নাট্যশিল্পের এক বিশেষ দিক হচ্ছে মূকাভিনয়। এটি একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম। সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রায় তিন ধরনের মূকাভিনয়ের চর্চা হয়। মূকাভিনয়, আধুনিক মূকাভিনয়, বর্তমান মূকাভিনয়। মুক্তিযুদ্ধের পর একদল খ্যাপা তারুণ্যের হাত ধরে নব উদ্দীপনা নিয়ে এদেশে শিল্পের এই মাধ্যমটি সম্পর্কে শিল্পানুরাগীদের মাঝে আগ্রহ জাগে। তবে দু-একজন শিল্পী নিজস্ব তাগিদ থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মূকাভিনয়কে পরিচয় করলেও দলগতভাবে এর কার্যক্রম শুরু হতে লেগে যায় আরও বেশকিছু দিন। মাইম বা মূকাভিনয়ের জনক বলা হয় ফ্রান্সের মার্সেল মার্সোকে। তার পরেই গুরুত্ব দেওয়া হয় ফ্রান্সের নাইট উপাধি পাওয়া বাংলাদেশের পার্থ প্রতিম মজুমদারকে। বাংলাদেশে আধুনিক মূকাভিনয় বা মাইমের চর্চা ঘটা করে শুরু হয় ১৯৭৫ সাল থেকে একজন বিদেশির হাত ধরে। আমেরিকান শিল্পী এডাম ডারিউস ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে প্রথম মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন। এরপর অবশ্য বেশকিছু বিদেশি মূকাভিনেতা শিল্পকলা একাডেমি, ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মঞ্চে মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইংল্যান্ডের নোলারে ও জার্মানির মিলান পাদেক। তবে বাংলাদেশের মূকাভিনয়কে পরিচয় করিয়ে দিতে মূকাভিনেতা যোগেশ, পার্থ প্রতিম মজুমদার, ‘ঢাকা প্যান্টোমাইম’ এর কর্ণধার জিল্লুর রহমান জন, মাশরুর হুদা, জাহিদ রিপন, নিথর মাহবুবসহ আরও অনেকের অবদান রয়েছে। শিল্পীর পোশাকের ধরন প্রায় একই রকম হতো কালো রঙের আঁটসাঁট আচ্ছাদন এবং মুখে সাদা রংয়ের প্রলেপ। বিষয়বস্তু ছিল অত্যন্ত হালকা ও বিনোদনধর্মী। তবে নানা রকম সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তখন যে কয়েকটি ভালো প্রদর্শনী হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জন্ম থেকে মৃত্যু, বালক ও পাখি, প্রজাপতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ফটোগ্রাফার, ওষুধ বিক্রেতা, বখাটে ছেলের পরিণতি, রিকশাওয়ালা, মাছ ধরা ইত্যাদি। এগুলোতে ক্যারিকেচার এবং অহেতুক হাস্যকৌতুকের স্থলে ক্ষেত্রবিশেষে বিষয়ের গভীরতা প্রকাশ পায়। ১৯৮৯ সাল থেকে একক অভিনয়ের পাশাপাশি দলগত অভিনয়ের ধারাও প্রচলিত হয়। এ ক্ষেত্রে ‘ঢাকা প্যান্টোমাইম’ পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে। নিথর মাহবুব ও তার প্রতিষ্ঠিত দলীয় মূকাভিনয়ের সংগঠন মাইম আর্ট মূকাভিনয়কে জনপ্রিয় করে তোলে। ছোট ছোট স্কেচের পরিবর্তে একটি বিশেষ ঘটনা বা কাহিনীকে উপজীব্য করে ৩০ থেকে ৫০ মিনিটব্যাপী অভিনয় উপস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ‘মাইম ফেডারেশনের সভাপতি জাহিদ রিপন বলেন, ‘বাংলাদেশে সংগীত, নৃত্য, নাটক, চিত্রকলাসহ শিল্পের প্রতিটি শাখা বিকশিত হলেও মূকাভিনয় বা নির্বাক অভিনয় এগোতে পারেনি। অল্পসংখ্যক শিল্পীর মধ্যেই মূকাভিনয়ের চর্চা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে তরুণ সমাজের অনেকেই এই শিল্পের প্রতি এগিয়ে এসেছে। তারা আগ্রহ নিয়ে শিখছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্প আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে।’
