বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম খাত চিংড়ি। কিছুদিন আগেও রপ্তানি পণ্য হিসেবে চিংড়ি পোশাক খাতের পরে অর্থাৎ দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর থেকে ২০২০-২০২১ পর্যন্ত চিংড়ি রপ্তানির চিত্রে দেখা যায়, প্রতি বছর বিশ্ববাজারে চিংড়ি রপ্তানি কমছে। মৎস্য অধিদফতর ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ৫৫ কোটি মার্কিন ডলার, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে প্রায় ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩৬ কোটি মার্কিন ডলার এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রায় ৩৩ কোটি মার্কিন ডলার চিংড়ি খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে।
অথচ বিশ্ববাজারে ক্রমেই চিংড়ির চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে চিংড়ির বৈশ্বিক বাজার ৩২.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক চিংড়ির বাজার ইকুয়েডর ও ভারতের দখলে। দেশ দুটি যথাক্রমে বৈশ্বিক চাহিদার ২৩.৯ শতাংশ ও ২৩.৫ শতাংশ বাজার দখল করে আছে এবং এর সিংহ ভাগই ভেনামি চিংড়ি। অন্যদিকে বাংলাদেশের দখল কমে ১.৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় এই খাতটি কেন দিন দিন মুখ থুবড়ে পড়ছে?
দীর্ঘদিন একই জাতের চিংড়ি চাষের ফলে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রকোপে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত কয়েক বছরে দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ নদীর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে চিংড়ি ঘেরগুলোতে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির কারণে লবণাক্ততার তারতম্য, পানিপ্রবাহের মাত্রা কমে যাওয়ায় নদী থেকে যথাযথ পরিমাণে পোনা আহরণ করতে না পারা, এ ছাড়া হ্যাচারি থেকে যেসব পোনা পাওয়া যায়, তার অধিকাংশরই গুণগত মান ভালো নয়; সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এত বছরেও আমাদের দেশে চিংড়ি চাষ পদ্ধতির উন্নতি হয়নি। অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে এক সময় রাজত্ব করা বাগদা ও গলদা চিংড়ির বাজার দখল করে নিয়েছে ‘ভেনামি চিংড়ি’ বা প্যাসিফিক হোয়াইট-লেগড শ্রিম্প। উচ্চ ফলনশীল এবং দাম কম হওয়ায় হাইব্রিড জাতের এই চিংড়ি চাষ করে ইতোমধ্যে ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। ২০১৯ সালে ভারত মাত্র ১৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ভেনামি চিংড়ি চাষ করে রপ্তানি আয় করেছে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক বাজারের ২৪ শতাংশ। এই জাতের চিংড়ি চাষ করে এত বিপুল আয় করেছে ভারত। পক্ষান্তরে ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করে ২০২০ সালে বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র ০.৩৩ বিলিয়ন ডলার। চিংড়ির একটি উচ্চফলনশীল জাত হচ্ছে ভেনামি। এটি পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের একটি প্রজাতি। অধিক উৎপাদনের পাশাপাশি এর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার জন্যও এটি এখন সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে উৎপাদিত চিংড়ির ৮০% ভেনামি।
দেশে ভেনামি চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয় ২০১৯ সালে। চার বছর ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০২৩ সালে এ চিংড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর অনুমতি দেয় সরকার। কক্সবাজারের উখিয়ায় সিমার্কের স্বত্বাধিকারী ইকবাল আহমেদ ২০২৩ সালেই ভেনামি চাষের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির খামার প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছর এপ্রিলে প্রথমবারের মতো ভেনামি চিংড়ির পোনা ছাড়েন শতভাগ নিয়ন্ত্রিত পুকুরে। গত সপ্তাহে বাজারজাতকরণ উপযোগী চিংড়ির আহরণ করা হয়। সে সময় তার খামারটি ঘুরে দেখে আসার সুযোগ হয়েছে আমার। ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগে উদ্যোক্তা ইকবাল আহমেদ ১২ একরের খামারটিতে যুক্ত করেছেন আধুনিক সব প্রযুক্তি।
সনাতন পদ্ধতিতেও ভেনামি চিংড়ি চাষ করা যায়। তবে পরিবেশ ও রপ্তানি বাণিজ্যের কথা মাথায় রেখেই সুপার ইনটেনসিভ বা অতি নিবিড় পদ্ধতিতে ভেনামি চাষ করছে সিমার্ক। ইকবাল আহমেদ বললেন, এই পদ্ধতিতে প্রতি বর্গমিটারে ৩৩০টি চিংড়ি চাষ করা সম্ভব, যেখানে সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ পাঁচটি চিংড়ি চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে চিংড়ির জীবিত থাকার হার প্রায় ৯০ শতাংশ। ঘের বা সনাতন উপায়ে খামারে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ৪০০ থেকে ৫০০ কেজির মতো বাগদা চিংড়ি পাওয়া যায়। অতি নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ৮০ থেকে ১০০ টনের মতো ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব হবে। অর্থাৎ ভেনামির উৎপাদনের হার অনেক বেশি। ফলে উৎপাদন খরচ কমে আসে।
খামারে শতভাগ জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। রেণু থেকে পরিণত চিংড়িতে রূপান্তরে এখানে অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়। এজন্য এখানে আছে তিনটি কালচার পুকুর, ৩২টি নার্সারি পুকুর ও ১৬টি কোয়ারেন্টিন পুকুর। বিদেশ থেকে রেণু আনার পরে নার্সারি পুকুরে তা ১৫ দিন লালন-পালন করা হয়। এরপর সেগুলো দেওয়া হয় কালচার পুকুরে। পরে ৬০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে সেই চিংড়ি বিক্রির জন্য পুকুর থেকে তোলা হয়। সারা বছর চিংড়ি উৎপাদন নিশ্চিত করতে তৈরি করেছেন গ্রিনহাউস।
এ ছাড়াও খামারের পানি ও চিংড়ির ফিজিকো কেমিক্যাল ও মাইক্রো বায়োলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য রয়েছে একটি আধুনিক ল্যাবরেটরি। এটি পরিচালনার দায়িত্বে আছেন প্রতিষ্ঠানটির মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ।
ভেনামি অনেকটা ব্রয়লার মুরগি বা উচ্চফলনশীল ধানের মতো। যেহেতু দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে পৃথিবীর জনসংখ্যা, পাশাপাশি বাড়ছে চিংড়ির চাহিদাও আবার তৈরি হচ্ছে জমির সংকট, তাই এমন উচ্চ ফলনশীল চিংড়ি চাষের গুরুত্ব উপলব্ধি করছেন এ শিল্পের সঙ্গে প্রায় ২৫ বছর ধরে সম্পৃক্ত ইকবাল আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ দিন দিন কমছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানগুলো আবার চালু করা সম্ভব। আমাদের প্রতিবেশী ভারতও ভেনামি চাষে ইতিমধ্যে বেশ এগিয়ে গেছে। এখনো যদি আমরা শুরু করতে পারি, তাহলে বৈশ্বিক বাজার ধরতে পারব। তবে শুধু দু-চারজন চাষ করলে হবে না। এজন্য সরকারের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের সহযোগিতা পেলে ও চাষিরা বৈজ্ঞানিক চাষে উদ্বুদ্ধ হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ খাতে রপ্তানি আয় ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’
আন্তর্জাতিক বাজারে টিকতে হলে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। চিংড়ি উৎপাদনকারী অন্যদেশগুলো যেখানে ভেনামি চিংড়ির মাধ্যমে বাজারের বড় অংশ দখল করে নিয়েছে, সেখানে আমরা চিংড়ি উৎপাদন থেকে শুরু করে রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছি প্রতিনিয়ত। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে উৎপাদন যেমন বাড়াতে হবে, ভাবতে হবে পরিবেশের কথাও। আমাদের ঐতিহ্যবাহী দেশীয় জাতগুলোকে যেমন সংরক্ষণ করতে হবে। তেমনি মাথায় রাখতে হবে ক্ষুদ্র চিংড়ি চাষিদের স্বার্থও।
আর এর জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী গবেষণা ও পরিকল্পিত নীতিমালা। আমাদের বিশ্বাস সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে সাদা সোনাখ্যাত চিংড়ির রপ্তানি বাণিজ্যের সুনাম পুনরায় ফিরে পাবে। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব