রবিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

শীতলক্ষ্যার তীরে কনটেইনার টার্মিনাল

নরসিংদী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে মহাকর্মযজ্ঞ

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, পলাশ (নরসিংদী) থেকে

শীতলক্ষ্যার তীরে কনটেইনার টার্মিনাল

শীতলক্ষ্যা তীরে এই স্থানেই গড়ে উঠছে কনটেইনার টার্মিনালসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল—বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকা ও গাজীপুর, নরসিংদীসহ রাজধানীর আশপাশ এলাকাকে কেন্দ্র করে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে গড়ে তোলা হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর এ অঞ্চলের বিশেষ সুবিধা থাকবে কনটেইনার টার্মিনাল। এ টার্মিনাল থেকে খালাস পাওয়া পণ্য যাবে রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকায়। সরকারের ঘোষিত ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের একটি নরসিংদীর পলাশের ডাঙ্গা এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে। যদিও কাজে গতি নেই, অনেকটা ধীরগতিতে চলছে। জমি কেনা, প্রাচীর নির্মাণ, মাটি ভরাটসহ বিভিন্ন কাজের অগ্রগতি হয়েছে। আর এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে থাকবে মোটর গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা। থাকবে ইস্পাত ও অধাতু নির্মিত পণ্যের কারখানা; ইলেকট্রিক্যাল-ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, এয়ার ক্র্যাফট, মোবাইল, গাড়ি, টেক্সটাইল মিল, টিভির যন্ত্রাংশের কারখানা। এমনকি থাকবে প্লাস্টিক পণ্য, কাপড় ও কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ শতাধিক কারখানা। শুধু তাই  নয়, থাকবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি হাইটেক পার্ক। সরাসরি শীতলক্ষ্যা নদীপথে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর ও মেঘনা নদী হয়ে মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে থাকবে এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংযোগ। থাকবে ঘোড়াশাল-ডাঙ্গা-পাঁচদোনা ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গেও সংযোগ। এমনকি অর্থনৈতিক অঞ্চলের চারদিকের সুবিধার্থে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ওপর দিয়েই নির্মাণ হবে একটি সেতু। থাকবে ঘোড়াশাল রেলস্টেশনের সঙ্গেও সংযোগ। কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ইতিমধ্যে ৫০ একর জমি কেনা হয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যও কেনা হয়েছে ২০০ একর জমি। আর এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কনটেইনার টার্মিনাল ঘিরে পুরো নরসিংদী, গাজীপুরের শীতলক্ষ্যা নদীঘেঁষা কিছু অংশ, নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের চিত্র পাল্টে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। নরসিংদীর পাঁচদোনা থেকে ডাঙ্গা অর্থনৈতিক অঞ্চলে যাওয়ার সড়কের দুই পাশ ও আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জমি কিনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকেন্দ্রিক শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। ইতিমধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলঘেঁষে দেশের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি প্রাণ-আরএফএল ৫০০ বিঘা জমির ওপর বিশালাকৃতির একটি প্রকল্প গড়ে তুলেছে; যার নাম দিয়েছে ডাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। আর এখন শুধু সেই সোনালি স্বপ্নের দ্বার খোলার অপেক্ষা। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছোট জাহাজে করে নানা পণ্য নিয়ে আসা হবে এই কনটেইনার টার্মিনালে। সড়কপথে যা আনা সম্ভব হয়ে ওঠে না সেসব পণ্যও খালাস হবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে গড়ে তোলা এই কনটেইনার টার্মিনালে। আর এই কনটেইনার টার্মিনাল থেকে পণ্য খালাস হয়ে সরাসরি ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকায় সহজেই পৌঁছানো এখন সময়ের ব্যাপার। শীতলক্ষ্যার ২৫০ একর তীরভূমিতে কর্মসংস্থান হবে লাখো মানুষের। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে সরাসরি আকাশপথে যোগাযোগেরও ব্যবস্থা থাকবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। আর এসব বাস্তবায়নে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। রাজধানী ঢাকার সন্নিকটে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প ইনচার্জ মেজর আসিফ রেজা (অব.) বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের মূল কাজ এখনো শুরু হয়নি। আরও কিছু জমি কেনা শেষ হলেই পুরোপুরি কাজ শুরু করা হবে। শিগগিরই কনটেইনার টার্মিনালের কাজ শেষ হবে এবং ২০১৮ সালে অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাবে। গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধন করেন। আর ১০টির একটি হচ্ছে নরসিংদীর পলাশের ডাঙ্গা। শীতলক্ষ্যার তীরঘেঁষা ডাঙ্গায় ইতিমধ্যে ৭৫০ বিঘা জমি কিনেছে বেসরকারি উদ্যোক্তা এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লি.। সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা মোড় থেকে ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে পলাশের ডাঙ্গা ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের কাজিরচর ও কাজৈর মৌজায় গড়ে তোলা হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর এ সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে ইতিমধ্যে একনেকে প্রকল্প পাস করা হয়েছে। আর এ সড়কের দুই পাশে এখন অর্থনৈতিক অঞ্চলকেন্দ্রিক নানা কোম্পানির প্রতিষ্ঠান গড়তে জমি কিনে সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। প্রকল্পের ভিতরে রয়েছে একটি অফিসকক্ষ। চারদিকে বাউন্ডারি ওয়াল দেওয়া হয়েছে। ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বিশাল বালুময় এলাকা। আর এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশেই গড়ে উঠেছে প্রাণ আরএফএলের বিশাল কারখানা। পাশেই রয়েছে আরও কয়েকটি বেসরকারি কারখানার নির্ধারিত স্থান। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটি ডাঙ্গায় ২০০৯ সাল থেকে ২০০ একর জমির ওপর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ও ৫০ একর জমির ওপর অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ করছে। ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণ, বালু ভরাট ও সীমানাপ্রাচীরের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) দেশের প্রথম বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে এ কে খান অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দেয়। একই সঙ্গে সরকার কোম্পানিটিকে আন্তর্জাতিক কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিশেষ সুবিধা হলো কনটেইনার টার্মিনাল। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বার্জযোগে কনটেইনারভর্তি মালামাল সহজেই নদীপথে পরিবহন সম্ভব হবে। এতে সড়ক ও রেলপথে পণ্য পরিবহনের চাপ কমবে। একই সঙ্গে পাশের গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার শিল্প কারখানার পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।

প্রকল্পের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক প্রধান মেজর আসিফ রেজা (অব.) বলেন, সার্ভে, মাস্টারপ্ল্যান, বিদেশি পরামর্শক নিয়োগের কাজ চলছে। দেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এদিকে ডাঙ্গায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কনটেইনার টার্মিনাল প্রতিষ্ঠা নরসিংদীর বড় অর্জন বলে মনে করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটন। তিনি বলেন, ‘উত্তম যোগাযোগব্যবস্থা ও ভৌগোলিক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরসিংদীর উজ্জ্বল শিল্প সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ফলে ডাঙ্গায় শিল্পবিপ্লব ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচদোনা-ডাঙ্গা সড়ক উন্নীতকরণ ও শীতলক্ষ্যার ওপর সেতু নির্মাণের প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।’

সর্বশেষ খবর