সেই ১৯৪৯ সালে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় কবিতাটি আমাদের পাঠ্যসূচিতে ছিল। তখনকার প্রায় সব গল্প-কবিতাই ছিল হিতোপদেশমূলক। আর গল্প বা কবিতার শেষে সন্নিবেশিত থাকত গুটিকতক প্রশ্ন, যার ভেতর একটি প্রশ্ন ছিল প্রায় অবধারিত : গল্পটি/কবিতাটি পাঠ করিয়া কী শিক্ষা পাইলে?
জীবনের সেই ঊষালগ্নে যা-ই পাঠ করতাম তা একেবারে মর্মমূলে গেঁথে যেত। যে শিশুপাঠ্য কবিতাটির কথা বলছি, সেটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা।
শুরুর দিকের দু’টি চরণ সব সময় আওড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। শুরুর সেই চরণ দুটি হচ্ছে : ‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’ শুধু আওড়ানো নয়, আমি কথাগুলো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। আর সেই বিশ্বাস থেকেই আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে একটা নাতিদীর্ঘ কবিতা লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল : ‘মানুষের আদি পরিচয়’।
পাঠকের সানুগ্রহ সম্মতি নিয়ে ওই কবিতাটি থেকে কটি লাইন উদ্ধৃত করছি : ‘...তা হলে দেখতে তুমি চামড়ার মলাটের নিচে/নীল নয় কালো নয় সবুজ হলুদ নয় একই লাল রক্ত বয়ে যায়/আর সব মিছে...’। কবিতাটির শেষ দু’টি লাইন : ‘কালো নয় সাদা নয় ইষ্টনামে কোনো কষ্ট নয়/মানুষের একটাই নাম সে মানুষ/এটাই তার আদি পরিচয়।’ (মোফাজ্জল করিম : দিনগুলি রাতগুলি। ‘মানুষের আদি পরিচয়’।
অনন্যা ২০১৩।)
কদিন ধরে বাংলাদেশে নানাবিধ অপতৎপরতার আলামত লক্ষ করছি। ৫ আগস্টের আকস্মিক ‘পতন ও মূর্ছার’ পর বর্তমান জনসমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জনপ্রিয়তাকে যারা ভালো চোখে দেখছে না, তারা অবশ্যই তক্কে তক্কে আছে কী করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে ল্যাং মারা যায়। পট পরিবর্তনের অস্থিরতার কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাময়িক অবনতি, তথাকথিত সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগমনের সঙ্গে আরেকটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু সৃষ্টি করা হলো। সেটা কী? না, সনাতনধর্মী নাগরিকদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান সর্বজনীন দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ সৃষ্টির পাঁয়তারা।
যারা বর্তমান সরকারকে নানাভাবে বিব্রত করতে চায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে করতে চায় হেয় প্রতিপন্ন, তারা এখানে-সেখানে ছোটখাট দু’চারটি দাঙ্গা বাধিয়ে সারা বিশ্বকে দেখাতে চাইল বর্তমান সরকারের আমলে এ দেশে সনাতনধর্মীদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু সরকারের তাত্ক্ষণিক দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে বিশ্ববাসী দেখল বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্ট হওয়ার মতো তেমন কিছু ঘটেনি। যে দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে, তা সরকারের দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সময়োচিত তৎপরতার কারণে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। সত্যি বলতে কি, দেশে যে কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা দেশের আপামর জনসাধারণ টেরই পায়নি।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ টের না পেলে কী হলো, যারা বাংলাদেশের যেকোনো নেতিবাচক সংবাদ সম্প্রচারের জন্য ছোঁকছোঁক করতে থাকে, বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে একটি সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির দেশ হিসেবে চিত্রিত করতে সর্বদা তৎপর, তারা ঠিকই তিলকে তাল বানিয়ে সেই তালের পিঠা বাজারে হাজারে হাজারে ছাড়ল। তারা কারা? হ্যাঁ, তারা আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম নিকটতম প্রতিবেশী, যাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আমরা গত ১৫/১৬ বছর ‘চাহিবামাত্র’, কখনো না চাইতেই দিয়ে আসছি, তারা। তাদের গণমাধ্যম বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কাল্পনিক কাহিনী এমন রংচং চড়িয়ে প্রচার করতে শুরু করল, যেন এ দেশে রীতিমতো দাঙ্গা বেধে গেছে। এরূপ ভিত্তিহীন মিথ্যা কাহিনীর পরিণতি কী হতে পারে, তা তারা একবারও ভেবে দেখল না। তাদের দেশের একটি শ্রেণি তো নাচইন্যা বুড়ি সেজে বসেই আছে। তার ওপর এ রকম ঢোলের বাড়ি শুনলে তো তারা আরেকটা ২০০৬ সালের গুজরাট-ট্রাজেডি বা তাদের দেশে অতীতে সংঘটিত ভূরি ভূরি সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞ ঘটাতে পারে। আর গুজরাট-কারবালার খলনায়ক তো আজ দীর্ঘদিন যাবৎ তাদের রাষ্ট্রের মহানায়ক। অতএব, বন্ধুরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, এ ধরনের প্রচার-প্রচারণার আগে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে দয়া করে তা বিবেচনা করবেন।
অথচ বাস্তব চিত্র হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের গর্ব করার মতো যেসব বিষয় আছে, আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তার অন্যতম। আবহমানকাল ধরে এই শতকরা ৯০ জন মুসলমান অধ্যুষিত ভূখণ্ডে সব ধর্মের, সব জাতির, সব বর্ণের মানুষ পরস্পর পরস্পরকে ভালোবেসে, সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে, সৎ প্রতিবেশীর মতো বসবাস করে আসছে। ব্রিটিশ শাসনের (১৭৫৭-১৯৪৭) প্রায় দুই শ বছর বা তার আগে মুসলিম শাসনামলে এই দেশে কখনো কোনো সাম্প্রদায়িক গোলযোগের কথা শোনা যায়নি। এমনকি পাকিস্তানিদের কালিমালিপ্ত শাসনকালেও (১৯৪৭-১৯৭১), আর যাই হোক, সংখ্যালঘু নির্যাতন বা উত্পীড়নের কোনো ঘটনা ঘটেনি। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম ছিল দেশভাগের পূর্বক্ষণে নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যা সংঘটিত হয়েছিল কলকাতার হিন্দু-মুসলিম রায়টের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। পরবর্তীকালে ১৯৬৪ সালে যখন ভারতের আহমাদাবাদে (গুজরাট) মুসলিম নিধন শুরু হয়, তখন ঢাকা শহর ও নারায়ণগঞ্জে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। তবে তা পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) আর কোথাও ছড়িয়ে পড়েনি। প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি মুসলমান সমাজপতিদের দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকার কারণে ওইসব ঘটনা দাঙ্গার রূপ নেয়নি। এক কথায়, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এ দেশে বসবাসকারী দুই প্রধান জাতি মুসলমান ও হিন্দু পরস্পর পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন নয়, ভ্রাতৃপ্রতিমভাবে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, বুকের রক্ত দিয়ে স্বাধীন করেছে দেশ।
একটা কথা প্রায়ই গুঞ্জরিত হতে শোনা যায়। যদিও এ ব্যাপারে কখনো কাউকে ঝেড়ে কাশতে দেখা যায় না। এ দেশের সনাতনধর্মীদের দেহ নাকি বাংলাদেশে আর প্রাণটা সীমান্তের ওপারে। বিশেষ করে বর্ণহিন্দু, বিত্তশালী ও উচ্চশ্রেণির নাগরিকদের সম্বন্ধে অনেকেই এরূপ ধারণা পোষণ করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমনটা মনে করি না। জন্মভূমির প্রতি টান, মায়া-মমতা, অন্ধ ভালোবাসা—এগুলো সহজাত বলে আমি মনে করি। তবে হ্যাঁ, নানা কারণে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। তাই বলে ঢালাওভাবে এটা বলা ঠিক না যে সনাতনধর্মীদের বাইরে বাংলাদেশ, আর অন্তরে ইন্ডিয়া। আর যার বা যাদের এই ব্যাধি আছে তাদের আমি বলব, আপনার জীবনে-মরণে, সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে আপনি কাকে হাতের কাছে, বুকের কাছে পান? নিশ্চয়ই আপনার বাংলাদেশি প্রতিবেশীকে, বন্ধুকে। কার উন্নতিতে আপনার উন্নতি, কার সুনামে আপনার সুনাম? নিশ্চয়ই আপনার জন্মভূমি বাংলাদেশের। তা হলে ওই প্রতিবেশীর প্রতি গোপন প্রেমে মজে থাকবেন কেন? আর যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ (শতকরা ৯০ জন) মুসলমান তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমাদের দেশের সংবিধানে, সব আইন-কানুনে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘিষ্ঠ, মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ইত্যাদি বলে কোনো বিভাজন নেই। সংবিধানের দৃষ্টিতে, আইন-কানুনের নিরিখে দেশের সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি, ধনী-গরিব, আতুর-ল্যাংড়া সবাই সমান। অতএব কেউ কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করার কিছু নেই।
সম্প্রতি ধর্মীয় কারণে যেসব সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা, মন্দির আক্রমণ, প্রতিমা ভাংচুর ইত্যাদির ঘটনা ঘটেছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। এগুলো যারা করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদানের জন্য পুলিশের তৎপরতা প্রশংসনীয়। স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, পুলিশের আইজি ও অন্য কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন করে সনাতনধর্মী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন, দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন—এসবই নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও তাঁদের যথাযথ ভূমিকা পালন করছেন। ভালো কথা। তবে সব কথার শেষ কথা, জনমত ও জনগণের ভূমিকা। সাধারণ মানুষ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তা তো আমরা ‘জুলাই ৩৬’-এর আন্দোলনে দেখেছি। তা হলে আসুন না, আমরা একযোগে সাম্প্রদায়িক আসুরিক শক্তিকে প্রতিহত করতে সঙ্ঘবদ্ধ হই এবং আওয়াজ তুলি : এ দেশ তোমার আমার সকলের। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ভাই ভাই/এ দেশে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের ঠাঁই নাই।
জনগণের ভূমিকার কথা বলতেই এবার একটা অভিনব ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী যারা গত জুলাই-আগস্টের স্বৈরাচার খেদাও আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল, তারা এবারও মন্দির-প্রতিমা রক্ষার দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে। তাদের সঙ্গে ছিল সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মীরা। তবে সবচেয়ে প্রশংসনীয় ছিল মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা। তাঁরা ইসলামের মূল আদর্শ তথা পবিত্র কুরআনের বাণী ‘লা ইকরাহা ফিদ্দীন’ (ধর্মে জোর-জুলুম নেই) এবং ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন’ (তোমাদের ধর্ম তোমাদের কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে) হৃদয়ে ধারণ করে সনাতনধর্মীদের মন্দির ও বিগ্রহ পাহারা দিয়ে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ফলে দুষ্কৃতকারীরা তাদের অপতৎপরতা চালাতে সাহস পায়নি। তবে মাদ্রাসা-ছাত্র ও ধর্মীয় নেতাদের এই দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ভূমিকা গণমাধ্যমে যতটুকু প্রচার পাওয়া উচিত ছিল, দুঃখের বিষয়, তা পায়নি।
এ প্রসঙ্গে একটা চটুল শ্লোগানধর্মী বক্তব্য সম্বন্ধে দুটো কথা বলতে চাই। দুর্গাপূজা এলেই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে অনেক সংস্কৃতিকর্মীকে বলতে শোনা যেতো : ধর্ম যার যার, উৎসব সকলের। এই বক্তব্য দিয়ে পূজামণ্ডপে গিয়ে সনাতনধর্মী ভাইবোনের সঙ্গে যোগ দিয়ে প্রতিমাদর্শন প্রসাদভক্ষণ, নৃত্যগীতে অংশগ্রহণ ইত্যাদিকে ‘জায়েজ’ করার একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত লক্ষণীয় ছিল। আমি মনে করি, এটার কোনো দরকার ছিল না। এতে বরং এক শ্রেণির ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মনে অহেতুক আঘাত দেওয়া হতো। এরূপ সস্তা মতবাদ, যা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে, প্রচার না করে বরং সনাতনধর্মীদের পূজা যাতে আনন্দঘন অনুকূল পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় সেটা নিশ্চিত করা উচিত।
উপসংহারে বলব, বাংলাদেশের ঐতিহ্য বজায় রেখে আসুন, সবাই মিলে আমাদের গৌরবের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখি। সজাগ থাকি গোলযোগ সৃষ্টিকারী মতলববাজদের অপতৎপরতার ব্যাপারে।
সনাতনধর্মী ভাইবোন ও অন্য সবাইকে জানাই শারদীয় শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাকুন, সুখে থাকুন। শেষ করি মহামতি গৌতম বুদ্ধের বাণী দিয়ে : জগতের সকল প্রাণী সুখে থাকুক।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
[email protected]