হাতের কনুইয়ে ক্ষত। যুবকটি চিকিৎসককে জানায়, কুকুর কামড়েছে তাকে। ক্ষত দেখে চিকিৎসক বুঝলেন কুকুরের নয়, মানুষের কামড়! যুবকটির নাম সেতু। তার কাছে নিজের সিদ্ধান্ত গোপন রাখেন চিকিৎসক। গোপন রাখেননি পুলিশের কাছে। সেতুকে পাকড়াও করে পুলিশ। সেতু পুলিশকে নিয়ে যায় একটি বাড়িতে। বাড়ির উঠোনের এক কোণে সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা একটি জায়গা। সেতু সেদিকেই আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয় পুলিশকে। জায়গাটা খুঁড়তে থাকে পুলিশ। বেরিয়ে আসে আস্ত একটি ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্ক খুলতেই সবাই স্তম্ভিত, হতবাক! পুলিশের এক কর্মকর্তা চিৎকার করে বলে ওঠেন, আরে! এ তো নীহার বানু! নীহার বানু ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী। নিখোঁজের সাড়ে পাঁচ মাস পর উদ্ধার করা হয় তার লাশ, মানে কঙ্কাল। ৩৯ বছর আগে নীহার বানু হত্যাকাণ্ড আলোড়ন তুলেছিল সারা দেশে। সুন্দরী নীহার বানুকে তার সহপাঠী আহমেদ হোসেন বাবু বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। নীহার রাজি হননি। এতে ক্রুদ্ধ হন বাবু। একদিন বাবু ও বাবুর বন্ধু সেতু, মিন্টু ও আরও কয়েকজন মিলে ক্লাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে শহরের ‘মীনা মঞ্জিল’ নামের একটি বাড়িতে নিয়ে যান নীহারকে। সেখানে তারই শাড়ি দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করেন। দেশের একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এমন একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডের কাহিনী প্রকাশিত হলে আঁতকে ওঠে বাংলাদেশ। প্রতিবাদে মুখর হন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তারা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে মিছিল-মিটিং করেন। খুনিদের ছবিসহ পোস্টার ছাপিয়ে ফাঁসির দাবি জানান। কিন্তু এ ঘটনার মূল আসামি আহমেদ হোসেন বাবুসহ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুজন আজও পলাতক। রটনা আছে, ঘটনার পর তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে একজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ও পরবর্তীতে স্টাফ রিপোর্টার আহমেদ শফিউদ্দিন হত্যাকাণ্ড প্রকাশ পাওয়া থেকে বিচারকাজ পর্যন্ত সব দেখেছিলেন। যোগাযোগ করা হলে সিনিয়র এই সাংবাদিক জানান, তখন দেশে এত পত্রিকা-মিডিয়া ছিল না। যে কটা ছিল সেগুলো প্রতিদিন বিচার কার্যক্রমের খবর খুব গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। বিচিত্রার নীহার বানু সংখ্যাটি একাধিকবার মুদ্রণ করা হয়। সিনিয়র এই সাংবাদিক জানিয়েছেন নীহার বানু হত্যার নানা তথ্য।
ভার্সিটি থেকে না ফেরা : ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭৬। বাসা থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস চেপে ক্লাস করতে ক্যাম্পাসে যান নীহার বানু। সন্ধ্যা নামার পরও মেয়েটি বাসায় ফিরে না আসায় বিধবা মায়ের মনে দুশ্চিন্তা। মা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। ভাবছেন বড় মেয়েটা বাসায় ফিরে এলেও তো খোঁজাখুঁজি করতে পারত। পেশায় চিকিৎসক বড় মেয়ে বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর থেকেই সংসারটা (মা, পাঁচ বোন আর এক ভাই) টেনে নিয়ে চলছেন। সন্ধ্যা কেটে রাতের আঁধার বাড়তে থাকল, কিন্তু মেয়ে তখনো ফিরলেন না। অজানা আশঙ্কায় মায়ের মন ভারী হতে থাকল। তিনি আর স্থির থাকতে পারছেন না- ঘরের সদর দরজা খুলে গভীর শঙ্কা আর উদ্বেগ নিয়ে বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেডিকেল কলেজ থেকে ডিউটি শেষে বাড়ি ফেরেন বড় মেয়ে। মেয়েকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ না দিয়েই উৎকণ্ঠিত মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, নীহার তো ভার্সিটি থেকে এখনো ফেরেনি। সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে ছোট ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বড় বোন শহরে থেকে ভার্সিটিতে যাওয়া-আসা করে এমন ছাত্রছাত্রীদের বাসায়। একে একে খোঁজ চলে সহপাঠী, ইয়ারমেটদের বাসায়, অন্য ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের বাসায়, তারপর শহরে বসবাসরত পরিচিত শিক্ষকদের বাসায়। সব শেষে নিকটবর্তী থানা ও হাসপাতালে। কিন্তু কোথাও নেই নীহার বানু। ভোরের অপেক্ষায় পুরো পরিবার। শঙ্কা, উৎকণ্ঠা আর উদ্বিগ্নতায় ভারাক্রান্ত দীর্ঘ রাত যেন আর শেষ হতে চায় না। ’৭১-এ যেদিন পাকিস্তানি সেনারা তাদের বাবাকে ধরে নিয়ে যায় সেদিনের মতো দমবন্ধ করা দুর্বিষহ দীর্ঘ রাত এ পরিবারকে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার পাড়ি দিতে হচ্ছে। পরদিন আশানিরাশার দোলাচলে পরিবারের সদস্যরা গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, খোঁজ করা হলো ক্লাসে, মেয়েদের হলে; কথা হলো বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষকদের সঙ্গে। খোঁজাখুঁজির সংক্ষিপ্তসার হলো- আগের দিন সকালে নীহার বাসে বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছেন কিন্তু বিকালে বাসে ফেরেননি। সহপাঠীরা বললেন, নীহার ক্লাসে ছিলেন, হাজিরা খাতা দেখে শিক্ষকরা তার ক্লাসে উপস্থিত নিশ্চিত করলেন। কেউ কেউ বললেন, ক্লাস শেষে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ের পাশে এক সহপাঠী ছাত্রের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখা গেছে। কেউ কেউ বললেন, দুপুরের দিকে তাকে রিকশায় শহরের দিকে যেতে দেখা গেছে- এই ছিল তার সম্পর্কে সর্বশেষ খবর। নীহার বানু কোনো দিনই মা আর ভাই-বোনদের কাছে ফেরেননি। নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ছয় মাস পর জুন মাসে তার কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়।
নীহার বানু নিখোঁজের পর তার সহপাঠী বাবুকেও দেখা যাচ্ছিল না ক্যাম্পাসে। বাবু তাকে একতরফা ভালোবাসত। তাই অনেকের ধারণা ছিল, হয়তো তারা একসঙ্গেই রয়েছেন। কিন্তু নিখোঁজের তিন দিন পর বাবুকে ক্যাম্পাসে দেখা যায়। বাবুর বন্ধু মিন্টুর দেখা মেলে ক্যাম্পাসে। মিন্টুর সঙ্গে নীহার বানুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হলে মিন্টু মাটির দিকে চোখ রেখে কথা বলতেন। তার এ পরিবর্তন সন্দেহজনক। পুলিশ তাকে পাকড়াও করে। অন্যদিকে চিকিৎসা নিতে যাওয়া সেতুও পুলিশের কাছে ধরা। সেতুর কাছ থেকে সব তথ্য পায় পুলিশ। তার স্বীকারোক্তিতে লাশ উদ্ধার হয়। নীহার বানুর সঙ্গে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে প্রাণ রক্ষায় কামড় দিয়েছিলেন নীহার বানু। তাতে সেতুর হাতে ক্ষত হয়েছিল। চিকিৎসা না করানোয় ক্ষতটি বড় হয়ে গিয়েছিল।
শিরোনাম
- পাকিস্তানের চার বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল সাময়িক স্থগিত
- ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে অ্যাম্বুলেন্সে বাসের ধাক্কা, নিহত ৫
- বন্ধ ভারতের ২০টিরও বেশি বিমানবন্দর
- কুলাউড়ায় ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির শপথ গ্রহণ
- কৈফিয়ত কিংবা বাস্তবতা
- পঞ্চগড়ে রেষম চাষের প্রশিক্ষণ শুরু
- ফকিরহাটে বসুন্ধরা শুভসংঘের আয়োজনে সাহিত্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
- চাঁদপুরে ভোক্তার অভিযানে ৪ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
- চট্টগ্রাম বন্দরে টার্মিনাল নির্মাণে ৮০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে ডেনমার্ক
- ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিশ্ব রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস পালিত
- ‘কৃষক লিগ’ নয়, ইউরোপ জয়ের পথে পিএসজি!
- বেলকুচিতে এ্যালকোহল পানে দুজনের মৃত্যু
- বাবাকে হত্যার পর ৯৯৯-এ কল দিয়ে পুলিশে জানালেন মেয়ে
- আবদুল হামিদের সঙ্গে আরও দেশ ছাড়লেন যারা
- ভারতের টেস্ট দলের অধিনায়ক কে হচ্ছেন?
- চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিজ বাড়ি থেকে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার
- হারানো মোবাইল উদ্ধার করে মালিককে ফেরত দিল পুলিশ
- ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা পরিহারের আহ্বান চীনা রাষ্ট্রদূতের
- ভিসি ভবনে তালা, ৪ দাবিতে জবি শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি
- টেবিলের শীর্ষে চোখ পাঞ্জাবের, টিকে থাকার লড়াইয়ে দিল্লি
চাঞ্চল্যকর সেসব খুন (৫)
সুন্দরী নীহার বানুকে পুঁতে রেখেছিল ওরা
বড় ধরনের খুনের ঘটনায় দেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। চলে আলোচনা-পুলিশ-আসামি-ফাঁসি। এরপর শুধুই স্মৃতি। ধূসর-বিবর্ণ। অতঃপর বিস্মৃতি। ঘটনা আর মনেও থাকে না। চায়ের কাপের সেই ঝড় থামে, তবে দু-একটি অশ্রুভেজা চোখ তখনো জেগে থাকে। ধারাবাহিক প্রতিবেদনে পড়ুন সেসব ঝড়-রক্ত-শকুন আর কাপালিক ছুরি।
মির্জা মেহেদী তমাল
প্রিন্ট ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর