শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

সৌদি আরবের যত বরকতময় পাহাড়

মুহাম্মদ সেলিম, সৌদি আরব থেকে ফিরে

সৌদি আরবের যত বরকতময় পাহাড়

ইসলামের প্রচার ও সম্প্রসারণ হয় মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরব সাম্রাজ্য (কেএসএ) থেকে। এ দেশকে সবাই সৌদি আরব নামেই বেশি চেনে। এ দেশে পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক নবী ও রসুলের আবির্ভাব হয়েছে। যাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছাড়াও বিভিন্ন নবীর ঘটনা পরম্পরায় সৌদি আরবের বিভিন্ন পাহাড় ও পর্বতের নাম কোরআন ও হাদিসে উঠে এসেছে বারবার। নানা ঘটনা সংঘটনের কারণে এসব পাহাড়কে বরকতময় হিসেবে মনে করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। বরকতময় এসব পাহাড়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পাহাড় নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।

 

জাবালে নূর

পবিত্র কোরআন ও হাদিসে উল্লিখিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়গুলোর একটি হচ্ছে জাবালে নূর। যাকে সবাই হেরা গুহা নামেই চেনে। মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন এ পাহাড়েই সর্বপ্রথম নাজিল হয়। তাই আলোচিত এ পাহাড় নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। প্রতি বছর কোটি কোটি মুসলিম ছুটে আসেন কোরআন নাজিলের পাহাড়টি এক নজর দেখতে। ঐতিহাসিকগণের মতে, জাবালে নূর রহমতময় পাহাড়গুলোর একটি। এ পাহাড়ে করা যে কোনো দোয়াই আল্লাহর কাছে কবুল হয়।

মক্কার কাবা শরিফ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত জাবালে নূর। অনেকে আবার এ পাহাড়কে জাবালে হেরা নামেও ডাকেন। এ পাহাড়ের প্রায় চূড়ায় অবস্থিত গারে হেরা বা হেরা গুহা। জাবালে নূর অর্থই হচ্ছে আলোর পাহাড়। এ পাহাড়ে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন প্রথম নাজিল হয়। কোরআনকে আলোর দিশারি হিসেবে মনে করা হয়। তাই এ পাহাড়কে জাবালে নূর বা আলোর পাহাড় হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা।

বরকতময় এ পাহাড় দেখতে প্রতি বছরই ছুটে আসেন লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। এ পাহাড়ের মূল উচ্চতা ৫৬৫ মিটার। একজন শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান মানুষের এ পাহাড়ের উঠতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। হেরা গুহায় পৌঁছাতে যে কাউকে বিশ্রাম নিতে হবে একাধিকবার। পাহাড়ের চূড়া থেকে বিপরীত দিকে একটু নিচেই কোরআন নাজিলের ঐতিহাসিক স্থান হেরা গুহা অবস্থিত। তবে পাহাড়ের শীর্ষস্থানে উঠেই ওই গুহায় যেতে হয়। পাহাড়ের শীর্ষস্থানে ওঠা ছাড়া হেরা গুহায় যাওয়া সম্ভব নয়। হেরা গুহা এত ছোট ও এর মধ্যকার জায়গা এত ছোট যে, প্রথম দেখাতে যে কারও বিষ্ময়কর মনে হবে। যার লম্বা ৪ মিটার আর পাশে ১.৫ মিটার। হেরা গুহা থেকে কোরআনের প্রথম ওহি নাজিল হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ ২২ বছর ৫ মাস ১৪ দিন সময়ে মানবজাতির জন্য সংবিধান হিসেবে পুরো  কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ হয়।

৬১০ খ্রিস্টাব্দে এ পাহাড়ের হেরা গুহায় নবী করিম (সা.) ধ্যানমগ্ন ছিলেন। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ফেরেশতা হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম কোরআনের প্রথম পাঁচ আয়াত নিয়ে আসেন। কোরআন নাজিলের কথা উল্লেখ করা হয়- জিবরাইল (আ.), হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে এসে বলেন- ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়ুন। নবী (সা.) উদ্বেলিত কণ্ঠে তাকে বললেন- ‘আমি তো পড়তে জানি না’। জিবরাইল (আ.) তখন রাসুল (সা.)-কে বুকে চেপে ধরে আবার বলেন, পড়ুন। তৃতীয় বার যখন জিবরাইল (আ.) তাকে আলিঙ্গন করে ছেড়ে দিয়ে বলেন, পড়ুন তখন মহানবী (সা.) সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত পাঠ করেন।

 

সাফা-মারওয়া পাহাড়

সাফা-মারওয়া পাহাড় হজ ও ওমরা পালনকারীদের কাছে খুবই পরিচিত একটি নাম। পবিত্র কাবার খুবই কাছেই অবস্থিত সাফা ও মারওয়া পাহাড়। কাবা থেকে সাফার দূরত্ব ৩৩০ ফুট এবং মারওয়ার দূরত্ব ১১৫০ মিটার। সাফা থেকে মারওয়ার দূরত্ব হচ্ছে ১৪৮০ মিটার। পাহাড়দ্বয় ও মধ্যবর্তী পথ বর্তমানে দীর্ঘ গ্যালারির মধ্যে অবস্থিত এবং মসজিদুল হারামের অংশ। সাফা ও মারওয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক পবিত্র পানির কূপ ‘জমজম’র সম্পর্ক রয়েছে। সাফা ও মারওয়ার সংশ্লিষ্ট ঘটনার আবহে সৃষ্টি হয় ‘জমজম কূপ’-এর। এ পানিকে বরকতময় হিসেবে মনে করা হয়। এ পানিতে রয়েছে মানুষের জীবন ধারণের তথা জীবিকা নির্বাহের সব উপাদান। যার রয়েছে সব ধরনের রোগ প্রতিশোধকের ক্ষমতা।

ইসলামী ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে স্ত্রী হজরত হাজেরা ও শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) কে অল্প কিছু খাদ্যদ্রব্যসহ পবিত্র ঘর কাবা শরিফের সন্নিকটে সাফা ও মারওয়ার পাদদেশে উন্মুক্ত মরুভূমিতে রেখে যান। জনমানবহীন এ মরুভূমিতে অল্প সময়ের মধ্যেই সে খাদ্য শেষ হয়ে যায়। তারপর পুত্র ইসমাইল (আ.) কে একা রেখে হাজেরা পানির জন্য এ দুই পাহাড়ের মাঝে যাওয়া- আসা করেন। হজরত হাজেরা আশপাশ এলাকা দেখার জন্য প্রথমে সাফা পাহাড়ে ওঠেন। কিন্তু কিছু দেখতে না পেয়ে পার্শ¦বর্তী মারওয়া পাহাড়ে ওঠেন। এভাবে হজরত হাজেরা দুই পাহাড়ে সাতবার যাওয়া-আসা করেন। পরে তিনি পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর কাছে এসে দেখতে পান তার পায়ের আঘাতে মাটি ফেটে পানির ধারা বের হচ্ছে। পরবর্তীতে হাজেরা ওই পানির ধারাকে পাথর দিয়ে বেঁধে দেন। এ পানির ধারাটিই বর্তমানে জমজম কূপ নামে পরিচিত। 

হজরত হাজেরার স্মৃতির স্বারক হিসেবে হজ ও ওমরা পালনকারীদের সাফা-মারওয়া সায়ী (দৌড়াদৌড়ি) করা ওয়াজিব করা হয়। এ কারণে হজ ও ওমরা পালনকারীদের হজ শেষে সাফা মারওয়ায় সাতবার সায়ী করতে হয়। সায়ী করার সময় নির্ধারিত কিছু অংশে হজ পালনকারীদের দৌড়াতে হয়। সায়ী করার সময় করা যে কোনো দোয়াই সৃষ্টিকর্তার কাছে কবুল হয় বলে মনে করেন ইসলামী চিন্তাবিদরা।  

হজ ও ওমরা পালনকারীদের জন্য ফরজ তাওয়াফের পর সাফা-মারওয়া সায়ী করা ওয়াজিব। আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলির অন্যতম। তাই যারা কাবাগৃহে হজ সম্পাদন করবে অথবা ওমরাহ করবে, তাদের জন্য উভয়ের প্রদক্ষিণে অসুবিধা নেই। (সূরা বাকারা : ১৫৮)।

 

রহমতের পাহাড়

পবিত্র হজের অন্যতম অংশ হচ্ছে আরাফাতের ময়দান। হজ পালনকারীদের অবশ্যই নির্দিষ্ট একটি সময় আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হয়। বিশাল ময়দানের এক পাশে অবস্থিত ঐতিহাসিক আরাফাতের পাহাড়। যাকে জাবালে রহমত কিংবা রহমতের পাহাড় বলেও চেনেন অনেকে। ইসলামী ইতিহাসবিদগণের মতে, জাবালে রহমত হচ্ছে দোয়া কবুল হওয়া স্থানগুলোর মধ্যে একটি। তাই হজপালনকারী ছাড়াও মক্কায় আসা মুসলমানরা অন্তত একবারের জন্য ছুটে আসেন জাবালে রহমতে। এসে পাহাড়ের চূড়া কিংবা পাদদেশে অবস্থান করে মনোবাসনা পূরণের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে দুই হাত তুলে মোনাজাত করেন। ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করেন, আরাফাত পাহাড়ে সবার মনোবাসনা পূরণ হয় বলে এ পাহাড়কে জাবালে রহমত হিসেবে ডাকা হয়।

ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানের পূর্ব দিকে অবস্থিত জাবালে রহমত। এখানে দাঁড়িয়ে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায়ী হজের ভাষণ দিয়েছিনে। মহানবীর বিদায়ী ভাষণকে মানবজাতির জন্য দিকনির্দেশনামূলক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ওই দিন সোয়া লাখ হাজীর উপস্থিতিতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন- ‘হে মানবমন্ডলী, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। কেন না, এ বছরের পর আমি আর তোমাদের সঙ্গে এখানে মিলিত হতে পারব কি না জানি না।’

আরাফাতের পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে বেদির মতো কিছুটা উঁচু করে সাদা রঙের ছোট দন্ডায়মান পিলার। এটি জাবালে রহমতকে চিহ্নিত করার জন্য স্থাপিত। যেহেতু আরাফাতে তিন দিকেই পাহাড়, এর মধ্যে কোন পাহাড়টা জাবালে রহমত, যার পাদদেশে হজরত রসুলে করিম (সা.) বিদায় হজের খুতবা দিয়েছিলেন, তা যেন লোকেরা সহজে চিনতে পারেন এজন্য এই চিহ্ন সেখানে স্থাপন করা হয়েছে।

জাবালে রহমত পাহাড়টি গ্রানাইটে গঠিত। যার উচ্চতা ৭০ মিটার। জিলহজের মাসের ৯ তারিখ আরাফাতের দিন হাজীরা আরাফাতে অবস্থান করেন। পাহাড়ের আশপাশের সমতল ভূমিকে আরাফাতের ময়দান বলা হয়। কখনো কখনো আরাফাতের পাহাড়ের মাধ্যমে সমগ্র এলাকাকে বোঝানো হয়। হজ করতে ইচ্ছুক কোনো ব্যক্তি আরাফাতে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলে শরিয়াহ অনুযায়ী তার হজ হয় না। পাহাড়ের পাদদেশে সাইনবোর্ডে বিভিন্ন ভাষায় নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। পাহাড়ে উঠে কী করা যাবে, আর কী করা যাবে না, তা পাহাড়ের ওপরের পিলারে লেখা আছে। নির্দেশনায় কয়েকটি ভাষার মাঝে বাংলা ভাষাও ব্যবহার করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দান ও রহমতের পাহাড়ের ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে হজরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়ার। আল্লাহর নির্দেশে আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) ইসলামকে বেহেশত থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর এ আরাফাত ময়দানেই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। আদম (আ.) রহমতের পাহাড়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময় দেখতে পান হাওয়া (আ.) জেদ্দার দিক থেকে আরাফাতের ময়দানের দিকে আসছেন। তখন আদম (আ.) দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেন এবং অঝোরে কাঁদতে থাকেন। এ সময় আদম ও হাওয়া (আ.) আসমানের দিকে তাকান। অতঃপর মহান আল্লাহতায়ালা তাদের দৃষ্টি থেকে পর্দা উঠিয়ে দিলে তাদের দৃষ্টি আল্লাহর আরশের ওপর গিয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর আদমকে তার প্রতিপালক কতিপয় বাক্য শিক্ষা দেন। এতে রব তার প্রতি মনোযোগী হন, নিশ্চয়ই তিনি তওবা কবুলকারী ও দয়ালু।’ (সূরা বাকারা : ৩৭)।

