মানুষ সামাজিক প্রাণী-জীব, সমাজে থাকতে সে বাধ্য, পদে পদে ধাপে ধাপে প্রয়োজন অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থন, এমনকি বিশাল সম্পদ-প্রাচুর্য থাকলেও অন্যের সাহায্য-সহায়তার প্রয়োজন হয়। পারস্পরিক সহায়তা-সহানুভূতি, কল্যাণ কামনা ও সম্প্রীতি-ভালোবাসার চেতনা সামাজিক প্রয়োজন-চাহিদা পূরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই মানুষ যে অন্যের কল্যাণ কামনা করে এবং সহানুভূতি করে।
রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সমগ্র জীবনই ছিল মানবসেবার মহান দৃষ্টান্ত। নবুওয়াতের আগে তিনি সোসাইটি-সমাজের খেদমত-সেবা, অসহায়-অভাবীদের সাহায্য-সহযোগিতা এতিম-গরিবদের প্রতি সহায়তা-সহানুভূতি ও দুস্থদের দায়িত্ব-উদ্বেগ গ্রহণসহ বহু জনকল্যাণ কাজের জন্য ছিলেন সুপরিচিত-প্রসিদ্ধ। নবুওয়াত লাভের পর মানবতার জন্য তাঁর অনুগ্রহ ছিল নজিরবিহীন। সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মানবতার জন্য। তিনি শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে সবার জন্য। সংগত কারণেই গোটা জাতির প্রতি ছিল তাঁর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, মায়া-মমতা এবং ইহকাল-পরকালের মুক্তির জন্য ছিল তাঁর অক্লান্ত সংগ্রাম-প্রচেষ্টা। তাই আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য তাঁর উত্তম আদর্শের অনুসরণ করা ও মানবসেবাকে নিজেদের জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নেওয়া।
যখন সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হলো। জিবরিল আমিন তিন তিনবার রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বুকে জড়িয়ে চাপ দিলেন। শোনালেন ওহির বাণী পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। কাঁপতে কাঁপতে রসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে এলেন। পুরো ঘটনা খুলে বললেন উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজা (রা.)-কে। তখন উম্মুল মুমিনিন যে কথাগুলো বলে রসুলুল্লাহকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন তা ছিল, কখনো নয়! খোদার কসম, আল্লাহতায়ালা আপনাকে কখনো বিব্রত করবেন না। আপনি আত্মীয়তা রক্ষা করেন, দুস্থের ভার বহন করেন, নিঃস্বর জন্য উপার্জন করেন, মেহমানের সমাদর করেন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে (মানুষ) সহযোগিতা করেন। (বুখারি-০৩; মুসলিম-১৬০)। বোঝা গেল দুস্থ-দুর্বলের দায়িত্ব গ্রহণ করা, নিঃস্ব-অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের সহযোগিতা করা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত। অপর বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো এক সময় রসুলুল্লাহ (সা.) বসে থাকা কয়েকজন লোকের পাশে এসে বললেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম কে এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট কে? তা কি আমি তোমাদের অবহিত করব না? বর্ণনাকারী বলেন, সবাই চুপ করে রইল। তারপর তিনি ওই কথা তিনবার জিজ্ঞেস করেন। তারপর এক ব্যক্তি বলল, জি, হে আল্লাহর রসুল, আমাদের জানিয়ে দিন, কে আমাদের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম এবং কে সর্বাধিক নিকৃষ্ট। তিনি বললেন, সেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম যার কাছে কল্যাণ কামনা করা যায় এবং যার ক্ষতি হতে মুক্ত থাকা যায়। আর সেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট যার কাছে কল্যাণের আশা করা যায় না এবং যার ক্ষতি হতেও নিরাপদ থাকা যায় না। (তিরমিজি-২২৬৩)
আল্লাহতায়ালা মানবসেবাকে সৃষ্টিকর্তার সেবা বলেছেন। সহিহ মুসলিম শরিফে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কেয়ামত দিবসে আল্লাহতায়ালা বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি আমার সেবা-শুশ্রƒষা করনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আপনি তো বিশ্ব পালনকর্তা, কীভাবে আমি আপনার সেবা-শুশ্রƒষা করব? তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, তাকে তুমি দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না, যদি তুমি তার সেবা-শুশ্রƒষা করতে, তার কাছেই আমাকে পেতে। আল্লাহতায়ালা বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাওনি? বান্দা বলবে, হে আমার রব! আপনি হলেন বিশ্ব পালনকর্তা, আপনাকে আমি কীভাবে আহার করাব? তিনি বলবেন, তুমি কি জান না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, তুমি খাবার দাওনি। তুমি কি জান না, তুমি যদি তাকে আহার করাতে, আজ আমার কাছ থেকে এর পরিপূর্ণ বিনিময় পেতে।
আল্লাহতায়ালা বলবেন, হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে পানীয় দাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু! আপনি তো রব্বুল আলামিন, আপনাকে আমি কীভাবে পানীয় দেব? তিনি বলবেন, তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানীয় চেয়েছিল, তাকে তুমি পানীয় দাওনি। তাকে যদি পানীয় দিতে, আজ আমার কাছ থেকে পরিপূর্ণ বিনিময় পেতে। (মুসলিম-২৫৬৯)
রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে আহারে পরিপূর্ণ অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত সে মুমিন নয়। আজ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যার কারণে বহু মানুষ নানা সমস্যায় ভুগছেন, এহেন বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে একে অপরের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসা একান্ত কর্তব্য হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর এই সংক্ষিপ্ত জীবনে আমরা যদি সৃষ্টির সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসি, তবে পরকালের অনন্ত জীবনে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আমাদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসবেন।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, মদিনাতুল উলুম মাদরাসা, বসুন্ধরা, ঢাকা