গুজব এবং গজব শব্দ দুটি শুনলেই সবাই আঁতকে ওঠেন। কারণ এ শব্দ দুটির ক্রিয়া খুবই বিপজ্জনক ও ভয়াবহ। বাংলাদেশে এখন এ দুটি শব্দের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই বেশি হচ্ছে। নানান বিষয়ে নতুন নতুন গুজব তৈরি হচ্ছে। এসব গুজবের ডালপালা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এমনভাবে এসব গুজব তৈরি হচ্ছে, যেন প্রচারকারী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। গুজব কেন্দ্র করে নতুন নতুন গজবের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নানান গুজব ও গজবের মতো পরিস্থিতি। সে কারণে দেশের মালিক জনগণ বুঝতে পারছে না দেশের মধ্যে কী হচ্ছে, অথবা কে কী করছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই বিপৎসংকুল। কেউ কিছু মানছে না। যাঁকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি তাঁর দায়িত্ব বাদ দিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন অন্য কাজে। রাষ্ট্র মেরামতে যেসব প্রবাসীকে বিশেষ সম্মান দিয়ে আনা হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে দেশের বিশেষজ্ঞদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত চলছে ভিতরে ভিতরে। দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে লুকোছাপার কারণে একতরফা দোষের ভাগীদার হচ্ছেন ড. ইউনূস। অনেক গুজব নিয়ে দেশের মধ্যে নানান সেক্টরে যখন নানান ফিসফাঁস, নানান গুঞ্জন, নানান কূটচাল চলছিল, তখন সরকারপ্রধান গত মঙ্গলবার রাতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের ভিতরের অপ্রকাশিত খবর যা-ই হোক না কেন, প্রকাশিত খবরেই শান্তিপ্রিয় দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছেন, আর যা-ই হোক দেশের মধ্যে নতুন করে কোনো অশান্তি তৈরি হবে না। আমাদের এখন সংকট উত্তরণের সময়। বিভেদ ভুলে একতাবদ্ধ থাকার সময়। গুজবে কান না দিয়ে সত্য প্রচারের সময়। বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করে দেশের জন্য কাজ করার সময়। সব চাপ উপেক্ষা করে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার সময়। তা না হলে ব্যর্থ হবে অন্তর্বর্তী সরকার। আর এ ব্যর্থতার দায় বিশ্ববরেণ্য মানুষটির ওপর চাপিয়ে অন্যরা টা-টা, বাই-বাই বলে চলে যাবেন যার যার গন্তব্যে। সুতরাং ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই সফলতার একমাত্র পথ।
বর্তমান সরকারের নয় মাস সময়ের মধ্যে কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে না কেন-এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। দেশের আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গন, পররাষ্ট্রনীতি, সামাজিক শৃঙ্খলাসহ কোনো সেক্টর নিয়েই দেশবাসী স্বস্তিবোধ করছেন না। জুলাই বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ফ্যাসিস্টের পতন ও নতুন বন্দোবস্ত প্রবর্তন। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র সংস্কার। কাজটি করার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের ভিতর থেকে কিছু লোককে বাছাই করেছেন। কিছু এনেছেন প্রবাসী। কিছু মানুষকে সরকার চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। কিছু মানুষকে দিয়েছেন সংস্কারের দায়িত্ব। বিগত সময়ে দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে সমাজের বিশিষ্টজন হিসেবে যাঁরা পরিচিত তাঁদের সংস্কারকাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নয় মাস পরেও হিসাবের খাতা মিলিয়ে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ তো কোনো কিছুর হিসাব পাচ্ছেন না। বাস্তবতার চেয়ে কথামালাই খুঁজে পাচ্ছেন তারা। রাষ্ট্রের অন্যতম স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দল। সরকারি আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করা দুই-একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া কেউ বুঝতে পারছে না কবে এবং কীভাবে হবে নির্বাচন। আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের ঘোষণা প্রধান উপদেষ্টা দিলেও কেন যেন আস্থা রাখতে পারছে না রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি শুরু থেকেই বর্তমান সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন ব্যক্ত করেছে। সেই দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার হতাশার সুরে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শুরু হয়েছে। বাংলাদেশকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের যখন একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তখন একটা কালো ছায়া এসে দাঁড়াচ্ছে। সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন, জনগণকে তাঁদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বিভাজনের রাজনীতি আবার শুরু হয়েছে। গোত্রে গোত্রে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশ অস্থিতিশীল করতে সরকারের মধ্যে কিছু অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পরস্পরের মুখোমুখি করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে যে ষড়যন্ত্র চলছে, সে ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে। কেউ যেন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিলীন করতে না পারে।’ তাঁর এ বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে দেশের সশস্ত্র বাহিনী নিয়েও নানানরকম মনগড়া গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিগত সময়ে চাকরিচ্যুত বা চাকরি হারানো সিপাহিদের উসকে দেওয়া হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সিপাহিরা একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, তা সত্যি হতাশাজনক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- কারা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, কারা সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার ও গুজব ছড়াচ্ছে। যাঁরা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্ত্র প্রহরী, তাঁদের নিয়ে অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? তাহলে কি সরকারের ভিতর থেকেই একটি চক্র রাষ্ট্রকে দুর্বল করার অপকর্ম করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মঙ্গলবার রাতের বৈঠকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সরকারের সফলতার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনী প্রথম দিন থেকেই কাজ করছে। তিন বাহিনীর সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৫ আগস্টের পর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বহির্নিরাপত্তা রক্ষা করছেন। ভেবে দেখা দরকার, সশস্ত্র বাহিনীর যদি ক্ষমতার লোভ থাকত, তাহলে ৫ আগস্টের পর বর্তমান সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর দেশিবিদেশি সঙ্গীরা পেতেন কি না! সুতরাং তিন বাহিনী প্রধান ও তিন বাহিনীকে নিয়ে কূটচাল বন্ধ করতে হবে। সরকারের ভিতরে থেকে যাঁরা এ দুষ্টচক্রে ইন্ধন দিচ্ছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।
একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা যেমন জরুরি, তেমন জরুরি দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতি ঠিক রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের সব ধরনের নিরাপত্তা প্রদানের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু গত নয় মাসে সরকারের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকার যেন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বুঝে হোক, না বুঝে হোক বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে নানামুখী চাপে আছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের শিল্প ও ব্যবসা ধ্বংস করার জন্য কিছু শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এ নোংরা খেলা বন্ধ না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ঢাকঢোল বাজানো যাবে, কিন্তু কোনো লাভ হবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুখ্যাতি দেশের মানুষ জানার আগে জেনেছে বিশ্ব। দেশের পতিত স্বৈরাচার তাঁকে উপাধি দিয়েছিল ‘সুদখোর’। আর বিশ্ব উপাধি দেয় শান্তির দূত ‘নোবেল বিজয়ী’। এই মহান মানুষটির সঙ্গে আমার অল্পস্বল্প স্মৃতি আছে। তাঁর পক্ষে নীরবে কিছু কাজ করারও সুযোগ হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রশাসনের ভয়ে যখন তাঁর খবর কেউ প্রকাশ করত না, তখন আমরা ইউনূস সেন্টারের খবর ছেপেছি। দিনের পর দিন ইউনূস সেন্টারের খবর বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। ইউনূস সেন্টারের কর্মকর্তা শাব্বীর আহমেদ আমার সঙ্গে (বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব) নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। একজন বিশ্ববরেণ্য মানুষকে একজন সরকারপ্রধান নিতান্ত ব্যক্তিগত আক্রোশে কতটা অপমান-অপদস্থ করেছেন, তা আদালতের বারান্দায় নিজ চোখে দেখেছি। হাজিরা দিতে আদালতে যখন তিনি যেতেন, তখন সাধারণ মানুষ তাঁকে কতটা ভালোবাসে, তা-ও দেখেছি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে নয়, বিশিষ্ট এই মানুষটির প্রতি সমব্যথী হয়েই আদালতের বারান্দায় গিয়েছিলাম। ইতিহাসের সাক্ষী থাকার মতো। দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তখন কষ্ট পাওয়া ছাড়া করার কিছুই ছিল না। মানুষটির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা দেশের অসংখ্য মানুষের। সে কারণে তাঁর প্রতি অনেকের মতো আমারও প্রত্যাশা বেশি। কিন্তু যখন দেখি এ মানুষটিকে ব্যর্থ করার জন্য তাঁর চারপাশের মানুষের অনেকেই তৎপর। অথচ অপতৎপরতাকারীদের তিনি আদর করে, ভালোবেসে, বিশ্বাস করে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। তাঁরা ব্যস্ত অন্য এজেন্ডা নিয়ে। সরকারের প্রতিশ্রুত দায়িত্ব পালনে প্রফেসর ইউনূস যদি ব্যর্থ হন, তাহলে এর দায় তাঁকে একাই বহন করতে হবে। অন্যরা তো তখন চলে যাবেন অদৃশ্য পাসপোর্টে যার যার ঠিকানায়। তাঁদের মুখোশও উন্মোচন করা একদিন হয়তো সম্ভব হবে। তবে এখন নয়। কারণ জীবনের মায়া সবার মতো আমারও আছে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন