বইটির নাম ‘প্রেসিডেন্ট জেনারেল ও আমি’। লেখক আবু রুশ্দ, যিনি সেনা কর্মকর্তা থেকে সাংবাদিকতায় আসেন এবং এখন একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তরুণ সেনা কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকতায় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে যাদের কাছ থেকে দেখেছেন, সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের অনেকেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছেন। ইতিহাসের অংশ হয়েছেন। অনেক বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক আবু রুশ্দ। সেসবের মধ্য দিয়ে সমকালে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিকসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে-যা অনেক ক্ষেত্রে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা হিসেবে ডাকসাইটের সব সেনা কর্মকর্তার কাছে পৌঁছানো এবং তাদের সস্নেহ সান্নিধ্য পাওয়া সহজ হয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে তিনি তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারও করেছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। এতে দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও প্রস্তুতি এবং দেশ-জাতি-রাজনীতি নিয়ে সেনা-ভাবনা ফুটে উঠেছে সাবলীল ভাষাভঙ্গিতে। এসব কারণেই বইটি বিশেষ মর্যাদা দাবি করে। এ কৃতিত্ব লেখকের। এখানে এ বইয়ের তাৎপর্যপূর্ণ ও সংবেদনশীল কিছু অংশ তুলে ধরছি- যা বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের বর্ণাঢ্য বৈশিষ্ট্য এবং ভাবনার গভীরতার সাক্ষ্য দেবে। গল্পের ধাঁচে লেখা ঝরঝরে গদ্য পাঠকদের বইটির শেষ পাতা পর্যন্ত টেনে নেবে আশা করি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গ : কমব্যাট ড্রেস পরা লে. জেনারেল জিয়া এসে দাঁড়ালেন শ্রেণিকক্ষের দরজায়। তার চোখে সেই ডার্ক গ্রিন বিখ্যাত রেবান সানগ্লাস। হাতে ব্যাটন। ছাত্রদের দিকে আঙুল তুলে শিক্ষককে বললেন, এদের কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। সেভাবে তৈরি করুন। তারপর হাতের ব্যাটন কপালে ছুঁইয়ে সালাম দিয়ে চলে গেলেন হ্যামিলনের বংশীবাদক লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান। যেন তার সম্মোহনী সুরের রেশ ছড়িয়ে রইল বহুক্ষণ।
প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ : লেখক বলছেন, ২০০৪ সালের কথা। সেদিন পত্রিকায় আমার একটা রিপোর্ট লিড নিউজ আকারে প্রকাশ হয়েছিল। শিরোনাম ‘বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ’। সকালে জেনারেল এরশাদের ফোনে ঘুম ভাঙে। তিনি বললেন, তুমি যা লিখেছ তাই ঘটছে। সে সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার না পারছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে, না ছিল মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা। দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মিত্র চীনকে ভীষণ ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল ঢাকায় তাইওয়ানের ভিসা ইস্যুর অনুমোদন দিয়ে। ভারতের সঙ্গে ছিল না কোনো বাস্তবসম্মত কূটনীতি।
লে. জেনারেল এম আতিকুর রহমান : একটা পুরনো কিন্তু চকচকে টয়োটা কার এসে পাশে ব্রেক চেপে দাঁড়াল। ব্রিটিশ মডেলের গাড়ির কাচ নামিয়ে একজন জিজ্ঞেস করলেন, রুশ্দ হোয়াট আর ইউ ডুইং হেয়ার? দেখি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আতিক। সালাম দিয়ে বললাম, স্যার একটা কাজে এসেছিলাম। কুশলাদি বিনিময় শেষে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলাম- স্যার, আপনি এত আগের মডেলের গাড়ি এখনো চালাচ্ছেন? স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি বললেন, কেন, গাড়িটা তো এখনো ভালোই চলছে। কোনো অসুবিধা তো নেই। নতুন গাড়ি কিনতে হবে কেন? ‘ডিগনিটি আর অনার’ একজন সৈনিকের সবচেয়ে বড় মর্যাদা। তার জন্য শো-অফের প্রয়োজন হয় না।
