পুরো মাথা ব্যান্ডেজ মোড়ানো, পিঠ-বুক ও দুই হাতের প্রায় পুরোটায় কালশিট। তেমন কথাও বলতে পারছেন না। দেখলেই বুঝতে বাকি থাকে না, এ শরীরের ওপর ভয়ানক তান্ডব গেছে। এ অবস্থা রাজধানীর রাজারবাগে অবস্থিত কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা পুলিশের এসআই আবদুল আল কাইয়ূমের। কোটা সংস্কার আন্দোলনে দায়িত্ব পালনের সময় দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন ৩৩৬ জন পুলিশ সদস্য।
জানা যায়, গতকাল পর্যন্ত ৬০ জন পুলিশ সদস্য কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তাদের মধ্যে চারজন আইসিইউতে ছিলেন। এদের মধ্যে একজন মারা যান। চিকিৎসাধীন অনেকের অবস্থাই গুরুতর। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, দুর্বৃত্তদের হামলায় রাজধানীসহ সারা দেশে ১ হাজার ১১৭ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩২ জন গুরুতর আহত। হামলার শিকার হয়ে মৃত্যু হয়েছে তিনজন পুলিশ সদস্যের। সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। হামলা করেছে পুলিশের ওপরও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের ওপর এমন তান্ডব তারা কখনো দেখেননি। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল ছাড়াও ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য হাসপাতালে অনেক পুলিশ সদস্য চিকিৎসা নিয়েছেন বা এখনো নিচ্ছেন।
এসআই আবদুল আল কাইয়ূম বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে কর্মরত। গত বৃহস্পতিবার ডিউটি শেষ করে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসায় ফিরছিলেন তিনি। গাড়ি থেকে নামামাত্রই পরনে পুলিশের প্যান্ট দেখে দুর্বৃত্তরা ‘পুলিশ পুলিশ’ বলে হামলা চালায়। এ সময় তার এক সহকর্মী সঙ্গে ছিলেন। দুর্বৃত্তরা উভয়কে বেধড়ক পেটায়। একপর্যায়ে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাদের গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে যাত্রাবাড়ী থানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বর্তমানে হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন কাইয়ূম। কারা হামলা করেছে জানতে চাইলে কাইয়ূম বলেন, হামলায় অংশ নিয়েছিল উঠতি বয়সের ছেলেরা। বেশির ভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর হবে। তাদের বেশির ভাগ পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ছিল। এর বেশি কিছু আর বলতে পারছি না। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের মারধর করে মাটিতে শুইয়ে দেয় তারা।
হাসপাতালের নবম তলায় সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন নরসিংদীর ইটাখোলা হাইওয়ে থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্য মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার ফাঁড়িতে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ করেই আমাদের ওপর কয়েক শ মানুষ এসে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফাঁকা গুলি ছুড়ি। এ সময় দুর্বৃত্তদের হামলায় আমরা সাত-আটজন গুরুতর আহত হই। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল ও ডিএমপিতে কর্মরত একাধিক পুলিশ সদস্য বলেন, পুলিশের ওপর এমন হামলা তারা কখনো দেখেননি। বেশির ভাগেরই মাথায় আঘাত করা হয়েছে। এমনকি ডিউটিতে না থাকলেও পুলিশ পরিচয় জানলে হামলা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও পরিদর্শন) মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, শুধু এ হাসপাতালে ৩৩৬ জন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে ৮৩ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। বর্তমানে ৬০ জন ভর্তি রয়েছেন। তাদের বেশির ভাগেরই মাথায় আঘাত করেছে দুর্বৃত্তরা। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন চারজন। এদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। দুজনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে ট্রান্সফার করা হয়। বর্তমানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন একজন।
নিহত হয়েছেন তিন পুলিশ সদস্য : নারায়ণগঞ্জের পিবিআইয়ে কর্মরত পরিদর্শক মো. মাসুদ পারভেজ ভুঁইয়া রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন। তাকে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। ট্যুরিস্ট পুলিশের এএসআই মো. মোক্তাদিরকে রামপুরা থানা এলাকায় হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ডিএমপির প্রটেকশন বিভাগের নায়েক মো. গিয়াস উদ্দিনকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়।