পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার ‘টালিপে’-এর মাধ্যমে দেদার লেনদেন হচ্ছে হুন্ডি। তাদের লেনদেন তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডিজিটাল পেমেন্ট বাড়াতে বাংলা কিউআর চালু করা হলেও এ কোডের অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে; যা ডিজিটাল লেনদেনের ইকোসিস্টেমে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) প্রতিষ্ঠান ‘প্রগতি সিস্টেমস লিমিটেড’-এর ই-ওয়ালেট টালিপের মাধ্যমে বেশ কিছু এমএফএস এজেন্ট পয়েন্টে বাংলা কিউআর দিয়ে অনুমোদনহীন লেনদেন করছে। এসব এমএফএস এজেন্ট পয়েন্টে ক্যাশআউট (অর্থ উত্তোলন) করতে আসা গ্রাহককে ক্যাশআউটের বদলে টালিপের বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে পেমেন্ট করতে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো পণ্য বা সেবা না কিনেই পেমেন্টের মাধ্যমে বড় অঙ্কের ডিজিটাল মানি ক্যাশে রূপান্তর করা হচ্ছে, যা অবৈধ লেনদেনকে উৎসাহিত করছে। ফলে এজেন্ট প্রথাগত ক্যাশআউট সেবা না দিয়ে পেমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে অবৈধ অর্থোপার্জনের সুযোগ নিচ্ছে। অন্যদিকে প্রগতি সিস্টেমস লিমিটেড ভুয়া পেমেন্টের বিপরীতে নির্ধারিত ফি উপার্জন করছে। এ পদ্ধতিতে ডিজিটাল মানি ক্যাশে রূপান্তর করা এমএফএস রেগুলেশনের পরিপন্থি এবং লেনদেনটি অবৈধ হওয়ায় মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের মতো গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করেছে। একই সঙ্গে বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে অনুমোদনহীন লেনদেন এমএফএস খাতের সুনামও নষ্ট করছে। টালিপের সন্দেহজনক লেনদেন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের সর্বশেষ সভায়। টালিপেকে কারণ দর্শানোর পাশাপাশি অস্বাভাবিক লেনদেন খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা গেছে, এমএফএসের ক্যাশআউটের দৈনিক লিমিট ২৫ হাজার টাকা হলেও, টালিপের বাংলা কিউআর ব্যবহার করে বড় অঙ্কের পেমেন্টের মাধ্যমে ডিজিটাল মানি ক্যাশে পরিণত করা হচ্ছে। কখনো কখনো একই ব্যক্তি এ বড় অঙ্কের (৩০ হাজার, ৫০ হাজার বা ১ লাখ টাকা) লেনদেনের মাধ্যমে লিমিটের বাইরে বিপুল পরিমাণ ক্যাশ উত্তোলন করছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ক্যাশআউট লিমিট এড়িয়ে এ ধরনের লেনদেন এমএফএসের গুরুত্বপূর্ণ ক্যাশআউট সেবা ক্ষতিগ্রস্ত করছে, ব্যবসার পরিবেশ বিনষ্টের পাশাপাশি অর্থ পাচার এবং সন্ত্রাসে অর্থায়নের ঝুঁকিও তৈরি করেছে। কারণ সার্বক্ষণিকভাবে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো লেনদেন মনিটরিং এবং কোনো সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে রিপোর্ট করে। ডিজিটাল পেমেন্টের নামে টালিপের বাংলা কিউআরের মাধ্যমে ক্যাশ উত্তোলন নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে এবং বড় অঙ্কের অর্থ উত্তোলনের কোনো প্রমাণ থাকছে না, যা ডিজিটাল লেনদেনের ইকোসিস্টেমকে বিপর্যয়ে ফেলতে পারে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, টালিপে এমএফএস এজেন্ট পয়েন্টগুলোয় বাংলা মার্চেন্ট কিউআর বসিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ লেনদেনের সুযোগ করে দিয়েছে। সরেজমিনে এ ধরনের অননুমোদিত লেনদেনের সত্যতা পাওয়া গেছে। মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকার কাদিরাবাদ হাউজিংয়ের প্রবেশপথের কাছে নিখুঁত টেলিকম। এ দোকানে টালিপের বাংলা কিউআর ব্যবহার করে চলছে অননুমোদিত পেমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে ক্যাশ উত্তোলন। কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রি না করেও দোকানটি সারা দিন বিপুল অঙ্কের অর্থ পেমেন্ট হিসেবে গ্রহণ করে তা ক্যাশ হিসেবে গ্রাহককে প্রদান করছে। একই চিত্র দেখা গেছে মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিংসংলগ্ন মজুমদার স্টোরে। শুধু এ দুটি প্রতিষ্ঠান নয়, সারা দেশে এমন অনেক এজেন্ট পয়েন্টে টালিপের বাংলা কিউআর ব্যবহার করে অনুমোদনহীন ক্যাশআউটের ব্যবসা চলছে। টালিপের বাংলা কিউআরের মাধ্যমে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়টি উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট (পিএসডি) ও টালিপেবিষয়ক সভায়ও। সভায় লেনদেনের পরিমাণ প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাখ্যা চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় এমএফএস এজেন্ট শুধু ক্যাশ ইন ও আউট কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, তাদের টালিপের মার্চেন্ট হিসেবে অনবোর্ড না করা এবং অনবোর্ডকৃত মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া যেসব মাইক্রো মার্চেন্টকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ‘রেগুলার মার্চেন্টে’ রূপান্তর করে বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) প্রদান করা হয়েছে, তাদের মাইক্রো মার্চেন্টের বিআইএন দিতে বলা হয়। বাংলা কিউআরের লোগো সম্পর্কিত নির্দেশনা অনুসরণ না করে টালিপের সুপার কিউআর দাবি করার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। সভায় টালিপেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব সার্কুলার ও লাইসেন্সের শর্তাবলি মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে টালিপেকে এ বিষয়ে সতর্কীকরণ চিঠিও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রগতি সিস্টেমস লিমিটেড টালিপে চালুর আগে পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর (পিএসও) হিসেবে লাইসেন্স নিয়ে ‘শিওর ক্যাশ’ নামে একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকসহ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদান করেছে। হঠাৎ কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় ‘শিওর ক্যাশ’, যার ফলে হঠাৎ করেই বিপাকে পড়ে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো।