স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন, ল্যারি ডায়মন্ড থেকে শুরু করে অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেন, একটি দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য বিদ্যমান সব পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ও ঐক্য জরুরি। বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসনের পর নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য এটা আরও বেশি জরুরি। একটি দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নির্ভর করে সেখানকার রাজনৈতিক দল ও সমাজের অন্যান্য অ্যাক্টরগুলোর ভূমিকার ওপর।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আমলাতন্ত্র থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠানে স্বৈরশাসক একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল। অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং সব প্রতিপক্ষকে শক্ত হাতে দমনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা একজন স্বৈরশাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। একটা সময় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করত আর যাই হোক, শেখ হাসিনাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব নয়। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হয়েছে? এটি সম্ভব হয়েছে গণতন্ত্রের পক্ষের সব শক্তির মধ্যে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐকমত্য। বিভিন্ন পথ ও মতের মানুষের সম্মিলনে দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ছাত্রদের নেতৃত্বে এ আন্দোলনে শামিল হয়েছে দেশের সর্বস্তরের জনগণ। এ ঐকমত্যের কারণেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু হতাশার বিষয় হলো- ফ্যাসিবাদী সরকারের বিদায়ের পর বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পুরনো বিভাজন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো গণ অভ্যুত্থানে তাদের অবদান প্রমাণ করতে ব্যস্ত। তাছাড়া গণ অভ্যুত্থানের নিজেদের ভূমিকার কথা বলে দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মাঠ দখলেরও প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সফলতা কিংবা রাজনৈতিক ময়দানে টিকে থাকার প্রশ্নে এক দল আরেক দলের বিপক্ষে নানা ধরনের বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছে। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় সবার মধ্যে ঐকমত্য থাকলেও ইদানীং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শিক বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নির্বাচন, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নেও রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ভিন্ন ভিন্ন মতামত লক্ষ্য করা গেছে। রাজনীতিতে মতের ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের অল্প দিনের মধ্যেই এ ধরনের বিভাজন ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। যে সমাজে রাজনৈতিক বিভাজন ও মতাদর্শিক মেরুকরণ যত বেশি সেই সমাজে গণতন্ত্রের পথ তত বন্ধুর হয়।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্রের গতিপথ কোন দিকে যাবে তা নির্ভর করে সমাজে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন ক্রীড়নকদের বর্তমান কার্যক্রম ও ভূমিকার ওপর। এদের মধ্যে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও মিডিয়া এ তিনটি গ্রুপ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এদেশের মিডিয়াগুলো চরমভাবে বিভাজিত এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত। তাছাড়া গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় কিছু কিছু মিডিয়া স্বৈরাচারের দলীয় মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে। কিছু কিছু মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের মতো ভূমিকা পালন করে। কিছু মিডিয়া গণ অভ্যুত্থান পরবর্তীতে গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ শুরু করলেও মিডিয়াগুলোর মতাদর্শিক বিভাজন থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। যা গণতন্ত্রের জন্য খুবই ক্ষতিকর। গণতন্ত্রের প্রশ্নে মিডিয়াগুলোর মধ্যে ঐক্য থাকা জরুরি।
একই কথা প্রযোজ্য এদেশের সিভিল সোসাইটি নিয়ে। গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য সিভিল সোসাইটির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছর সিভিল সোসাইটির ভূমিকা ছিল অনেকটা পক্ষপাতদুষ্ট এবং সিভিল সোসাইটিকে সরকারের হয়ে কাজ করার প্রবণতা দেখা গেছে। ‘বিকল্প নেই’ কিংবা ‘উন্নয়নের নেরেটিভ’ দিয়ে গণতন্ত্রের শক্তিশালী দুটি উপাদান সিভিল সোসাইটি এবং মিডিয়াকে গত ১৫ বছর ফ্যাসিবাদী সরকারের পক্ষে কথা বলতে দেখা গেছে। মিডিয়া এবং সিভিল সোসাইটির এ পক্ষপাতমূলক আচরণ ফ্যাসিবাদী সরকারকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়তা করেছে। কিন্তু ছাত্র- জনতার অভ্যুত্থানে সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়ার একটি অংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সরকার পতনের আন্দোলনে মিডিয়া ও সুশীল সমাজ ছাত্র-জনতার কাতারে এসে আন্দোলনে শামিল হয়েছে। তবে ইদানীং তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রশ্নে ঐক্যের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা গেছে।
মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটির চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন আরও বেশি ও স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দীর্ঘদিন ঐক্য থাকলেও সেই ঐক্য এখন আর দৃশ্যমান নয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে দুটো মতাদর্শিক রাজনৈতিক পক্ষ রয়েছে ডানপন্থি রাজনৈতিক দল ও বামপন্থি রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে ক্ষেত্রবিশেষে একই কাতারে আসতে দেখা গেলেও (যদিও গত দুই দশকের অধিককাল ধরে তা দেখা যায়নি) ডানপন্থি ও বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেই অর্থে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংলাপ লক্ষ্য করা যায়নি। এ দুই রাজনৈতিক গ্রুপের মধ্যে মতাদর্শিক পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব অনেকটা চরম পর্যায়ের।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় এ দুটো গ্রুপকে একই দাবিতে আন্দোলনের মাঠে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু আন্দোলনের পরবর্তীতে নতুন সরকার গঠন, বিভিন্ন পদ পরিবর্তন, রাজনৈতিক মাঠে ভূমিকা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নানা ক্ষেত্রে এ দুটো গ্রুপের মধ্যে দ্বান্দ্বিক অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে এ দুটো গ্রুপের মধ্যে জাতীয় রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে দেখা গেছে যা ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য খুবই আশঙ্কাজনক।
বাংলাদেশের মতো নিকট অতীতে আমরা দুটো বড় ধরনের গণ অভ্যুত্থান দেখেছি। আরব বসন্তের সময় তিউনিশিয়াতে স্বৈরাচারী সরকার বেন আলীর বিরুদ্ধে এবং মিসরের স্বৈরাচারী সরকার হুসনি মোবারকের বিরুদ্ধে। দুটি দেশে কাছাকাছি সময়ে গণ অভ্যুত্থান সংঘটিত হলেও গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এ দুটো দেশের গতিপথ দুরকম হয়েছে। তিউনেশিয়াতে গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তীতে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর ও ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে সেটি সম্ভব হয়েছে।
অন্যদিকে মিসরে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তীতে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেও সেখানে গণতান্ত্রিক যাত্রা থমকে দাঁড়িয়েছে। সমাজে অধিক মাত্রায় পোলারাইজেশন বা মেরুকরণের কারণে, ডানপন্থি ও বামপন্থিদের দুই পক্ষের বিপরীত অবস্থানের কারণে, সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দিয়েছে। একদিকে নির্বাচিত সরকারের কট্টরপন্থি নীতি অন্যদিকে প্রতিপক্ষের সরকারের বিপক্ষে অনড় থাকার ফলে মিসরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেও গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হয়েছে।
গণ অভ্যুত্থান পরবর্তীতে রাষ্ট্রগঠন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুনঃপ্রবর্তন কিংবা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে কী ধরনের আচরণ করতে হবে সেক্ষেত্রে মিসর এবং তিউনেশিয়া থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ কিংবা মতাদর্শিক স্বার্থ যে সমগ্র দেশের গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে মিসরে এক্ষেত্রে জ্বলন্ত উদাহরণ।
শত শত শহীদ যেখানে আত্মত্যাগের মাধ্যমে মিসরে দীর্ঘ তিন দশকের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছে, মতাদর্শিক প্রাধান্য সেই আত্মত্যাগকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়ার বৃহত্তর স্বার্থের প্রতি আকাক্সক্ষা, গণতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরির প্রতি একাগ্রতা, রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরকে ছাড় দেওয়ার প্রবণতা, মতাদর্শিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে তিউনেশিয়াতে একটি গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন দেখা গেছে। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী সরকার ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। এগুলোকে পুনর্নির্মাণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের কোনো বিকল্প নেই। আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো, মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি দলীয় স্বার্থ বা মতাদর্শিক স্বার্থকে উপেক্ষা করে জাতীয় স্বার্থে যেভাবে রাজনৈতিক মাঠে নেমে এসেছে, অভ্যুত্থান পরবর্তীতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বার্থেও তাদের মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন। বৃহত্তর গণতন্ত্রের স্বার্থে পরস্পরকে ছাড় দেওয়া এবং সমঝোতাই আগামীর বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে পারবে, উপহার দিতে পারবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে।
♦ লেখক : পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা