শিশুটির নাম রাকিব। ক্লাস ওয়ানের ছাত্র। বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া মালপত্রের স্তূপে সে নিজের বই খুঁজে বেড়াচ্ছে। আচমকা পাহাড়ি ঢল ঘরের সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়ার সময় তার বই-খাতাও নিয়ে গেছে। ছোট্ট শিশু এখন কী নিয়ে স্কুলে যাবে, উত্তর জানে না কেউ। শিশুটির মা-বাবাকে দেখা গেল না আশপাশে। এক প্রতিবেশী পাশ থেকে বললেন, ‘যার ঘরবাড়ি ভাইঙা গেছে, তার হিরাবার (আবার) লেহাপড়া...।’
শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার বন্যার্ত মানুষের একটি খণ্ডচিত্র এটি। গত এক সপ্তাহে এ ধরনের অসংখ্য খণ্ডচিত্র জোড়া দিয়ে যদি উপসংহারে আসা যায়, তবে এর নাম হবে মহাদুর্যোগ। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সেই দুর্যোগ থেকে মুক্তি মেলেনি শেরপুর জেলার চার উপজেলার মানুষের। নাকুগাঁও স্থলবন্দর সংলগ্ন বাউশি গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ প্রশান্ত মারাক তার ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘পাহাইড়া ভোগাইয়ের ঢল আঙর সর্বনাশ কইরা গেছে।’ শুধু ভোগাই নয়, শেরপুর জেলার এই ভয়াবহ বন্যার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে চেল্লাখালী ও মহারশি নদীও। এর মধ্যে নালিতাবাড়ী উপজেলা দিয়ে বয়ে গেছে ভোগাই ও চেল্লাখালী আর ঝিনাইগাতী দিয়ে বয়ে গেছে মহারশি। জেলার এই তিন নদী দিয়ে গত শুক্রবার একযোগে বয়ে আসে পাহাড়ি ঢল। সেই ঢলের পানি শেরপুরের চার উপজেলা নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নকলার বেশির ভাগ মানুষের জীবনকে পাল্টে দিয়ে গেছে। কারও ঘর গেছে, কারও গেছে পুকুরের মাছ; কারও ফসলের খেত- আমূল তলিয়ে গেছে বানের পানিতে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গারো পাহাড়ের কূলে গড়ে ওঠা গ্রামগুলো থেকে পানি দ্রুত নেমে গেলেও সমতল এখনো নিমজ্জিত। নালিতাবাড়ীর যোগানিয়া, কলসপাড়, মরিচপুরান, রাজনগর- এই চার ইউনিয়নের প্রায় ১২টি গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি। শুধু তাই নয়, এই পানি গিয়ে নকলার গ্রামগুলোও তলিয়ে দিয়েছে। তলিয়ে গেছে উপজেলার ধনাকুশা, বড়ইতার, বিহারিপাড়, তারাকান্দা, ঘোনাপাড়া, উরফা, রিহিলা গ্রাম। নালিতাবাড়ী-নকলা সড়কের তালতলা বাজারের পূর্ব দিকে গেড়ামারা ও তালুকপাড়া পর্যন্ত যতদূর চোখ যায় শুধু ঘোলাটে পানি। এই পানির নিচে ডুবে আছে মাছের খামার, আমনের ফসল, শীতের শাকসবজি আর কাঁচাপাকা ঘরবাড়ি। যোগানিয়া গ্রামের সামেদুল তালুকদার বলেন, ‘বিগত ৫০ বছরেও আঙর ঘরবাড়িত পানি ওঠে নাই। এবার সবকিছু তলাইয়া গেছে। খেতের ফসল, পুকুরের মাছ কিছুই নাই।’ তিনি জানান, প্রায় ১৫ একর জমিতে আমনের আবাদ করেছিলেন। ফসলের লক্ষণ ছিল খুবই ভালো। পানি নামলেও যে এই ফসল বাঁচানো যাবে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। তার আশঙ্কা নিচু এলাকায় বানের পানি ধীরগতিতে নামার কারণে পলির নিচে চাপা পড়ে যাবে অধিকাংশ ধানের খেত।
শেরপুরের তিন বড় নদী ভোগাই, চেল্লাখালী, মহারশির পাশাপাশি পাহাড় থেকে বয়ে আসা ছোট কিছু নদী ও খালের পানিতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মালিঝি নদীর কারণে কাপাসিয়া গ্রাম, দুধুয়ার খালের কারণে পশ্চিম কাপাসিয়া ও যোগানিয়ার নিম্নাঞ্চল, ঝিনাইগাতীর সোমেশ^রী নদীর পানি দুর্ভোগে ফেলেছে উপজেলার একটি অংশের মানুষকে। কাপাসিয়া গ্রামের হান্নান অ্যাগ্রোবেইজড খামারে ১০টি পুকুরের মধ্যে অন্তত ৬টির সব মাছ ভেসে গেছে। গাগলাজানির আবদুল জব্বারের ১০ একরজুড়ে গড়ে তোলা মাছের খামারের প্রায় দেড় কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ধান ব্যবসায়ী অসীম দত্ত হাবলু বলেন, তার ১৫ কাঠা জমির ওপর গড়ে তোলা শখের মাছের খামারে ১৫ বছরের পুরোনো বড় মাছ এখন একটিও নেই। সব গেছে বানের পানিতে।
শেরপুর জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক যে হিসাব পাওয়া গেছে, সে অনুযায়ী শুধু কৃষি খাতেই ৫০০ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে। জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. সুকল্প দাস গণমাধ্যমকে জানান, শেরপুর জেলার ৯২ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছিল। গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার ২২৭ হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৫ জন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানাচ্ছে, শেরপুরে আমন আবাদ থেকে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৮৬ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বন্যার কারণে প্রায় অর্ধেক আবাদ নষ্ট হবে। ১ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন চাল কম উৎপাদনের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ফসলের পাশাপাশি মৎস্য খাতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী শেরপুরের ৩১টি ইউনিয়নে সবমিলিয়ে ৭ হাজার ৩৬৪টি দিঘি, পুকুর ও খামারের মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ ৫৩ কোটি টাকার বেশি। নালিতাবাড়ীর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাকাম হীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঝিনাইগাতীর মহারশি নদীটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চিচিংপাড়া থেকে উৎপত্তি হয়ে গারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সমতলে বয়ে গেছে। অপরদিকে ভোগাই নদী ভারতের একই রাজ্যের ভুগি নামক স্থান থেকে উৎপত্তি হয়ে নালিতাবাড়ীর ডালু-পানিহাটা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এই ভোগাইয়ের বয়ে চলার পথে ১৮৪টি ঝরনাধারা মিলিত হয়েছে। তার খুব কাছ দিয়েই বয়ে গেছে আরেক পাহাড়ি নদী চেল্লাখালী। ফলে ৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত টানা ৭২ ঘণ্টার বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল যখন এই তিন নদী দিয়ে একযোগে বয়ে আসে তখন তার বিপুল জলরাশি ধারণ করার ক্ষমতা ছিল না শেরপুরের। ফলে সেই পানি নদীর পাড় উপচে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলের খেত, মাছের পুকুর সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।