এতক্ষণ পর আমি এই ওসমান গনিকে নিয়েই প্রমোদ গুনি। তার বুঝি কৌতূহলের সীমা নেই, প্রশ্নের শেষ নেই। জিভের ডগায় লেগে থাকা কনডেন্সড মিল্কের চায়ের স্বাদ এতক্ষণে ভীষণ তিতকুটে বিস্বাদ মনে হয়। পেটের ভেতর থেকে গুলিয়ে উঠতে চায়। নিরুপায় হয়ে আমি অনুরোধ করি,
আপনি অফিসে যান, আমি একটু পরে আসছি।
পরে মানে! ওসমান গনি খুব বিস্মিত এবং বিচলিত বোধ করেন- বারোটা বাজতে আর দেরি আছে নাকি!
বাজুক বারোটা। আমি আসছি।
ওসমান গনিকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে আমি ডাইনের গলিতে ঢুকে পড়ি।
আট
সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় টো টো করে ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার আগে যখন বাসায় ফিরি, তরুর মুখোমুখি হই, তখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, তরুর চোখে-মুখে সজল মেঘের ছায়া থমকে দাঁড়িয়ে। আমি আগেই অনুমান করেছিলাম বাসার আবহাওয়া এর চেয়ে অনুকূল পাব না। আমাকে বৈরী আকাশেই ফুল ফোটাতে হবে। ঝড়ের মুখেই আমাকে বাতি জ্বালাতে হবে।
আমি এক ফুৎকারে সমস্ত মেঘ উড়িয়ে দিতে চাই। আকাশে রচনা করতে চাই পুষ্পোদ্যান। জুয়েল আইচের বিমল হাসিটি আমার মুখে টেনে এনে নাটকীয় ভঙ্গিতে আমি ঘোষণা করি-এতদিনে কপাল ফাটল তরুবিবি! এবার চাকরিটা না হয়ে যায় কোথায় দেখছি। হুঁ হুঁ, এবার চাকরিটা না হয়ে যায় কোথায় দেখছি।
তরু সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি কলার ঝাঁকিয়ে ডাঁট নিই, এখন থেকে আমারও দশটা-পাঁচটা, হ্যাঁ।
তরু এগিয়ে এসে আমার ঘামে ভেজা শার্ট খুলে নেয়, ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দেয়, অতঃপর আমাকে দুহাতে ধরে এনে ফ্যানের তলে বসিয়ে বলে,
ইস্! ঘেমে নেয়ে একাকার! যা গরম পড়ছে সারা দিন!
আমি গরমকে পাত্তাই দিই না,
দূর! দূর! গরম কোথায়! বল-ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
সত্যি বলছ, ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে?
ভালো বলে শুধু ভালো! একেবারে ফাইনাল।
ফাইনাল? কী রকম ফাইনাল?
আরে সব ইন্টারভিউ তো মোটামুটি ভালোই হয়, এবার ওই ইন্টারভিউ বোর্ডে বসেই আলোচনা হয়ে গেল-আমি কবে জয়েন করব, কমপক্ষে তিন বছর এখানে থাকব কি না, এই সব আর কী!
তাহলে তো ফাইনালই বলা যায়।
তবে আর বলছি কী!
এই সুখবরটা দিতেও গেলে না আমাদের অফিসে?
কী মুশকিল! তুমি তখন কোথায়! এসব চূড়ান্ত আলাপ তো হলো বেলা ৫টার পরে! আমাদের চারজনকে ৫টার পরে ডাকা হয় আলাদাভাবে। বুঝেছ?
কালো বেড়াল শেষে ধরা দিল তাহলে!
আমরা দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠি হা হা করে। সম্মিলিত হাসির দাপটে ঘরের আলো বাতাস নেচে ওঠে, জানালা দরজা ঝন ঝন করে কেঁপে ওঠে। হাসির গমক কিছুটা স্তিমিত হলে তরু আমার কাঁধে হাত রেখে জানায়,
কী কপাল দ্যাখ-তোমার ওই কালো বেড়াল কিন্তু একা আসেনি। ওর একটা সঙ্গীও আছে, জোড়া ধরে এসেছে।
আমি এ কথার মোটেই মাথামুণ্ডু বুঝতে পারি না। চোখ গোল করে তাকাই, তার মানে?
মানে হচ্ছে-তোমার জন্য আরও একটা চাকরির ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে, অল্প দিনেই হয়ে যাবে।
তাই নাকি!
দেবুদা তো তাই বললেন।
অ। দেবুদাকে তুমি এসব বলতে গেছ?