মূকাভিনয়ের জীবন্ত কিংবদন্তি পার্থ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে চিনিয়ে যাচ্ছেন নতুন করে। শুধু তাই নয়, মূকাভিনয় শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। পার্থ বেশ কটি আমেরিকান, কানাডিয়ান ও ফরাসি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে ‘ওয়ান ডলার কারি’, ‘জনিস অ্যান্ড জন’, ‘ফার্মাসি দ্য গার্ড’, ‘দ্য মর দ্য বেলভিল’, ‘বাই বাই’। ‘বাই বাই’ জিতে নিয়েছে ২৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। শুধু তাই নয়, সারা বিশ্বের ৫টি উৎসবেও প্রদর্শিত হয়েছে সিনেমাটি। মূকাভিনয়ে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য পার্থ ১৯৮৭ সালে ‘কলকাতা যোগেশ মাইম একাডেমি’ থেকে ‘মাস্টার অব মাইম’ উপাধি অর্জন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি একক মূকাভিনেতা হিসেবে এথেন্স, নিউইয়র্ক, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন। মালয়েশিয়া থেকে মিলেছে ‘মাস্টার অব ওয়ার্ল্ড’ সম্মাননা। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক দেওয়া হয় তাকে। ২০১১ সালে ফ্রান্স সরকারের নাইট উপাধিতে ভূষিত হন তিনি।
চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলাদেশের মূকাভিনয়ের জগতে আশার আলো জ্বালাতে শুরু করেন নিথর মাহবুব। সব প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশে মূকাভিনয়ের মতো অপ্রচলিত শিল্পটি নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পথচলা শুরু করেন নিথর মাহবুব। শিল্পচর্চায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী মাইমকে বেছে নিয়েছেন শিল্প প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে। প্রথম দিকে একা চর্চা করলেও ২০০৮ সালে এসে মূকাভিনয় শিল্পের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে মূকাভিনয়ে আগ্রহী কয়েকজনকে নিয়ে ঢাকায় গড়ে তোলেন মূকাভিনয়ের সংগঠন মাইম আর্ট। তার চেষ্টায় মাইম আর্ট মঞ্চে আনে ১ ঘণ্টার পূর্ণাঙ্গ মূকাভিনয় প্রযোজনা ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’। পরবর্তীতে মাইম আর্ট মঞ্চে নিথর মাহবুবের রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চে আনে ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’। রাজনৈতিক সহিংসতার প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে তিনি মঞ্চে আনেন ‘ইউটার্ন’ নামের প্রযোজনা।
মূকাভিনয়ে টিএসসি থেকে ইউরোপ জয় করেছেন আরেক বাংলাদেশি তরুণ মীর লোকমান। যিনি একজন পুরোদস্তুর মূকাভিনয়শিল্পী। তিনি এখন দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূকাভিনয় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ইউরোপের আর্মেনিয়ায় পারফর্ম করেছেন। ঢাবিতে মূকাভিনয়কে জনপ্রিয় করতে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ‘না বলা কথাগুলো না বলেই হোক বলা’ স্লোগানে টিএসসির চত্বরে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের হয়ে ভারত ও আর্মেনিয়াতে মাইমকে উপস্থাপন করেন। ২০১৬ সালে ভারতে মূকাভিনয়ে দলগতভাবে চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে মাইমে চ্যাম্পিয়ন হন। মীর লোকমান ৩৫০টির বেশি মাইম পরিবেশন করেছেন। আগামী জানুয়ারিতে মাইমের প্রতিযোগিতায় বেলজিয়াম বা ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা রয়েছে লোকমানের। ইংল্যান্ড ঘুরে আসার পর হয়তো লোকমানের সফলতার খাতা আরও ভারী হবে।