লে. জেনারেল মীর শওকত আলী : সাক্ষাৎকারে বলেন, যে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। এজন্য একটা প্রতিরক্ষা মতবাদ প্রণয়ন করা হয়। তবে আগ্রাসন প্রতিহত করার অর্থ শুধু এই নয় যে, এক দেশের আর্মি অন্য দেশ আক্রমণ করবে এবং আক্রান্ত দেশ তার সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে সেটা প্রতিরোধ করবে। আগ্রাসন শুধু সামরিক খাতে নয়, হতে পারে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও। তাই প্রতিরক্ষা শুধু আর্মি দিয়ে হবে না। এজন্য রাষ্ট্র ও সমাজের সব পর্যায়েই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মেজর জেনারেল সাদেকুর রহমান চৌধুরী : তার একটা হুন্দাই পনি গাড়ি ছিল। স্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই বিকালে বের হতেন। তার স্ত্রী পুরো গ্যারিসনের ব্যাচেলর অফিসারদের জন্য মাসে একটা করে পার্টি দিতেন লেডিস ক্লাবের পক্ষ থেকে। বিবাহিত অফিসারদের মিসেসরা বিভিন্ন রকমের খাবার রান্না করে নিয়ে আসতেন। তারা স্মার্ট ছিলেন কিন্তু কেউ পটের রানি সেজে থাকতেন না। এটাই ছিল তাদের অভিজাতের প্রকাশ।
মেজর জেনারেল আবদুস সামাদ : সাক্ষাৎকারে বলেন, সামরিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় অর্থাৎ সব সেক্টরে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা মোকাবিলার লক্ষ্যে আমাদের প্রস্তুতি অর্থাৎ প্রতিরক্ষা মতবাদ থাকতে হবে।
লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান : সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বলা আছে, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’। তাই আমরা কোনো আগ্রাসি মনোভাব নিয়ে সশস্ত্র বাহিনী গঠন করব না। কিন্তু আক্রান্ত হলে নিজেদের রক্ষার জন্য একটি কার্যকর, শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী অবশ্যই গড়ে তুলব। আমরা রক্ষণাত্মক ভূমিকা নিলেও আমাদের প্রতিরক্ষা হবে সক্রিয় ‘অফেন্সিভ ডিফেন্স।’
মেজর জেনারেল এম এ মতিন : সশস্ত্র বাহিনীর উঁচু পেশাদারিত্ব বজায় রাখার জন্য তার অভিমত হলো, যে কোনো মূল্যে রাজনীতির বাইরে থাকা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও তিনি রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী। তিনি মনে করেন, এসব করে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে।
মেজর জেনারেল এম এ হালিম : তার শানিত, তীক্ষ্ণ অমর উক্তি, ‘কোনো কিছু লেখার আগে ১০ বার ভাববে।’
মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান : ১৯৯৫ সালের ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের রিসেপশন। ভিভিআইপি এলাকায় দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা বসেছেন। সবার দৃষ্টি সেদিকে। জেনারেল ইমাম বললেন, দেশের মানুষ বড় দুই দলকে দেশের স্বার্থে সহনশীল দেখতে চায়। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও জাতীয় ইস্যুতে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ কামনা করে। তিনি দুই নেত্রীর পাশাপাশি বসা ছবি সব প্রভাবশালী দৈনিকে গুরুত্বপূর্ণভাবে ছাপার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান। এমন অনেক দেশপ্রেমী দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বের সংবেদনশীল অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে। যেন অসংখ্য মণিমুক্তা ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সবুজ ঘাসের জমিনে। এদের অনেকেই বেঁচে নেই। কেউবা অবসরে। কিন্তু তাদের অনেক কথাই আজও প্রাসঙ্গিক। এ বই সে কারণে প্রাজ্ঞজন মহলে বহুল পঠিত হবে- এটাই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। তবে বইটি আরও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সুসম্পাদিত এবং নির্ভুল বানানে ছাপা বাঞ্ছনীয় ছিল। আর লেখকের কথায়, ‘আমি মিডিয়া জগতে প্রতিরক্ষা সাংবাদিকতার জন্ম দিই নব্বই দশকের শুরুতে’- সত্য হলেও এ বাক্য এড়িয়ে গেলে শোভন হতো।
লে. জেনারেল এম আতিকুর রহমানকে উৎসর্গ করা, ‘প্রেসিডেন্ট জেনারেল ও আমি’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩-এর নভেম্বরে। প্রচ্ছদ শিল্পী : রাইশা জেসমিন রাফা। প্রকাশক : বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল পাবলিশিং। দাম : ৪০০ টাকা।