এসব মানে? আর আমি বলতে যাব কেন, তোমার সঙ্গেই তো দেখা হয়েছিল তাঁর।
হ্যাঁ, দেখা হয়েছিল ঠিকই, তাই বলে তো চাকরি ভিক্ষে চাইনি।
ছি! সোনামণি! এ কী কথার ছিরি! তোমার কি ধারণা-আমিই দেবুদার কাছে চাকরি চেয়েছি তোমার জন্য?
তুমিই জানো কী চেয়েছ তার কাছে!
সোনামণি, তুমি বোধহয় অসুস্থ। ওঠো, বাথরুমে যাও। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হও। খেয়ে দেয়ে রেস্ট নাও। ওঠো তো!
তরু আমার হাত ধরে এক রকম জোর করেই বাথরুমে ঢুকিয়ে দেয়।
বাথরুমে ঢোকার পর আমার প্রথমে বিবমিষার উদ্রেক হয়। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার ওয়াক ওয়াক করে বমনের চেষ্টা নিই। হয় না কিছুই। তখন আমার কান্না পায়। ভীষণ কান্না পায়। অনেকক্ষণ ধরে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
কেন এই কান্না, কারও কাছে সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার দায় আমার নেই। আমার ভালো লাগছে না। ভেতরে রক্তক্ষরণ নিয়ে কতক্ষণ ভালো থাকার ভান করা যায়! আমি যে আসলেই ভালো নেই, সেটুকুও ধরা পড়ে গেল তরুর চোখে। ভয়ানক অন্তর্ভেদী ওর দৃষ্টি, সে আমি জানি; কিন্তু কতদূর বিস্তৃত? আমার বুকের ভেতরের দুষ্টু দুষ্পাঠ্য আঁকিবুঁকির কতটুকু সে পাঠ করতে পারে? কতটুকু?
তরু সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী। ওর চাকরিভাগ্য ঈর্ষণীয় রকমের প্রসন্ন। বেকারত্বের দাহ ওকে মোটেই পোহাতে হয়নি। মাত্র এক ঢিলেই পাখি শিকার করেছে। পাস করে বেরোনোর পর প্রথম দরখাস্তেই চাকরি হয়ে গেছে। আনন্দে আটখানা। আকাশকুসুম পরিকল্পনা ওর মাথায় গিজ গিজ করে। দিনের শেষে বহু প্রতীক্ষিত সাক্ষাৎ লগ্নটিতে আবার সেই সব পরিকল্পনা তড়বড়িয়ে ফুটে বেরোয় ওর চোখমুখ দিয়ে : আমাদের একটা বাসা হবে, বেডরুমের দক্ষিণে থাকবে প্রশস্ত জানালা, সেই জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে লুটিয়ে পড়বে আমাদের বিছানায়, আমরা তখন জোছনার সমুদ্রে লুটোপুটি খাব; চোখের কোণে ভ্রুভঙ্গ হেনে আড় চোখে তাকায় আমার দিকে, বলে- জোছনার সঙ্গে চন্দন দিয়ে মাখাব তোমার গায়। উহ্! আমাদের ঢাউশ বিছানাটা হয়ে যাবে গোলাপবাগান, হয়ে যাবে আকাশ দেখার আয়না।
তরুর মুখের এই কল্পনাবিলাস শুনতে আমার ভালো লাগে, আবার ভয়ও লাগে। ভয়ে এবং ভালো লাগায় আমি তরুর দুহাত জড়িয়ে ধরি, অনুনয় করি,
এভাবে আর বলো না তরুমণি! আমার লোভ হয়, ভয় হয়।
ভয়! ভয় কীসের?
সে কি তোমাকে বোঝানো যাবে?
যাবে। বল তোমার কীসের ভয়?
আমিও নজরুলের রোমান্টিক গানের ভান্ডারেই হাত বাড়াই। বলি-হেথা হারাই হারাই ভয়, প্রিয়তমে তাই-
গানের কলি আমাকে আর শেষ করতে দেয় না তরু, নিজেই গেয়ে ওঠে- বক্ষে জড়ায়ে কাঁদি, ছাড়িতে না চাই...।
কিন্তু এই পর্যন্তই। এর বেশি আর গায় না তরু। গান থামিয়ে সহসা আমার দুহাত চেপে ধরে টানাটানি শুরু করে,
ওঠো।
কোথায় যাবে?
আহা, ওঠো তো! আমি বলছি আমার সঙ্গে চলো।
কোথায়, সেটা জানা যাবে না?
কাজী অফিসে। এক্ষুনি।
কী যা তা বলছ তরু?
ঠিকই বলছি, চলো। ‘হারাই হারাই ভয়’ আর থাকবে না।
[চলবে]