হালকা বাতাসের সঙ্গে টিপ টিপ বৃষ্টিও। গরুটাকে কেবল বাইরে বের করে নিয়ে জাম গাছটার সঙ্গে বেঁধেছিল। মাথায় পড়ল বৃষ্টির ফোঁটা। বের করার আগে বাতাস থাকলেও আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে মনে হয়নি যে বৃষ্টি নামবে। খণ্ড খণ্ড মেঘ হেসে খেলে বেড়াচ্ছিল আহ্লাদী বাতাসের সঙ্গে। খুনসুটিও ছিল সামান্য! প্রাণভরে মেঘের এই লীল খেলা দেখার সাধ হলেও উপায় ছিল না কোরপুলের। গাছের সঙ্গে দড়ি বাঁধার সময় গিট্টুটা শক্ত হয়েছে কিনা বারদুয়েক দেখে খড় আনতে বাড়ির ভিতর এগোতেই বৃষ্টির ফোঁটা শুরু। গোয়াল ঘরের দিকে না গিয়ে আবার জাম গাছের কাছে ফিরে আসে সে। ওপরে তাকিয়ে দেখে। ঘন বৃষ্টির লক্ষণ মনে না হলেও মাথা ঢেকে রাখা শাড়িতে বৃষ্টির ফোঁটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। বড় ছেলে গ্রামের হাঁটে গেছে ঘণ্টা দুয়েক আগে, ছোটটা শহরে চাকরির পরীক্ষা দিতে। এ নিয়ে পাঁচবার তো হবেই। লেখাপড়া না জানলেও হিসাব মনে রাখতে পারে সে। ক্লাস ফোর পর্যন্ত উঠেছিল। পড়তে ভালো লাগেনি কখনো। আল-পাথার ঘুরে বেড়িয়ে কোনো গাছের নিচে বসে, কুড়িয়ে আনা এটা ওটা চিবোতে ভালো লাগত। দুপুর রোদেও কাকের ক্রমাগত কা কা শুনতে খারাপ লাগেনি কখনো। গরু চড়ানো ছেলেদের বা ধান কুড়ানো মেয়েদের সঙ্গে গল্প করার আনন্দই ছিল আলাদা।
দুই মেয়ে যার যার শ্বশুরবাড়ি। সবাই বাড়ি আসবে কোরবানি ঈদ উপলক্ষে। এসেই তুলকালাম শুরু করবে! ছোটটা প্রথমেই কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে পুকুর পাড়ে! ভাইয়ের ওপর খবরদারি করতে! ছেলেমেয়ে নিয়ে কোরপুলের অতিরিক্ত কোনো আহ্লাদপনা নেই।
জাম গাছটা নতুন। গত বছর প্রথম অল্প কয়েকটা জাম ধরেছিল। এবারেও ধরেছে সামান্য, আকারেও ছোট। গতবারের দু-একটি মুখে দিয়ে কষ্টা মনে হয়েছিল। জাম গাছের জাতটা ভালো লাগানো হয়নি বলে তার কোনো ক্ষোভ হয়নি।
ছেলেরাই দুটো ছাগলসহ গরুটা দেখেশুনে রাখে। আরও একটা গরু ছিল যেটি ১০ দিন আগে বিক্রি হয়েছে। প্রতিবারই দু-তিনটে ছাগলসহ দুটো গরু পোষে তারা, কোরবানি ঈদে বিক্রি করার জন্য।
জাম গাছের পাশেই চাল কুমড়োর একটা মাঁচা। মাচার আশপাশে বেশ কটা মানকচুর গাছ অনেকটাই বড় হয়েছে। ছোট কচুর শাকও আছে নালার পাশ দিয়ে। নালা কাটা হয়েছে সামনে প্রায় ছয় বিঘা জমিতে পানি দেওয়ার জন্য। পুরো জমিতে হালকা হলুদ ধান গাছ। পরশু রাতের প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির কারণে কিছু ধানগাছ মাটিতে গড়িয়ে পড়লেও বাকিগুলো সোজা আসমানের দিকে।
বাড়িটিতে দুটো আম গাছসহ প্রায় সব গাছপালাই বছর চারেকের। শুধু একটি পুরান ঘর ছাড়া। যেটিতে মেম্বার সাহেব কোরপুলের সঙ্গে সংসার শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয় সংসার। চারটি ছেলেমেয়ে রেখে প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর। জমিজমা খুব বেশি না হলেও একেবারে কম ছিল না, তাই শুধু সংসারেই নয়, গ্রামেও প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। লম্বা চওড়া, আধা কেজি দুধ ও এক কেজির বেশি গরুর মাংস খেতে পারতেন। এরকম একজন মানুষের সঙ্গে কোনোরকম উচ্ছ্বাস ছাড়াই ১৭ বছরের কোরপুলের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের আগে শুধু জেনেছিল লোকটার ছেলেমেয়ে আছে বউ নেই, জমিজমা অনেক। এর বেশি জানার অধিকার বা ইচ্ছে কোনোটারই প্রয়োজন হয়নি বরং এক ধরনের প্রশান্তি জড়ো হয়েছিল এই ভেবে যে, তারও একটা সংসার হচ্ছে! আগে দুনিয়াটাকে সবচেয়ে খারাপ জায়গা মনে হলেও বিয়ের কথাবার্তা শুরুর পর থেকেই ভাবনাটাতে নাচন ধরেছিল!
পুরান ঘরটাতেই চার ছেলেমেয়ের জন্ম দিলেও চতুর্থজন জন্মানোর আগেই মাতবর সাহেব চলে গেলেন। পরপারে। যাওয়ার আগে প্রেম-প্রীতি খুব বেশি দিতে না পারলেও বাড়ির এই জায়গাসহ আট বিঘা জমি লিখে দিয়েছিলেন কোরপুলকে। তাতেই গর্বে নাকের পাটা ও গলার হাড় অনেকটাই ফুলে উঠেছিল! নতুন ঘরটির ভিত শুরু হয়ে চারধারের দেওয়ালগুলো শেষ না করতেই সব শেষ! ভাগে আরও জমিজমা পাওয়ার চিন্তা মাথায় ঢুকানোর চেষ্টা করেছিল আত্মীয়স্বজন, কোরপুল গা করেনি। তবে আগের ছেলেমেয়েরা তাকে একেবারে ঠকায়নি, বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া ছোট একটা পুকুরসহ বাড়তি খানিকটা জায়গা দিয়েছিল। সেই পুকুরেই মাছ চাষ করে দিন চলে যাওয়ার মতো রোজগার করে বড় ছেলে। পুকুরের চারপাশে আম-কাঁঠালের গাছসহ আখও লাগিয়েছে কয়েকটা। কোরপুল পছন্দ করে তাই। শাকসবজিও থাকে। তবে মেয়ে দুটিকে ছেলের মতো গাছপালা কিংবা রান্নাঘর নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেয়নি সে, বুবুদের মতো করে বড় করেছে। ওই বাড়ির বুবুদের আম্মা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য যেমন করে বকাবকি করতেন, কোরপুলও সেভাবেই করেছে। মেয়ে দুটি বিএ পাস করার পর বিয়ে দেওয়াতে তার মতো দোজবর নয়, সমবয়সী ও সচ্ছল জামাই-ই পেয়েছে মেয়েদের পছন্দে।
মা, ছাদ দেওয়া সম্ভব নয়। অত টাকা কই হামার? বলেছিল বড় ছেলেটি।
দরকার নেই। দেওয়াল দিয়ে ছাদ টিনের হোক। ঘরগুলান উঠুক তো তাও। কিন্তু বাথরুমোত টাইলস চাই-ই ব্যাটা!
বুবুর শ্বশুরবাড়ির বাথরুমটা তাকে খুব টেনেছিল! সুইচবোর্ড ইত্যাদি জিনিস অনেকটাই নিম্নমানের কেনাতে পুরো খরচটা সহনীয় হলো। টাইলস লাগানো থেকে শুরু করে সব কাজেই বাড়তি লোক না নিয়ে নিজেই অনেকটা খেটেছিল ছেলেটা। ছোটটা আবার সেরকম হয়নি। কোদালে তিন কোপ দিলেই কোমড় ধরে দাঁড়িয়ে ‘ও মা-গে’ বলে আকাশ দেখে! প্রতি ঈদে দুটো গরু বেঁচে নিজেরা কারও সঙ্গে একটি ভাগ দিয়ে সমাজ রক্ষা করে কোরপুলারা। এবার অবশ্য একটা বেচলেও অন্যটি নিজেরাই রাখবে ঠিক করেছে। নিজেরা বলতে ঠিক নিজেরা নয়, কোরপুলের ওই বাড়ির বুবু এবার এখানেই ঈদ করার মনস্থ করায় এ সিদ্ধান্ত।
কোরপুল, তোদের সঙ্গেই ঈদ করার সিদ্ধান্ত নিছিরে। ছেলেমেয়ে দুটোই বিদেশে, আমরা বুড়োবুড়ি এসব আর করতে পারি না। এতো ঝামেলা টানার শক্তি নাই এখন। কাজের লোকও পাওয়া যায় না। তোর বেটা আসছিল সেদিন, সব শুনে ওই বলল, কেনেহ চিন্তা করছেন খালু, হামার ঐঠে চলে আসেন। হামরা আছি না! নিজের বেটাবেটিই সব, হামরা বুঝি কেউ না? হামাক নিয়া এখন থাকেন খালু।
বুবু আর বুবুর স্বামীর জন্য এবারের ঈদ তাদের কাছে স্পেশাল। কোরপুল ওই বাড়ির পালিত কন্যা হলেও এবং রক্তের সম্পর্কের না হলেও তারা ছাড়া তেমন কোনো আত্মীয়স্বজনকে ছেলেমেয়েরা চেনে না।
ওই সময়ে, মানে কোরপুলের বয়স যখন চার কী পাঁচ, বাবা মারা যাওয়ার পর মা যখন তাদের তিন ভাইবোনকে ফেলে একজনের সঙ্গে কোথায় হারিয়ে গেলেন, কেউ খোঁজ নেয়নি। বাড়িতে চাচা চাচি ছিল, ঠিকমতো খেতেই দিচ্ছিল না। মা পালিয়ে গেলে ছেলেমেয়েকেও খারাপ বলা হয়, সেই ছুঁতোয়! অথচ তাদের বাবার জমিজিরাত কম ছিল না। মনে আছে, চাচি বলতো, পালানঠি, নষ্টা মায়ের বেটাবেটিক দেখি কী হবে?
ক্ষুধা পেটে দুই বোন এই গাছ সেই গাছের নিচে ঘুরে বেড়াতো আর মনে মনে মাকে সেও চাচির গালিটাই দিত! একদিন ঘুরতে ঘুরতে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে ওই বুবুদের বাড়িতে হাজির হলে পেটপুরে খেতে দিয়েছিল ওরা। বাবাকে নাকি চিনতো ওই বাড়ির আব্বা। ওইদিন দুই বোনে খেয়েদেয়ে চলে গেলেও তার পরদিন কোরপুল একাই হাজির হয়েছিল বাড়িটিতে। খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়ি ফেরার কথা বললে কোরপুল চুপচাপ মাথা নিচু করে বসেছিল। এতে বাড়ির সবাই অবাক ও নিমরাজি হলেও, আব্বা মানুষটি বলেছিলেন, থাক, বাচ্চা মানুষ, যে কয়দিন থাকিবার মন চায়, থাকুক। ভাইবোনের কথা মনে হইলে আপনা থেকেই চলে যাবে। তার কানে এখনো স্পষ্ট বাজে, ‘যে কয়দিন থাকিবার মন চায় থাকুক।’ এই একটা কথাতেই শরীরের সমস্ত শক্তি বুকের ভিতর জমা করে থেকে গিয়েছিল কোরপুল।
কেউ খুঁজতে আসেনি তাকে। এমনকি নিজের বোনটিও। শেষমেশ বুবুদের বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল কোরপুল। বড় হতে হতে আব্বা, আম্মা, বুবু, বড়দা, ছোটদা সবাইকে একবারের জন্যও আর পর মনে হয়নি। মাটির ঘরে পাটিতে মাদুর পেতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসলে আব্বা বলতেন, কোরপুল, কী নিবু তুই? কিছু লাগিলে কহিস, শরম করিস না। খুব টানতো কথাটা।
তবে সবার সঙ্গে পড়তে বসার বিষয়টি তাকে টানতো না। দু-একদিন স্কুলে গিয়েছিল। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকরাও মায়ের কথা তুলে বিদ্রƒপ করত। তাই স্কুলের বদলে আম্মার কাজের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে পছন্দ করত কোরপুল। আম্মার তেল হলুদ মরিচ মাখা শাড়ির আঁচলের ঘ্রাণ ভালো লাগত তার। আব্বা ঘরে ফিরলে পানি, গামছা এগিয়ে দিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়াতে ভালো লাগত। আব্বা যখন বলতেন, কিরে বেটি, স্কুল যাবা নাইস? মাথা নাড়তো কোরপুল। আব্বা মৃদু হাসতেন। সেই হাসিই তাকে আশকারা দিলেও বাড়ির একটা জিনিস পীড়া দিত খুব! স্কুল থেকে ফেরার পর কোরপুলকে দিয়ে বুবুর এটা ওটা কাজ করিয়ে নেওয়া! মেনে নিতে পারত না! পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন হওয়াতে বুবুকে বেশ অহঙ্কারীও মনে হতো তার।
তাই বুবুর বিয়ের মাস কয়েক বাদেই আব্বা যখন বিয়ের কথা বললেন, বরের বয়সের কথা শুনেও তোয়াক্কা না করে হ্যাঁ বলেছিল সে। বুবুর ঝকমকে বিয়ের শাড়ি, গয়না, এমনকি বুবুর স্বামীও তাকে খুব আকর্ষণ করেছিল! বুবুর হাতের মেহেদির ঘ্রাণ, পায়ের আলতা, গলায় মোটা চেন সব কিছুই! বিয়ের পর সকালবেলা বুবুকে এলোচুলে ঘর থেকে বের হতে দেখে শরীরে আউলা একটা অনুভূতি হয়েছিল তার। চুলের ডগা বাতাসে কেঁপে উঠে বুকের পাশে মোচড় দিচ্ছে, কোথাও গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে, কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে, কানের পাশ দিয়ে শোঁ শোঁ বাতাস বয়ে যাচ্ছে, এমনটাই মনে হতো সে সময়!
আসলে এরকম একটা ডানা ঝাপটানো সময়ে মাতবর সাহেবের সঙ্গে বিয়ে তাকে ‘পালানঠি ও নষ্টা মায়ের বেটি’র বিবমিষা থেকে বের হতে সাহায্য করেছিল। লাল শাড়ি, কয়েকখানা চুড়ি আর কাজলদানির কাজল চোখে মাতবর সাহেবের হামলে পড়াকে তাই খুব সহজভাবেই মেনে নিয়েছিল সে। আসলে যে ভয়ে সে খানিকটা কুঁকড়ে ছিল তার পুনরাবৃত্তি না ঘটাতেই স্বস্তিবোধ করেছিল সবচেয়ে বেশি।
‘না না, কোরপুলক মুই মোরঠে শুতিবার দিম নাই, ওর শরীলত গন্ধ!।’ বুবুদের বাড়িতে সেই প্রথম রাতে। বুবুর পাশেই আম্মা তার ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে চাইলে এভাবেই বলেছিল বুবু, যা কখনোই কোরপুল ভোলে না। এতে খুবই অসহায় বোধ করলে নিজের মাকে আবার গালি দিয়েছিল। কিন্তু না, মাতবর সাহেব তেমন কিছু বলেননি বরং উল্টোটাই করেছিলেন! মনে আছে, বিয়ের দিন গোসলের সময় সুগন্ধী সাবান ঘষেছিল কয়েকবার। আতরও মেখেছিল খানিকটা। কারণ শরীরে গন্ধের বিষয়টি নিয়ে সংকুচিত ছিল কোরপুল।
তবে খুবই আশ্চর্যের বিষয়, বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই কোরপুল তার ভিতর একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করে। মনে হয় কী যেন একটা ভর করে তার ওপর। ক্রোধ আর ঈর্ষার মতো বিষয়গুলো সরে যাচ্ছে পরিষ্কার বুঝতে পারে। মায়ায় জড়ানো বিষয়টিও দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হলে এক সময় মাকেও সে মাফ করে দেয়!
বুবুদের এখানে আসার খবরে তাই সন্ধ্যার পর পুরো গ্রামে নিস্তব্ধতা নেমে এলে যেমন লাগে, তেমনটা মনে হয় তার। সুনসান! যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। দ্রুত বৃষ্টি মাথায় গোয়ালঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে আসে কোরপুল। টাইলসের বাথরুমে সময় নিয়ে হাতমুখ ধোয়। ছোট্ট বেসিনে মোড়ক খুলে নতুন সাবান রাখে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছে ট্রাঙ্ক থেকে নতুন বিছানার চাদর বের করে ট্রাঙ্কের ওপর রাখে। কাল সকালে বিছাবে। বুবুরা এলে এই ঘরেই থাকতে দেবে। কোরপুলের গরিব পালঙ্কে বুবু যেন কোনো গন্ধ না পায়!