শুক্রবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনাকালে দেশে দেশে রমজান

সাইফ ইমন

করোনাকালে দেশে দেশে রমজান

কভিড-১৯ মহামারীকালে আবারও পবিত্র মাহে রমজান এসেছে মুসলিম বিশ্বে। জাঁকজমকপূর্ণ সাহরি ও ইফতার আয়োজন; দলে দলে তারাবি নামাজে শামিল হওয়া মুসলিম জাহানের ঐতিহ্য হলেও করোনাকালীন বিধিনিষেধ পাল্টে দিয়েছে সেই দৃশ্যপট। গত বছরের মতো এবারও রমজানে থাকছে না সাহরি আর ইফতার ঘিরে নানা আয়োজন। মসজিদগুলোতে সীমিত করা হয়েছে তারাবি নামাজ। দেশে দেশে করোনাকালীন রমজানের প্রস্তুতি নিয়ে আজকের রকমারি...

 

আমেরিকায় খাবার বিতরণ

পিউ রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকায় বসবাসকারী প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম রমজান মাসে রোজা রাখেন। কিন্তু এবার করোনা পরিস্থিতিতে রোজা ভিন্নভাবে এসেছে আমেরিকার মুসলমানদের মাঝে। কভিড-১৯ প্রতিরোধে দেশজুড়ে যে কোনো ধরনের সামাজিক, ধর্মীয় এবং শিক্ষামূলক জনসমাবেশ আয়োজনের আগে অনুমতি নিতে হবে। তাই অনেকটা ঘরবন্দী অবস্থায় কাটছে দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের রোজার দিনগুলোও। প্রেস ব্রিফিংয়ে নিউইয়র্ক সিটি মেয়র বলেন, ‘রমজানের শিক্ষা অভুক্তদের খাদ্য দেওয়া, সামর্থ্যহীনদের কথা মনে রাখা, বিশেষ করে এই সময়ে যখন দেশে কঠিন পরিস্থিতি চলছে।’ এদিকে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে এখন অনেকেই কর্মহীন। এমন মানুষের মধ্যে রমজানে চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, পিঁয়াজ, লবণ, মুড়ি ইত্যাদি বিতরণ করা হচ্ছে।

 

ইরানে লকডাউনেই রমজান

ইরানের অধিকাংশ অঞ্চলে গত শনিবার থেকে ১০ দিনের লকডাউন জারি করা হয়েছে। ইরানের ৩১টি প্রদেশের ২৩টিতে এই লকডাউন কার্যকর হচ্ছে। লকডাউনে ব্যবসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, থিয়েটার ও খেলাধুলার অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে এবং গত বুধবার থেকে শুরু হওয়া পবিত্র রমজান মাসে লোকজনের জড়ো হওয়া নিষিদ্ধ  ঘোষণা করা হয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত সপ্তাহে ইরানে করোনাভাইরাসের দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা গড়ে প্রায় ২০ হাজার করে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটির মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৪ হাজারের বেশি মারা গেছেন বলে জানিয়েছে দেশটির মন্ত্রণালয়। করোনার নতুন ধরনটি এই মুহূর্তে ২৫৭টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই শহরগুলোতে এখন রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।

 

ইয়েমেনে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ

দারিদ্র্যপীড়িত ইয়েমেনের দুর্দশা যেন থামছেই না। মার্চ মাসে করোনা হঠাৎ করেই বাড়তে শুরু করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে। তবে এপ্রিলের শুরুতে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। কিন্তু সৌদি আরবের আগ্রাসন পবিত্র রমজান মাসেও অব্যাহত রয়েছে দেশটিতে। আমেরিকাভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্ট’ বলছে, ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া সৌদি আরবের আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ইয়েমেনের ১ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। এদিকে চলমান রমজানেও যেসব ইয়েমেনি নাগরিক সৌদি আরব থেকে ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ইয়েমেনে যেতে চাচ্ছেন তাদের যাওয়ার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে করোনা ও যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতিতেই ইয়েমেনের মানুষজন পালন করছেন মাহে রমজান।

 

সৌদি আরবে নিষেধাজ্ঞা

ইতিহাস আর ঐতিহ্য ধরে রেখে রোজা পালনের সব পরিকল্পনা এবং স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে মহামারী করোনাভাইরাস। সৌদি আরবের দুই প্রধান মসজিদে তারাবি নামাজ ২০ রাকাতের পরিবর্তে ১০ রাকাত করার নির্দেশ দিয়েছেন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ। এর আগে দুই পবিত্র মসজিদে রমজান মাসে ওমরাহ এবং নামাজ আদায়ের জন্য অনুমতি দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ। তবে এবারের রমজানে ইতিকাফ এবং ইফতারের আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আনা হয়েছে। শুধু ভ্যাকসিন নিয়েছেন এমন লোকজন ওই দুই মসজিদে ওমরাহ পালন এবং নামাজ আদায় করতে পারবেন। এদিকে রমজান মাসে সারা দেশের সব মসজিদে ৩০ মিনিটের মধ্যে তারাবি নামাজ আদায় করার বাধ্যবাধকতা থাকবে। তবে ওমরাহ পালনকারী এবং নামাজ আদায় করতে আসা মুসল্লিদের জন্য সর্বোত্তম পরিষেবা নিশ্চিতের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

 

জার্মানিতে চলছে লকডাউন

জার্মানিতে সাড়ে তিন শ মানুষ মারা গেছেন গত ২৪ ঘণ্টায়। দেশটিতে চলছে কড়াকড়ি লকডাউন। সবাই ঘরে বসেই পালন করছেন রমজান। কারও বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। এদিকে টিকা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে দেশটিতে। গত এক সপ্তাহে করোনা আক্রান্তের হার ২০ হাজারেরও বেশি। এমন পরিস্থিতিতে ঘরে থেকেই সে দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ রোজা পালন করছেন। অন্যান্য বারের মতো এবারও মুসলিম সম্প্রদায়ের ইফতার ও সাহরির সব আয়োজন নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে মুসলিমদের জন্য রমজান মাসের পরিবেশ একেবারেই আলাদা। একমাত্র মসজিদে গেলেই মানুষ পরস্পরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতে পারেন, রোজার শেষে একসঙ্গে ইফতার করতে পারেন। যার কোনো কিছুই হয়নি গত বছর। সেই ধারা করোনা পরিস্থিতিতে এবারও অব্যাহত রয়েছে। জার্মানিতে মুসলিমদের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি।

 

আমিরাতে শিথিল নিষেধাজ্ঞা

আরব আমিরাতে পবিত্র রমজান মাস উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়ে থাকে। করোনার কারণে গতবারের মতো কড়াকড়ি শিথিল করেছে আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ। এ বছর দেশটিতে ইফতার ও সাহরি উপলক্ষে বাইরে সব ধরনের জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশটির সরকার মসজিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বড়জোর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মুসল্লিকে নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সেখানে রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের জন্য মলগুলো আংশিকভাবে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রমজান মাসে দুবাই শহরে একসঙ্গে ১০ জনের বেশি মানুষের একত্র হওয়ায় নিষেধাজ্ঞাসহ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ এখনো বলবৎ আছে। তবে শিথিল হলেও জনসমাগম নিষিদ্ধই থাকছে রমজানজুড়ে। পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে দেশটিতে কারফিউয়ের সময় দুই ঘণ্টা কমানো হয়েছে।

 

বিধি শিথিল ইন্দোনেশিয়াতেও

সামাজিক দূরত্ব মেনে পবিত্র মাহে রমজান শুরু করেছে বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দেশটির সরকার কভিড-১৯ টিকা কার্যক্রম চালু রেখে বিধিনিষেধে শিথিলতা আরোপ করেছে। স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি মেনে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মুসল্লি মসজিদগুলোয় নামাজ আদায় করতে পারবেন। পাশাপাশি রেস্তোরাঁ ও শপিং মলগুলোয় কঠোরতা শিথিল করা হয়েছে। গণপরিবহনেও যাত্রীরা সুরক্ষাবিধি মেনে চলাচল করতে পারবেন। দেশটির ধর্মবিষয়কমন্ত্রী এক ব্রিফিংয়ে বলেন, জনসাধারণ নিয়ম মেনে পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনা করতে পারবেন। যে অমানিশা দেখা দিয়েছে বিশ্বজুড়ে, আশা করছি পবিত্র রমজান মাসের রহমতে সে আঁধার কেটে যাবে। গত বছর রমজান মাসে করোনাভাইরাসের প্রকোপে দেশটির সব মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সে বছর মুসল্লিরা ঘরে বসেই নামাজ আদায় করেছিলেন।

