বেতন বৈষম্য, বকেয়া বেতন দাবি, ঝুট ব্যবসাসহ বেশ কয়েকটি কারণে দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক খাতে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। এর আগে গত মাসে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ওষুধ খাতের শ্রমিকরাও বিভিন্ন দাবি আদায়ে বিক্ষোভ করেন। দাবি আদায়ে বিক্ষোভ করেছেন তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরাও। শ্রমিক অসন্তোষের জেরে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে গত সপ্তাহে ২০০টির বেশি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে অস্থিরতা ও সংঘর্ষে আশুলিয়ায় এক নারী শ্রমিক নিহত হন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ বেতন কাঠামো, পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সমন্বয়ের অভাব, নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে শ্রমিকদের সুস্পষ্ট ধারণার অভাব এবং অতিরিক্ত শ্রমের কারণে শ্রমিকদের মানসিক চাপও জড়িত।
শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভের প্রথম দিকে তাদের দাবি পাত্তা না দিয়ে উসকানিদাতা, বহিরাগত হামলাকারী ও ঝুট ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভের পেছনে ইন্ধনকারী বলে দায়ী করে মালিকপক্ষ। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শ্রমিকদের দাবি আংশিকভাবে মেনে নেওয়া হয়। তবে ততদিনে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় অনেক শ্রমিক ছাঁটাই আতঙ্ক ও কাজ হারানোর আশঙ্কায় আছেন। এর আগে বেতন বৃদ্ধি, চাকরি নিয়মিতকরণ, সাপ্তাহিক ছুটিসহ ২১ দফা আদায়ে বিক্ষোভ করেন ওষুধ কারখানার শ্রমিকরা। ওষুধ খাতের উদ্যোক্তারা নিজ নিজ কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে কিছু দাবি মেনে নেন। এতে সপ্তাহখানেকের মধ্যে ওষুধ খাতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আশুলিয়ায় মোট ২০টি কারখানা বন্ধ ছিল। এর মধ্যে আগস্টের বেতন দিতে পারেনি চারটি কারখানা। তৈরি পোশাক খাতের অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু আশুলিয়া। সেখানে দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় পোশাক কারখানার অবস্থান। বিজিএমইএর কয়েকজন সাবেক সভাপতি ও বিদায়ি সরকারের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী মালিকদের কারখানাও আছে এখানে। সাধারণত এ মালিকরা মজুরিসহ অন্য আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কলকাঠি নাড়েন। আর শ্রমিক নেতারা পোশাক শিল্পের অস্থিরতা নিরসন না হওয়ার জন্য মালিকপক্ষের পুরনো কৌশলকেই দায়ী করেন। তাদের মতে, দেড় দশক ধরে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের দিয়ে ভয়ভীতি এবং মারধর ও মামলা-গ্রেপ্তার করে শ্রমিক বিক্ষোভ বা আন্দোলন দমন করেছে এসব মালিকপক্ষ।
যদিও পোশাক শিল্প মালিকরা মনে করেন, বর্তমান অস্থিরতার পেছনে বড় কারণ ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিকদের দ্বন্দ্ব। তারাই শ্রমিকদের উসকে দিচ্ছেন। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের মতো ভূমিকা রাখতে না পারায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
শ্রমিকদের শান্ত করতে ৯ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আশুলিয়ার কারখানা মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিজিএমইএ নেতারা। প্রায় ৬ ঘণ্টার বৈঠকে আশুলিয়ার শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া টিফিন বিল বাড়ানো; নারী ও পুরুষ নয়, দক্ষতার ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ এবং শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্তি বাতিল করার দাবি মেনে নেওয়া হয়। এর পরও পরিস্থিতির উন্নত হয়নি।
গত বছর নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেন। এর বিপরীতে মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব করে। প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামেন। ওই সময় তিন সপ্তাহের আন্দোলনে চার পোশাক শ্রমিক মারা যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মালিকপক্ষ নতুন করে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেন এবং সেটিই চূড়ান্ত হয়। এর পরও আন্দোলন চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ, মামলা ও গ্রেপ্তারের পথ বেছে নেয় মালিক ও তৎকালীন সরকার। তখন কারখানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ বিভিন্ন অভিযোগে শুধু গাজীপুর ও আশুলিয়ায় ৪৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় ১১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শ্রমিকদের দাবি ও অভিযোগ : আশুলিয়ার বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকদের দাবিদাওয়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কারখানাভেদে তারা ৮ থেকে ২৫ দফা দাবি জানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বার্ষিক মজুরি ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি, হাজিরা বোনাস ৮০০-১০০০ টাকা করা, টিফিন বিল ৫০ টাকা, দুই ঈদে ১২ দিন করে ছুটি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ইত্যাদি। এ ছাড়া কারখানার মধ্যমসারির কিছু কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার দাবিও রয়েছে। শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা জানান, তারা সময়মতো বেতন পান না, ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত বেতন-ভাতা থেকেও অনেকে বঞ্চিত। দাবি নিয়ে কথা বলতে গেলেই চাকরিচ্যুত করা হয় অনেককে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামো নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সরকারের সমঝোতার ভিত্তিতে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে তাঁরা কোনো জোরদার আন্দোলনে যাননি। এ ব্যাপারে শ্রমিক নেতারা বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর তাঁদের বেতন-ভাতা প্রদানের আগেই বেতন বৈষম্য মেটানোর কথা ছিল। কিন্তু মালিকদের কাছ থেকে এখন এ ব্যাপারে কোনো সাড়া মিলছে না। শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, সরকার ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামোয় সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ানো হলেও বেসিক বা মূল মজুরি কমেছে মধ্যম শ্রেণির শ্রমিকদের। ওভারটাইম ও উৎসব বোনাসের ক্ষেত্রেও তাদের ঠকানো হয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ‘পোশাক খাতে সাম্প্রতিক মজুরি বিতর্ক : কী শিখলাম’ শীর্ষক সংলাপে নিজেদের পর্যবেক্ষণেও সিপিডি দাবি করে, তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের সাম্প্রতিক অসন্তোষের প্রধান কারণ মজুরি কাঠামো নির্ধারণে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া। এতে আরও বলা হয়, নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার আগে ও পরের বিভিন্ন ধাপের কাজে যে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল তার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথার্থ প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি। মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রেডভিত্তিক তারতম্য সৃষ্টি হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে অঞ্চল ও গ্রেড ভেদে মিশ্র উপলব্ধিও জন্ম হয়। অন্যদিকে একেক কারখানায় পৃথকভাবে মজুরি বাস্তবায়ন ঘটেছে। অনেক কারখানা নতুন কাঠামো অনুসরণ করে মজুরি বাড়ায়নি।