রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নগরীর শালবাগান এলাকায় নিজ বাসার সামনে থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নগরীর বোয়ালিয়া জোনের সহকারী কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নিহত রেজাউল করিম সিদ্দিকী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারার দরগামাড়িয়ায়। সেখানে তার একটি গানের স্কুল আছে। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী হোসনে আরা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও হত্যাকারীদের আটক করতে পারেনি।
নগর পুলিশের উপকমিশনার এ কে এম নাহিদুল ইসলাম জানান, এই হত্যাকাণ্ডের ধরন ব্লগার হত্যার মতো। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর রাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শফিউল ইসলাম লিলন হত্যার সঙ্গেও এর সাদৃশ্য আছে। পুলিশ জানায়, শিক্ষক রেজাউল করিম বাড়ি থেকে নাস্তা শেষে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে বের হন। তিনি বাসা থেকে বের হয়ে শালবাগান মোড়ে এসে গাড়িতে উঠতেন। কিন্তু বাসা থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে শালবাগান বাজারের পশ্চিম পাশে গলির মধ্যে দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পেছন থেকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তার ঘাড়ে তিন থেকে চারটি জখম আছে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে জবাই করা হয় বলেও পুলিশ জানিয়েছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, অধ্যাপক রেজাউল করিমের লাশ ‘কাঙ্ক্ষিত’ নামের একটি বাড়ির গেটের সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। রক্তের দাগ লেগে আছে ওই বাড়ির দেয়ালে। বাড়ির গেটের সামনে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটলেও কেউ কিছু দেখেননি বলে দাবি ওই বাড়ির সদস্যদের। অধ্যাপক রেজাউল করিমের স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ‘ভালো মানুষ বাসা থেকে বের হয়ে গেল। এরপর রাস্তার মধ্যে খুন হলো। তাকে কারা খুন করল? তার তো কোনো শত্রু ছিল না! কারও সঙ্গে তার কোনো ঝামেলাও ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী তার সব বিষয় আমাকে জানাত। কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলার কথা সে কখনো আমাকে জানায়নি। তার কোনো শত্রু নেই।’ নিহত অধ্যাপক রেজাউল করিমের সহকর্মী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘অধ্যাপক রেজাউল করিম শিক্ষার্থীদের খুব পছন্দের শিক্ষক ছিলেন। সহকর্মীদের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল। বিভাগের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তিনি গান পছন্দ করতেন, নিজে গান করতেন। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা শিক্ষক সমিতি প্রাথমিকভাবে বসব। সন্ধ্যায় জরুরি সভাও ডাকব এবং সেখানে সিদ্ধান্ত নেব কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হবে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তমাশ্রী দাশ বলেন, ‘এমন নিরীহ মানুষ খুব কমই হয়। এমন মানুষকে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। বার বার শিক্ষক কিংবা সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তচিন্তার মানুষদের এভাবে স্তব্ধ করে দেবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
ব্লগার স্টাইলে হত্যা : বিগত সময়ে দেশে ব্লগারদের যেভাবে হত্যা করা হয়, একই কায়দায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় কোনো জঙ্গি সংগঠন জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। ঘটনাস্থলে থাকা রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত সময়ে দেশে যেভাবে ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছে, একই কায়দায় অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীও খুন হয়েছেন। তাই হত্যার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এ ঘটনায় জঙ্গি সংগঠন জড়িত থাকতে পারে। এ ছাড়া অধ্যাপক লিলন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার হত্যার সাদৃশ্য আছে।’
তিন মোটরসাইকেল আরোহীর সন্ধানে পুলিশ : অধ্যাপক রেজাউল করিম যে রাস্তায় খুন হয়েছেন, সেখান দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে গেছে তিনজন। আশপাশের লোকজন হত্যাকাণ্ডের পরপরই সেখান দিয়ে তাদের যেতে দেখেছেন। তবে কেউ তাদের আটকানোর চেষ্টা করেননি বলে জানিয়েছে পুলিশ। বোয়ালিয়া জোনের সহকারী কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন জানান, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওই তিন মোটরসাইকেল আরোহী জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে মোটরসাইকেলে কারা ছিল তার অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশ।
তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ। তিনি সেতার বাজাতেন। তার বাড়ির শোয়ার ঘরে গিয়ে দেখা যায়, বিছানার ওপর সেতারটি রাখা। দেখে মনে হচ্ছিল রাতেই বাজিয়েছেন। সকালে বিছানার ওপর রেখে বের হয়েছেন। মাথার কাছে টেলিফোন সেটটি ঢেকে রাখা হয়েছে। রেজাউল করিমের খাটের নিচে একপাশে একটি একতারা, একটি হারমোনিয়াম ও ডুগি-তবলা আছে। ঘরে দুটি বইয়ের আলমারি। পশ্চিমের দেয়ালে একটি পাখির ছবি। বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। উত্তরের দেয়ালে একটি বিমূর্ত ছবি টাঙানো।
রেজাউল করিম সিদ্দিকীর ‘কোমলগান্ধার’ নামে সাংস্কৃতিক একটি সংগঠন আছে। ওই সংগঠনের শিক্ষার্থীরা জানান, সংগঠনের পক্ষ থেকে কোমলগান্ধার নামে তিনি একটি ছোট কাগজ বের করতেন। এবার সেটির ষষ্ঠ সংখ্যা বের হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরাই লিখতেন। অধ্যাপক শুধু সম্পাদকীয় লিখতেন। শিক্ষক রেজাউলের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ পৌরসভার দরগামাড়িয়া গ্রামে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি। চারজনই সরকারি চাকরি করেন। বাবা আবুল কাশেম প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে অবসরে আছেন। রেজাউল করিমের চাচাতো বোন স্থানীয় দরগামাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহানারা বেগম জানান, তার ভাই প্রায়ই গ্রামে আসতেন। এসে গ্রামের ছোট-বড় সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন। ছোটদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন এবং তাদের আনন্দ দিতেন। এলাকায় ঘুরে ঘুরে লোকসংস্কৃতি নিয়ে তথ্য, ছবি সংগ্রহ করতেন। ভিডিও ধারণ করতেন। গ্রামবাসী জানান, শিক্ষক রেজাউল ছিলেন মুক্তমনা ও সংস্কৃতিমনা। এলাকার শিশু-কিশোরদের জন্য গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ক্ষোভে উত্তাল রাবি : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার ঘটনায় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী মিছিল, সড়ক অবরোধ, সমাবেশ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক সমিতি, রাবি ছাত্রলীগ, প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ক্যাম্পাসে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ তিন দিন ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে আজ রবিবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট ডেকেছে। অধ্যাপক রেজাউলের খুনের খবর ছড়িয়ে পড়লে সকাল ১০টার দিকে সড়ক অবরোধ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। এরপর এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল ও মানববন্ধন করেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বেলা ১২টায় সিনেট ভবনের সামনে সমাবেশ করে রাবি শিক্ষক সমিতি। সমাবেশ থেকে আজ রবিবার ক্লাস বর্জন ও সকাল ১০টায় প্রতিবাদ র্যালির ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তী কর্মসূচি সন্ধ্যায় (গতকাল) শিক্ষক সমিতির জরুরি সভায় নির্ধারণ করা হবে বলে জানানো হয়। রাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ আজম শান্তনুর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাধাগ্রস্ত করতে বার বার আঘাত আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ওপর। অসহায়ভাবে হত্যার শিকার হচ্ছে শিক্ষকসমাজ। সংস্কৃতিমনা শিক্ষকদের ওপর বার বার নেমে আসছে হত্যার খড়্গ।
আইএসের দায় স্বীকার : অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তত্পরতা নজরদারিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের’ এক টুইটে এ কথা জানানো হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় ‘সাইট’-এর টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এক পোস্টে বলা হয়, আইএসের ‘আমাক সংবাদ সংস্থা’ অধ্যাপক রেজাউলকে হত্যায় জঙ্গিগোষ্ঠীটির দায় স্বীকারের খবর দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘নিরিশ্বরবাদে আহ্বান করার জন্য’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে।