মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাংগঠনিক চাঁদাবাজিতে বিপর্যস্ত তিন পার্বত্য জেলার জীবন

টাকা না দিলেই গুলি অপহরণ

শিমুল মাহমুদ, রাঙামাটি থেকে ফিরে

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান তিনটি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের সাংগঠনিক চাঁদাবাজিতে বিপর্যস্ত রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার লাখ লাখ মানুষের জীবন। বছরে শত শত কোটি টাকার চাঁদা আদায় করে জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। চাঁদা না পেলে মারধর, গুলি, অপহরণ এমনকি খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। যে এলাকায় যে সংগঠনের আধিপত্য বেশি সেখানে সেই সংগঠন চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কিছু কিছু এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মাঝে মাঝে ধরা পড়লেও কৌশল পাল্টে তারা সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রাখছে। নিরাপত্তার অজুহাতে চাঁদাবাজির শিকার ব্যক্তিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানায় না। ফলে তিন পার্বত্য জেলার প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দা জিম্মি হয়ে আছে পাহাড়ি সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর কাছে। চাঁদা না পেলেই গুলি : পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিজেদের প্রভাবিত এলাকায় স্থানীয় বাজার, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও চাঁদা আদায় করে। বিভিন্ন ফসল, ফল-ফলাদি, গবাদিপশু বেচাকেনায়ও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। চাকরিজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে চিঠি দিয়ে। এখন চলছে ফলের মৌসুম। পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত আম, কাঁঠাল, আনারসসহ বিভিন্ন ফলের শত শত ট্রাক নামছে এখন। এসব ট্রাক থেকে এলাকাভেদে বিভিন্ন হারে চাঁদা আদায় করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। গত ৬ জুন চাঁদা দিতে না চাওয়ায় মানিকছড়ি-খাগড়াছড়ি রাস্তার পিছলাতলা এলাকায় কাঁঠাল বোঝাই পিকআপ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। চাঁদা না দেওয়ায় সম্প্রতি বিআরটিসির একটি ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। রাঙামাটির এক ব্যবসায়ী বলেন, তারা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদা চেয়ে না পেলে আগে হয়তো মারধর করে ছেড়ে দিত। এখন গুলি করে দেয়। গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পার্বত্য এলাকায় গড়ে উঠা ফলদ ও বনজ বাগানের মালিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় মোটা অংকের চাঁদা। একরপ্রতি এক থেকে দেড় হাজার টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হয়। হাজার হাজার ফলবাগান থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। ইতিপূর্বে রাঙামাটির নানিয়ারচর এলাকায় চাঁদার জন্য শত শত একর আনারস বাগান কেটে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলো এক থেকে দেড় কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে। বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার চাঁদা আদায় করে তারা। চাঁদা আদায় করে জেএসএস ও ইউপিডিএফের কয়েক হাজার সশস্ত্র কর্মী। আদায় করা চাঁদার টাকা দিয়ে তারা সংগঠনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, দেশ-বিদেশে বাঙালিবিদ্বেষী প্রচারণা ও তাদের অস্ত্র কেনায় ব্যয় করে।

এলাকাভিত্তিক চাঁদা কালেক্টর : রাঙামাটির লংগদু বাজারে বসে শনিবার সকালে কথা হচ্ছিল কাঠের ব্যবসায়ী ছোটন দাসের (৩২) সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানে আমাদের মূল সমস্যা চাঁদাবাজি। চাঁদা না পেলে তারা নির্যাতন করে। মাঝে মাঝে অপহরণ করে মুক্তিপণ নেয়। খুন করে। জেএসএস, ইউপিডিএফ দুই সংগঠনকেই চাঁদা দিতে হয়। এখানে আমরা ৬০ ভাগ বাঙালি হয়েও তাদের সঙ্গে পারি না। কারণ, তারা সশস্ত্র অবস্থায় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। পার্বত্য জেলায় কোনো পরিবহন মাল নিয়ে ঢোকার সময় অথবা বের হওয়ার সময় চাঁদা দিতে হয়। একেক সময় তারা একেক স্থান থেকে চাঁদা তোলে। চাঁদা না দিলে গাড়ি থামিয়ে স্টাফদের মারধর করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইউপিডিএফের সামরিক শাখার প্রধান প্রদীপন খীসার খাগড়াছড়ির বাড়ি থেকে যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে আদায় করা চাঁদার ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করে। চাঁদা আদায়ের জন্য জেএসএস ও ইউপিডিএফের রয়েছে এলাকাভিত্তিক কালেক্টর। চাঁদা আদায়সহ দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় কাজ করার জন্য চাঁদা কালেক্টর ও কমান্ডারদের রয়েছে মোটরসাইকেল। এছাড়া প্রত্যেকের কাছে রয়েছে একাধিক মোবাইল সিম। সম্প্রতি রামগড়ের গৈয়াপাড়া এলাকায় আটক ইউপিডিএফের চাঁদা কালেক্টর জীবন চাকমা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, চাঁদাবাজির কাজে এলাকাভিত্তিক তাদের বাঙালি সোর্স রয়েছে। এদের মাধ্যমে তথ্য ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করে চাঁদা দাবি করা হয়।

অস্ত্র আসে মিজোরাম, মিয়ানমার থেকে : আদায় করা চাঁদার একটি বড় অংশ ব্যয় করা হয় অস্ত্র সংগ্রহে। অত্যাধুনিক সব অস্ত্র সংগ্রহ করে সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। সূত্র জানায়, একে-৪৭, একে-২২, এম-১৬ রাইফেল, নাইন এমএম পিস্তল, চাইনিজ সাব-মেশিনগানসহ অত্যাধুনিক সব অস্ত্র রয়েছে সংগঠনগুলোর হাতে। ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমার হতে এসব অস্ত্র সংগ্রহ করে তারা। মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) সহযোগিতায় পাহাড়ি সংগঠনের জন্য অস্ত্রের চালান আসার পথে গত ৯ ডিসেম্বর সে দেশের কারেন প্রদেশে সেগুলো ধরা পড়ে। একইভাবে ভারতের মিজোরামেও একাধিকবার অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে। সূত্র জানায়, নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় মাঝে মাঝে অস্ত্রসহ বিভিন্ন গ্রুপ ধরা পড়লেও তাদের বিস্তৃত সশস্ত্র নেটওয়ার্ক ধরাছোঁয়ার বাইরে। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নকারী আওয়ামী লীগ সরকারের সহনশীল মনোভাবের কারণেই এখন পার্বত্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো কোনো অভিযান নেই। এজন্য সশস্ত্র গ্রুপগুলো নির্বিঘ্নে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। স্থানীয়রা বলেছেন, তিন পার্বত্য জেলায় নির্দিষ্ট বিরতির পর নিয়মিত অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো হলে পাহাড়ের সন্ত্রাস ও লাগামহীন চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ হতে পারে।

সর্বশেষ খবর