 

মিসরেও শিথিল করা হয়েছে বিধিনিষেধ

গেল বছর অন্যান্য দেশের মতো মুসলিমপ্রধান দেশ মিসরেও ছিল করোনাকালীন কঠোর বিধিনিষেধ। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে গত রমজানে জারি ছিল কারফিউ। তবে এবার বদলে গেছে সেই দৃশ্যপট। গত রমজানের তুলনায় শিথিল করা হয়েছে করোনাকালীন বিধিনিষেধ। দেশটির রেস্তোরাঁগুলো দীর্ঘ সময় খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আয়োজন করতে পারবেন সীমিত পরিসরে সাহরি ও ইফতারের অনুষ্ঠান। দেশটির করোনাভাইরাস ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি জানায়, করোনাকালীন বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও প্রত্যেকের জন্য ফেসমাস্ক বাধ্যতামূলক। বিশেষত গণপরিবহনে যাতায়াতে সামাজিক দূরত্ব মেনে না চললে কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। একইভাবে মসজিদে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি কার্যকর করা না হলে তাদের জরিমানার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। রমজান মাসে ক্লাবগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ মাসে দেশটিতে রাতের রাস্তায় খেলাধুলা বেশ জনপ্রিয়। করোনার সংক্রমণের জন্য খেলাধুলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

 

রমজানে তুরস্কে কঠোর ব্যবস্থা

করোনা সংক্রমণ হ্রাসে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়েছে মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্ক। গত বছরের মতো এবারও দেশটিতে করোনার কারণে কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধের মধ্যে পালন করা হবে রমজান। দেশটিতে সাহরি ও ইফতারের সময় সমাবেশ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মসজিদে তারাবি নামাজ পড়তেও নিষেধ করা হয়েছে রোজাদারদের। প্রতি সপ্তাহেই ছুটির দিনে দেশব্যাপী লকডাউন থাকবে বলে জানিয়েছে তুরস্কের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া রমজানে রেস্তোরাঁ ও কফি হাউসগুলো শুধু খাবার গ্রহণ ও সরবরাহ পরিষেবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সাহরির সময় রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগাতে ৩ হাজার ২০০ জন কর্মী ইস্তাম্বুলের রাস্তায় থাকবে। এদিকে রমজানের মধ্যেই তুরস্কে চলবে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি। রোজাদারদের জন্য ইফতারের পর বা সাহরির আগেও ভ্যাকসিন প্রদান করা হবে।

 

ফিলিস্তিনেও শিথিল কঠোরতা

গত বছরের মতো এবারও অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনে মুসলমানরা পালন করবেন মাহে রমজান। দেশটিতে করোনার কারণে কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে ইতিমধ্যেই। পূর্ব জেরুজালেমের আল জোয উপত্যকা ও আশপাশের এলাকায় রোজা রাখা ও রোজাদারদের জাগিয়ে তোলার জন্য ইতিমধ্যে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা হয়েছে। যদিও গত রমজানে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ইসরায়েল। এ ছাড়া কঠোর বিধিনিষেধ আর স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি মেনে রমজানে রোজা রাখবেন ফিলিস্তিনের মুসলিমরা। রমজান মাসে দেশটির রেস্তোরাঁগুলো কেবল খাবার গ্রহণ ও সরবরাহ পরিষেবার জন্য খোলা থাকবে। পবিত্র আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের নামাজের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে মসজিদ প্রাঙ্গণে জনসাধারণকে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি মেনে তবেই নামাজ পড়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ খবর