এ ছাড়াও আমাদের নবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণ এ ময়দান- সংলগ্ন জাবালে রহমত পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ কারণেও স্থানটি উম্মতে মুহাম্মদির কাছের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান।

 

জাবালে আবি কুবাইস

পৃথিবীর অনেক ইতিহাসের সাক্ষী বলা যায় জাবালে আবি কুবাইসকে। হজরত নূহ (আ.) এর বন্যার সময় থেকে শুরু করে নানান ঘটনার সাক্ষী এ পাহাড়। ইসলামী ইতিহাসবিদগণ জাবালে আবি কুবাইসকে পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রথম পাহাড়গুলোর একটি মনে করেন। 

মক্কার আল্লাহর ঘরের কয়েক শ গজের মধ্যেই অবস্থান জাবালে আবি কুবাইসের। যার অবস্থান মসজিদে হারামের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে। এরই মধ্যে যার কিছু অংশ কেটে হারামের চত্বরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর বাকি অংশে বর্তমানে রাজপ্রাসাদ রয়েছে। পাহাড়টি সাফা পাহাড়ের খুব সন্নিকটে। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, হযরত নূহ (আ.)-এর বন্যার সময় থেকে হজরে আসওয়াদ এ পাহাড়ের ওপর রাখা ছিল। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে পাহাড়ের মধ্যে সর্বপ্রথম এ পাহাড়টি সৃষ্টি করেন। এ পাহাড়টি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) একটি মুজেজার সাক্ষী। একবার মহানবী অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করেছিলেন। তখন দুই খন্ডের মাঝখানে হেরা পর্বত দৃশ্যমান হলো। দুই খন্ডের এক খন্ড আবি কুবাইস পাহাড় বরাবর ছিল। ইবনে কাসিরসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাথমিককালের ইসলামী ইতিহাস রচয়িতারা এ ঘটনাকে নির্ভুল বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

 

সওর পাহাড়

ইসলাম প্রচার ও সম্প্রসারণের শুরুর দিকের কথা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন পবিত্র নগরী মক্কায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন তখন কুরাইশ বংশের লোকজন তাঁকে বাধা দিতে থাকেন। এমনকি প্রতিরোধও সৃষ্টি করেন। কুরাইশদের অত্যাচারে ইসলাম ধর্মগ্রহণকারীদের অনেকে গোপনে হিজরত করতে থাকেন। এমন সময় কুরাইশ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। তাই রসুল (সা.) তখন হজরত আবু বকর (রা.) কে নিয়ে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন। হিজরত-সংশ্লিষ্ট নানা ঘটনাপ্রবাহের কারণেই সওর পাহাড়কে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। হিজরতের শুরুতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও  আবু বকর (রা.)সহ প্রায় পাঁচ মাইল অতিক্রম করে সওর পাহাড়ের একটি গুহায় তিন দিন লুকিয়ে ছিলেন। পবিত্র কোরআনে আবু বকর (রা.) কে সওর পর্বতের গুহায় অবস্থানের কারণে সম্মানিত করা হয়েছে। মক্কায় আসা হজ্ব ও ওমরা পালনকারীরা সওর পাহাড়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, এ পাহাড়ের পাদদেশ কিংবা চূড়ায় অবস্থান করে কোনো দোয়া করলেও তা কবুল হয়। তাই হজ্ব ও ওমরা যাত্রীরা এখানে আসেন দোয়া করতে। তবে উঁচু পাহাড় হওয়ার কারণে অনেকে চূড়ায় উঠতে পারেন না। তাই তারা পাদদেশে অবস্থান করেন এবং দোয়া করেন। পবিত্র মক্কা শরিফ থেকে তিন মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ঐতিহাসিক সওর পাহাড়। এ পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭৪৮ মিটার আর পাহাড়ের পাদদেশ থেকে প্রায় ৪৫৮ মিটার ওপরে। হিজরতের শুরুতে সওর পাহাড়ে মহানবী ও আবু বকর তিন দিন অবস্থান করেন। এ গর্তটি পাহাড়ের ওপরে এক পাশে অবস্থিত। এর সর্বোচ্চ উচ্চতা ১.২৫ মিটার এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩.৫ ও ৩.৫ মিটার। এ পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে যে কোন সুস্থ সবল মানুষের প্রচুর কষ্ট স্বীকার করতে হয়। যাওয়া- আসার জন্য সময়ও প্রয়োজন হয় সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা। তার পরও অনেকে সে কষ্ট অগ্রাহ্য করে ওঠেন পাহাড়ের চূড়ায়।

হিজরতের প্রাক্কালে হজরত মুহাম্মদ (সা.) আবু বকর (রা.)-কে নিয়ে রাতের বেলায় সওর পাহাড়ে আশ্রয় নেন। তিন দিন পর এখান থেকে বেরিয়ে মদিনার উদ্দেশে রওনা হন। অভিজ্ঞ মরুচারী আবদুল্লাহ ইবনে আরকাদ তাঁদের দুর্গম আর অপ্রচলিত পথে পৌঁছে দেন মদিনায়। সওর পাহাড়ে অবস্থানকালে মক্কার একদল দুর্র্বৃত্ত তাঁদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল মহানবী ও আবু বকর (রা.) এর কাছাকাছি। কিন্তু গুহা মুখের মাকড়সার জাল আর বাসায় ডিমে তা দিতে থাকা কবুতর দেখে তারা বিভ্রান্ত হয়েছিল। এখনো অনেক কবুতর আছে এখানে। ওই দুর্বৃত্তদের কথা যখন মহানবী ও আবু বকর ভিতর থেকে শুনতে পাচ্ছিলেন, তখন মহানবী আবু বকরকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘ভয় করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’

 

উহুদ পাহাড়

উহুদ পাহাড়ের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক বিশেষভাবে জড়িত। উহুদ প্রান্তেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাঁত মোবারক শহীদ হয়েছিল। তিনি হয়েছেন আহত। চাচা হজরত হামজা (রা.) এবং হজরত আকিল ইবনে উমাইরসহ ৭০ জন সাহাবি শহীদ হয়েছিলেন। এ পাহাড় ও এর পাদদেশে সংঘটিত উহুদ যুদ্ধ নিয়ে পবিত্র কোরআনে আলোকপাত করা হয়েছে। উহুদ যুদ্ধকে মুসলমানদের জন্য সংকট ও সমাধানের শিক্ষাক্ষেত্র হিসেবে মনে করেন ইসলামী চিন্তাবিদরা। তাই উহুদ প্রান্তে ছুটে আসেন হজ ও ওমরা পালনকারীরা। উহুদ প্রান্তরে এসে শহীদদের কবর জিয়ারত করে থাকেন। উহুদ পাহাড়টি পবিত্র মদিনার কেন্দ্রেই। মসজিদে নববী থেকে এ পাহাড়ের দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। অবস্থান ঠিক উত্তর-পূর্ব দিকে। স্থানীয় লোকজনদের অনেকে আবার এ পাহাড়কে জাবালে রুমাত বলেও ডাকেন। উহুদ যুদ্ধের সময় জাবালে রুমাতে ৫০ জন তীরন্দাজকে বিশেষভাবে নিয়োজিত করেন মহানবী (সা.)। তীরন্দাজদের দায়িত্ব দেওয়ার সময় মহানবী বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাদের পেছন দিক রক্ষা করবে। যদি তোমরা দেখ যে, আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছি তবুও তোমরা আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে না। আর যদি দেখতে পাও যে, আমরা গনিমতের মাল একত্রিত করছি তবে তখনো তোমরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে না।’ হাদিসে এ পাহাড় সম্পর্কে প্রচুর বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় নবী করিম (সা.) বলেন, ‘উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি।’ এ ছাড়া অনেক হাদিসে, সওয়াবের পরিমাণ বুঝাতে হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) উদাহরণ হিসেবে উহুদ পাহাড়ের কথা বলেছেন।

সর্বশেষ খবর