বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সমুদ্র কাঁপাবে যুদ্ধজাহাজ নিশান ও দুর্গম

তৈরি করেছে খুলনা শিপইয়ার্ড। দেশে প্রথমবারের মতো তৈরি এই লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফটে রয়েছে বিশ্বমানের ‘স্টেট অব আর্ট টেকনোলজি’

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা

সমুদ্র কাঁপাবে যুদ্ধজাহাজ নিশান ও দুর্গম

খুলনার শিপইয়ার্ডে নির্মাণ করা অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সমুদ্রসীমার নিরাপত্তায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে সক্ষমতা দিতে অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ ‘নিশান’ ও ‘দুর্গম’ তৈরি করেছে খুলনা শিপইয়ার্ড। দেশে প্রথমবারের মতো তৈরি এই লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফটে রয়েছে বিশ্বমানের ‘স্টেট অব আর্ট টেকনোলজি’। এ ছাড়া পানির নিচে থাকা সাবমেরিন হ্যান্ডলিংয়ের জন্য এখানে তৈরি করা হয়েছে আরও দুটি টাগবোট।

পরীক্ষামূলকভাবে যুদ্ধজাহাজ ও টাগবোট খুলনার ভৈরব ও রূপসা নদীতে চলাচল করছে। ৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এ জাহাজগুলোর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। জানা যায়, গত কয়েক বছরে খুলনা শিপইয়ার্ড ছোট আকারের যুদ্ধজাহাজ প্যাট্রোল ক্রাফটসহ ছোট-বড় ৭২৫টি জাহাজ নির্মাণ করেছে। পাশাপাশি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে কোস্টগার্ডের জন্য ইনশোর প্যাট্রোল ভেসেল (আইপিভি) নির্মিত হয়েছে। তবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বড় আকারের যুদ্ধজাহাজ বিএন নিশান ও বিএন দুর্গম নির্মাণ খুলনা শিপইয়ার্ডের এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে  বড় প্রকল্প। অথচ কিছুকাল আগেও অব্যবস্থাপনা ও নানামুখী দুর্নীতির কারণে সম্ভাবনাময় খুলনা শিপইয়ার্ড মৃতপ্রায় রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানটি হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি এখন জাহাজশিল্পের পথিকৃৎ হয়ে উঠেছে।

লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট : সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট নৌবাহিনীকে ত্রিমাত্রিক (আকাশ, পানি ও পানির নিচে) সক্ষমতা এনে দিয়েছে। এই যুদ্ধজাহাজে সামরিক সক্ষমতার পাশাপাশি পানির নিচে থাকা সাবমেরিনকে শনাক্ত ও ধ্বংসের জন্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে। চীনা কারিগরি সহায়তায় নির্মিত যুদ্ধজাহাজ দুটির ঘণ্টায় গতিবেগ ২৫ নটিক্যাল মাইল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জাহাজ দুটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। খুলনা শিপইয়ার্ডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও প্রকল্প পরিচালক (এলপিসি) এম রাশেদুজ্জামান রাশেদ জানান, ৬৪ দশমিক ২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯ মিটার প্রস্থের জাহাজ দুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। তবে এই মানের জাহাজ বিদেশে তৈরি করতে ১ হাজার কোটি টাকা খরচ হতো।

অত্যাধুনিক টাগবোট : পানির নিচে থাকা সাবমেরিনকে হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ১৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে তৈরি হয়েছে অত্যাধনিক দুটি টাগবোট। হালদা ও পশুর নামের প্রতিটি জাহাজের দৈর্ঘ্য ৩২ মিটার। মালয়েশিয়ার কারিগরি সহায়তায় নির্মিত টাগবোট দুটি খুলনার বানৌজা তিতুমীরে উদ্বোধনের পর নৌবাহিনীর ব্যবহারের জন্য চট্টগ্রামে নেওয়া হবে। এটি পানির নিচে সাবমেরিন নিয়ন্ত্রণ ও চলাচলে সহায়তা করবে।

বদলে যাওয়ার ইতিহাস : ১৯৫৪ সালে স্থাপিত হয় খুলনা শিপইয়ার্ড। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের আওতায় এটি পরিচালিত হতো। আশির দশক পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক পর্যায়ে ছিল। এর পর থেকে বাড়তে থাকে লোকসানের বোঝা। চরম অব্যবস্থাপনায় একসময় প্রতিষ্ঠানটি রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়। তবে সে অবস্থা এখন আর নেই। ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে হস্তান্তরের পর প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে ছোট আকারের যুদ্ধজাহাজ ‘প্যাট্রোল ক্রাফট’, ২০১৬ সালের শেষের দিকে অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ ‘লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট’ এবং চলতি বছর সাবমেরিন অপারেশনের জন্য দুটি টাগবোট নির্মাণ করেছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত এই অত্যাধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী গঠনে সহায়ক হবে। জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর খুলনা শিপইয়ার্ড ৬৪ কোটি ৬২ লাখ এবং গেল অর্থবছর ৭৯ কোটি টাকা লাভ করে।

দক্ষ জনশক্তি : জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের পাশাপাশি শ্রমিকদের বিশ্বের সব শিপইয়ার্ডে কাজ করার উপযুক্ত করে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির চেষ্টা চলছে খুলনা শিপইয়ার্ডে। একসময় এখানে দেখে দেখে শ্রমিকরা কাজ করতেন। এখন দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। খুলনা শিপইয়ার্ডের জেনারেল ম্যানেজার (উৎপাদন) ক্যাপ্টেন এম নুরুল ইসলাম শরীফ বলেন, স্থায়ী-অস্থায়ী দেড় হাজার শ্রমিক এখানে কাজ করছেন, যারা প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের সহায়তায় দক্ষ হয়ে উঠছেন। ফলে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক দক্ষ শ্রমিক যুক্ত হচ্ছে দেশ-বিদেশের শ্রমবাজারে।

শিপইয়ার্ডের সক্ষমতা : একসময়ের পিছিয়ে পড়া খুলনা শিপইয়ার্ডেই তৈরি হয় দেশের প্রথম যুদ্ধজাহাজ। প্রতিপক্ষের বিমান এবং জাহাজবিধ্বংসী ৩৭ ও ২৫ মিলিমিটারের চারটি কামান-সংবলিত এই প্যাট্রোল ক্রাফটের গতিবেগ ঘণ্টায় ২৩ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৩৭ মাইল)। পাশাপাশি ২ হাজার ২২৪টি জাহাজ মেরামত করে অনন্য নজির স্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বর্তমানে এখানে জাহাজ ডকিং-আনডকিংয়ের জন্য ৭০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন স্প্রিংওয়ে রয়েছে। জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য আটটি বার্থ আছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৪২৫ ফুট। অতি দ্রুত নির্মাণ ও মেরামতকাজ সম্পন্ন করার পাশাপাশি গুণগত মান বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা থেকে কারিগররা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর