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে ভালো মানুষ। আইন কঠোর হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও বাড়ছে; কমছে না অপরাধপ্রবণতা। মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে জ্ঞান করতে না পারলে স্বাভাবিক নিয়মেই হারিয়ে যায় মানবিক মূল্যবোধ। চলে যায় প্রেম, ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতা। নষ্ট হয় শান্তি-শৃঙ্খলা। শুরু হয় মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি। বর্তমান বিশ্বে যা হরহামেশাই ঘটছে। পত্রিকা ও টেলিভিশনের সংবাদ মানেই হত্যা, ধর্ষণ, গুম, খুন, রাহাজানি আর হানাহানি। চারদিকের অবস্থা পর্যালোচনা করলে মনে হয়, মানুষ এখন আর ভালো নেই। অবাক করা ব্যাপার হলো এতকিছুর পরও মানুষ দিব্যি ভালো আছে। কেন যেন মানুষের মাঝে মানুষের জন্য আফসোস নেই মমতা নেই; বুঝতে পারছি না। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ঠিকই বলেছেন। ‘মানুষ সামাজিক জীব নয় ব্যক্তিগত জীব। একশ মানুষের প্রাণহানির চেয়ে ব্যক্তিগত একশ ডিগ্রি জ্বর বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ বর্তমান সময়ের চিত্র তুলে ধরে হুমায়ূন আহমেদ লেখেন, ‘মানুষের দুরবস্থা এখন আর আমাদের আহত করে না। লঞ্চ ডুবে কিংবা বাস এক্সিডেন্টে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা দেখে আমরা শুধু ‘আহ’ বলে অন্য চ্যানেলে চলে যাই।’ এটি কখনোই প্রকৃত মুসলমানের চরিত্র হতে পারে না। প্রকৃত মুসলমান হতে হলে খোদার প্রতিটি সৃষ্টির জন্য হৃদয়ে দরদ থাকতে হবে। আত্মায় মানবতা থাকতে হবে। মানুষের দুঃখে দুঃখী হতে হবে। পল্লী কবি জসীমউদ্দীন চমৎকারভাবে বলেছেন,
‘সবার সুখে হাসব আমি
কাঁদব সবার দুঃখেনিজের খাবার বিলিয়ে দেব
অনাহারীর মুখে।’
এই যে আমরা একের দুঃখে অন্যে দুঃখী হই না, এ জন্য আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে এখন অশান্তির আগুন জ্বলছে প্রত্যেক মানব হৃদয়ে। অবস্থা এমন হয়েছে, প্রকাশ্য দিবালোকে পাঁচজন মানুষ যখন একজন মানুষকে ছিনতাই করে তখন রাস্তার পাঁচ হাজার মানুষ নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত থাকে। অথচ দশজনও যদি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করত তবে দুষ্কৃতকারীরা পালানোরও জায়গা পেত না। বলছিলাম, শুধু নিজেকে বাঁচালেই চলবে না, প্রত্যেককে নিয়ে ভাবতে হবে। তাদের জন্য কাজ করতে হবে। এ ভাবনা আর এ কাজই মুসলমানদের নামাজ, রোজার পাশাপাশি পালন করতে হবে। বুঝতে হবে সকাল-বিকাল মসজিদে দৌড়ালেই ইবাদত হয় না। মানবতার কল্যাণে কাজ করাও ইবাদতের অংশ।
মানুষের কল্যাণে নিজকে নিয়োজিত রাখাই প্রকৃত ধর্ম ও ধার্মিকের কাজ। সহিহ মুসলিম থেকে দুটি হাদিস শোনাচ্ছি। হজরত তামীম দারী (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আদদ্বীনুন নাসিহা- অর্থাৎ ধর্ম হলো মঙ্গল কামনা করা।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! কার জন্য মঙ্গল কামনা করব?’ রসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ, কিতাব ও রসুলের প্রতি ইমানের ব্যাপারে মঙ্গল কামনা করবে। আর প্রত্যেক মুসলমান, সাধারণ ও নেতাদের জন্য কল্যাণ কামনা করবে।’ (মুসলিম।)। জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমি রসুল (সা.) এর কাছে নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদয় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কল্যাণ কামনা করার বাইয়াত-অঙ্গীকার করেছি।’ (মুসলিম।)।
যখন ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর জাগতিক স্বার্থ, বৈষয়িক উন্নতির চিন্তা প্রাধান্য পায়, তখনই মানুষের আত্মা থেকে পরকালে জবাবদিহির ভয় কমে যায়। এমন অবস্থায় মানুষ কেবল পাপাচারেই জড়িয়ে পড়ে না, মানবিক বোধটুকুও হারিয়ে ফেলে। বস্তুত পরকালের ভাবনা মানুষের কুপ্রবৃত্তি তথা নফসকে নিয়ন্ত্রণে করে। মানুষের ভিতর সুপ্রবৃত্তি ও সৎ গুণাবলি জাগিয়ে তোলে। যার ভিতর আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয় কিংবা পরকালের ভাবনা কাজ করে না, তাকে আইন দিয়ে নিবৃত্ত রাখা যায় না। মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে যুগে যুগে ধর্ম ও কল্যাণকামী মানুষের বড় ভূমিকা ছিল। ধর্মীয় অনুশাসনই মানবিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সব যুগে সাহায্য করেছে।
পবিত্র কোরআনে মানবিক মূল্যবোধের বিপর্যয় রোধে মুসলমানকে ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান এভাবে করা হয়েছে— ‘ওয়াদাল লাজিনা আমানু মিনকুম ওয়া আমিলুস সোয়ালিহাতি লা ইয়াসতামলি কান্নাসুম ফিল আরদ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তোমরা নেক কাজ করলে দুনিয়ার কর্তৃত্ব তোমাদের দেওয়া হবে।’ দুনিয়াজুড়ে মুসলমানদের সামগ্রিক বিপর্যয় রোধে কোরআনের বিধান ভালো করে বুঝতে এবং মানতে হবে। সত্যবাদিতা, সহিষ্ণুতা, মাধুর্যতা, তীক্ষ মেধাশক্তি ও শিষ্টাচারের মাধ্যমে মুসলমান একবিংশ শতাব্দীর অগ্রযাত্রায় নেতৃত্বের ভূমিকা নেবে। আল্লামা ইকবাল লেখেন, ‘সবক পড় ফের সাদাকাত কা ইতা আতকা আমানত কা কাম লিয়া যায়ে তুঝছে সারে দুনিয়া কি ইমামত কাণ্ড।’ অর্থাৎ সত্যনিষ্ঠা, আনুগত্য আর আমানতের সবক শিখে নাও, তবেই সারা দুনিয়ার নেতৃত্ব তোমাদের হাতের মুঠোয় আসবে।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
www.selimazadi.com