বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে ও অর্থনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় করতে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, (এডিবি) জাপান আন্তর্জাতিক কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), ইউএসএইড, ইউকেএইড, ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি), ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনসহ (আইএফসি) সব উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে এডিবি ও বিশ্বব্যাংকসহ এসব সংস্থা ও দেশ সহায়তা বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছে। চীন, জাপান ও ভারতের সঙ্গে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে উভয় পক্ষ। এতে ডলারের প্রবাহ বাড়বে। সামনের দিনগুলোতে যে কোনো মূল্যে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোকে অধিক সক্রিয় করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে যোগ্যতম ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট মিশনশুলোতে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কর্মকান্ডের সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। চড়া কিস্তির বিদেশি ঋণ পরিশোধ ও ডলারের সামগ্রিক চাহিদা মিটিয়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে ডলারের খোঁজে নেমেছে সরকার।
অর্থবিভাগ সূত্র জানায়, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠতে আরও এক বিলিয়ন ডলার ঋণের বিষয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে এডিবি। এরই মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা হিসেবে দেওয়ার কথা জানিয়েছে এডিবি। আশা করা হচ্ছে, বাকি ৬০০ মিলিয়ন ডলার আসবে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ও জাইকা থেকে। এ ছাড়া বাজেট সহায়তা হিসেবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে আরও এক বিলিয়ন ডলার চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান ঋণ প্রকল্প ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বাইরে আরও ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনার জন্য আইএমএফের একটি মিশন আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসছে। এ সময় প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থবিভাগ, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত আইএমএফের আবাসিক প্রতিনিধি অর্থউপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে জানিয়েছেন, চলতি বছর সেপ্টেম্বর/অক্টোবরে ঋণের চতুর্থ কিস্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। এই কিস্তির অর্থ ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়ার জন্য এখন থেকেই কাজ শুরু করেছে সরকার। তবে ডিসেম্বরের আগেও এই অর্থ পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু তাই নয়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগেই ৬ আগস্ট আইএমএফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সরকার পরিচালনায় যেই আসুক আইএমএফ বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে যাবে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও এর কোনো প্রভাব আইএমএফ অনুমোদিত ঋণের ওপর পড়বে না। উল্লেখ্য, প্রায় তিন বছর ধরে চলছে ডলার সংকট। অর্থ পাচার, ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্র্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাবে এই সংকট তীব্র হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতির কারণেও এই সংকট বেড়েছে। গত ৫ আগস্ট বিপর্যস্ত এক অর্থনীতি রেখে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি জনগনের কাঁধে রেখে গেছেন প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বিদেশি ঋণ। যা পরিশোধে চাপের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ডলারের এই সংকট সহসাই কাটছে না। তবে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মাথায় সংকট কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। যদিও ব্যাংক খাতে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকালই ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য একটি টাস্কঢেফার্স (কমিশন) গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা অর্থনীতিটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। এ জন্য দুটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। ডলার সংকট কাটাতেও আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে এ সরকার কাজ করে যাবে, যাতে অর্থনীতি সংস্কারের সঙ্গে ডলারের বাজারও স্বাভাবিক হয়ে আসে। এদিকে ৫ আগস্টের পর থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়তে শুরু করেছে। শিগগিরই রপ্তানি খাতেও আশার আলো দেখা দেবে বলে মনে করে সরকার। চলতি মাসের ২৪ দিনে বৈধপথে প্রবাসী আয় এসেছে ১৭১ কোটি ৮৩ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ২০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতিদিন প্রবাসী আয় এলো ৭ কোটি ১৫ মার্কিন ডলার। আন্দোলনের মধ্যে জুলাই ও আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রবাসী আয় কিছুটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রবাসী আয় আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতির যে সংস্কারটা শুরু হয়েছে, এটা ঠিকঠাক করতে পারলে অর্থনীতি ও দেশ ঘুরে দাঁড়াবেই। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। ডলার সংকটটা অনেক দিন ধরেই স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এটা থেকে বের হতে হলে আমাদের ডলারের চাহিদার বিপরীতে আয় বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে পাচার রোধ করতে হবে। পাচারের অর্থটা ফেরত আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্যাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে। অথচ এই রিজার্ভের পরিমাণ এক সময় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে উঠেছিল। আগের সরকারের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নেতৃত্ব আর ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সেটা ধরে রাখতে পারেনি। বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যয়ে বড় অংশের জোগান দেয় বিদেশি ঋণ সহায়তা। এ ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে সরকারের ব্যয় এখন ক্রমেই বাড়ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের অর্থ ছাড় করেছে ৫৬৩ কোটি ডলার। এ সময় সরকারকে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। সে হিসেবে অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণ হিসেবে ছাড়কৃত অর্থের অর্ধেকের কাছাকাছি (প্রায় ৪৬ শতাংশ) ব্যয় হয়েছে ঋণের কিস্তি (সুদ ও আসল) পরিশোধে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ার কারণে ডলারে প্রবাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার।