শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত থাকার দোয়া

মোস্তফা কাজল

বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত থাকার দোয়া

মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভুত। কখনো আনন্দ। কখনো ব্যথা। কারও সুখ দীর্ঘস্থায়ী। আবার কারও দুঃখ অহর্নিশি। সুখ ও আনন্দের যেমন উপকরণ আছে, তেমনি বিপদ আসারও কোনো বার্তা থাকে না। আসলে বিপদ-আপদ মানুষের নিত্যসঙ্গী। বলে-কয়ে আসে না। কখন আসবে কেউ জানে না। প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত থাকার প্রার্থনা করা। এরপরও কারও ওপর সমস্যা কিংবা কোনো দুর্বিপাক নেমে আসতে পারে। বিপদ বা সংকটে পড়লে মানুষ হতবিহ্‌বল হয়ে যায়। মানুষের চিন্তাভাবনা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। মানুষ অস্থির ও দিশাহারা হয়ে করণীয় ভুলে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে কোনো মুহুর্তে ও বিপদ-আপদে পড়লে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হয়। কারণ তিনিই একমাত্র উদ্ধারকারী ও মুক্তিদাতা। মুহুর্তেই তিনি বিপদ থেকে মুক্তি দিতে পারেন। সমস্যা দূর করে প্রশান্তি দিতে পারেন। বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে পবিত্র কোরআন ও রসুল (সা.)-এর হাদিসে কিছু দোয়া ও আমলের কথা বর্ণিত হয়েছে। এসব নিয়েই আজকের আয়োজন...

 

মৃতদের জন্য দোয়া-মাগফিরাত

নিজের আত্মীয়স্বজন, আপনজন কিংবা কাছের ও পরিচিত যে কারও মৃত্যু হতে পারে। আর এসব অবস্থায় মানুষের মন ভারাক্রান্ত থাকে। বিচ্ছেদ-কষ্টে ব্যথাতুর হয়। তাদের জন্য উত্তম ও কল্যাণকর কিছু করার প্রবল ইচ্ছা জন্ম নেয় মনে। তাদের জন্য দোয়া ও মাগফিরাত করতে খুব ইচ্ছা হয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহর নবী ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক!

যেদিন হিসাব প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সব ইমানদারকে ক্ষমা করুন’ (সুরা ইবরাহিম-৪১)। অন্য জায়গায় নূ হ আলাইহিস সালামের এ দোয়া বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার পিতা-মাতাকেও। যে ইমান অবস্থায় আমার ঘরে প্রবেশ করেছে। আর সব মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকেও’ (সুরা নূ হ ২৮)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ মারা যায় তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমলের ফায়দা ভোগ করে।

সদকায়ে জারিয়া; এমন জ্ঞান, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। ওই সুসন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে (মুসলিম)।

 

মৃত ব্যক্তির জন্য নবীজি (সা.) যেভাবে দোয়া করতেন

নবী করিম (সা.) যেভাবে দোয়া করতেন, তার কয়েকটি দোয়া উল্লেখ করা হয়েছে। (কবরস্থ ব্যক্তির জন্য দোয়া)। উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাগ ফিরলাহু ওয়ারহামহু, ওয়া আফিহি ওয়া ফু আনহু; ওয়া আকরিম নুজুলাহু, ওয়া ওয়াসসি মাদখালাহু; ওয়াগসিলহু বিল মায়ি ওয়াস সালজি ওয়াল বারাদি, ওয়ানাক্কিহি মিনাল খাতা-ইয়া কামা ইউননাককাস সাওবুল আব ইয়াজু মিনাদদানাসি; ওয়াবদিলহু দা-রান খায়রান মিন দারিহি, ওয়া আহলান খাইরান মিন আহলিহি; ওয়া যাওজান খাইরান মিন যাওজিহি।

ওয়া আদখিলহুল জান্নাতা, ওয়া আইজহু মিন আযাবিল কাবরি ওয়ামিন আজাবিন নার। অর্থ : হে আল্লাহ, তাকে ক্ষমা করুন এবং তাকে দয়া করুন। শান্তিতে রাখুন এবং তার থাকার স্থানটিকে মর্যাদাশীল করুন। তার কবর প্রশস্ত করে দিন। বরফ ও তুষারের শুভ্রতা দিয়ে, তাকে গুনাহ থেকে এমনভাবে পরিচ্ছন্ন করে দিন। যেমন ময়লা থেকে সাদা কাপড় পরিষ্কার হয়। তাকে দুনিয়ার বাসস্থানের চেয়ে উত্তম বাসস্থান, পরিবার ও সঙ্গী দান করুন। হে মাবুদ, তাকে জান্নাতে দাখিল করুন, তাকে কবর আর দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করুন (মুসলিম)। আল্লাহ রসুল (সা.)-এর সাহাবি আওফ বিন ইবন মালিক (রা.) বলেন, আমি রসুল (সা.)-কে মৃত ব্যক্তির জন্য এমন দোয়া করতে দেখে আকাক্সক্ষা করেছিলাম যে, যদি সেই মৃত ব্যক্তিটি আমি হতাম। রসুল (সা.) কবর জিয়ারত করে এভাবে দোয়া করতেন বলে হাদিসে এসেছে। উচ্চারণ : আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর, ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম; আনতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিল আসারি। অর্থ : হে কবরস্থানের বাসিন্দাগণ, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার প্রতি আল্লাহ রহম করুন। আমরাও আপনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব/আপনাদের সঙ্গে মিলিত হব (মুসলিম ও মিশকাত)।

দোয়ায়ে ইউনুস (আ.) পাঠ করা।

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মাছের পেটে ইউনুস (আ.) এ দোয়া পড়ে আল্লাহকে ডেকে ছিলেন এবং মুক্তি পেয়েছিলেন। যদি কোনো মুসলিম বিপদে পড়ে এ দোয়া পাঠ করে, আল্লাহ তা কবুল করবেন (তিরমিজি ও মিশকাত)। উচ্চারণ : লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জালিমিন (সুরা আম্বিয়া-৮৭)। অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি মহাপবিত্র। নিশ্চয়ই আমি সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।

 

কঠিন বিপদ থেকে মুক্তির দোয়া

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর রসুল (সা.) এসব বিষয় থেকে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। দোয়াটির আরবি উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন জাহদিল বালা-ই, ওয়া দারাকিশ শাকা-ই, ওয়া সু-ইল কদা-ই, ওয়া শামাতাতিল আ’দা-ই। অর্থ : হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কঠিন বিপদ, দুর্ভাগ্যে পতিত হওয়া, ভাগ্যের অশুভ পরিণতি এবং শত্রুর আনন্দিত হওয়া থেকে (বুখারি ও মুসলিম)। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) আরও একটি দোয়া করতেন। দোয়াটি হলো- উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা লা সাহলা ইল্লা মা জায়ালতাহু সাহলান, ওয়া আনতা তাজআলুল হুজনা সাহলান ইজা শিইতা।’ অর্থ, ‘ইয়া আল্লাহ, কোনো বিষয় সহজ নয়। হ্যাঁ, যাকে তুমি সহজ করে দাও। যখন তুমি চাও তখন তুমি মুশকিলকে সহজ করে দাও’ (ইবনে হিব্বান ও ইবনুস সুন্নি)।

আমলের যে সওয়াব মৃত্যুর পরও চালু থাকবে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ মারা যায় তখন তার আমল স্থগিত হয়ে যায়। কেবল তিনটি আমল ছাড়া। সদকায়ে জারিয়া, কিংবা এমন জ্ঞান যা থেকে মানুষ উপকৃত হয়। কিংবা এমন সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে (সহিহ মুসলিম)। ইমাম নববি এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সদকায়ে জারিয়া হলো ওয়াকফ’ (শারহু মুসলিম)। আল-খাতিব আশ-শারবিনি (রহ.) বলেন, ‘সদকায়ে জারিয়াকে আলেমগণ ওয়াকফ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন; যেমনটি বলেছেন রাফেয়ি। ওয়াকফ ছাড়া অন্য দানগুলো জারি বা চলমান নয় (মুগনিল মুহতাজ)।

 

বাজারে গিয়ে যে দোয়া পড়লে ১০ লাখ নেকি লাভ

সামান্য চেষ্টা করলেই মানুষ অনেক সওয়াব ও নেকি অর্জন করতে পারে। পেতে পারে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অসংখ্য প্রতিদান। কারণ, পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা বান্দার প্রতি অনুগ্রহশীল। অতএব, প্রয়োজনের তাগিদে যখন বাজারে, শপিং মলে কিংবা দোকানপাটে যাই- তখন অত্যধিক সওয়াব লাভের একটি দোয়া পড়তে পারি। হাদিস শরিফে আছে, বাজারে গিয়ে দোয়াটি পড়লে ১০ লাখ নেকি লাভ হয়। দোয়াটির আরবি উচ্চারণ : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ইউহয়ি ওয়া ইউমিতু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাই-ইন কাদির। অর্থ : আল্লাহতায়ালা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, সব ক্ষমতা তাঁরই, সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্য, তিনিই প্রাণ দান করেন। তিনি চিরজীবী, তিনি কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না। তাঁর হাতেই মঙ্গল এবং তিনিই সব সময় প্রত্যেক বস্তুর ওপর ক্ষমতার অধিকারী। মুহাম্মাদ ইবনে ওয়াসি (রহ.) থেকে বর্ণিত, আমি মক্কায় পৌঁছালে আমার ভাই সালিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) আমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁর বাবা থেকে, তাঁর দাদার সূত্রে আমার কাছে হাদিস বর্ণনা করেন যে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে লোক বাজারে প্রবেশ করে উপরোক্ত দোয়াটি বলে- তার জন্য আল্লাহতায়ালা ১০ লাখ নেকি বরাদ্দ করেন। তার ১০ লাখ গুনাহ মাফ করেন। তার ১০ লাখ গুণ সম্মান বৃদ্ধি করেন। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ ও হাকেম)।

অন্য একটি বর্ণনায় আছে, ‘বাজারে প্রবেশ করে যে ব্যক্তি এই দোয়াটি পাঠ করবে আল্লাহতায়ালা তার জন্য ১০ লাখ পুণ্য লিপিবদ্ধ করবেন। তার ১০ লাখ পাপ মোচন করে দেবেন। তাকে ১০ লাখ মর্যাদায় উন্নীত করবেন এবং জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করবেন।’ (সহিহ তিরমিজি, ইবনে মাজাহ ও মিশকাত)। কেউ কেউ হয়তো মনে করতে পারেন, তখনকার মতো এখন আর সে ধরনের বাজার নেই। এখন অত্যাধুনিক বিভিন্ন বাজার তৈরি হয়েছে।

যেখানে কোলাহল, হৈ-চৈ, চেঁচামেচি ও ভিড়-দুর্গন্ধ ইত্যাদি নেই। এমনকি বাজারে গিয়ে এখন কথা বলারও প্রয়োজন পড়ে না। তাই এই ধরনের বাজারে গিয়ে যদি এই দোয়া পড়া হয়, তাহলে ১০ লাখ নেকি কি সত্যি পাওয়া যাবে? তাদের জন্য উত্তর হলো- আল্লাহ চির মহান ও দয়ালু। তিনি সবার কল্যাণ চান। নেকি ও সওয়াবে সবাইকে ঋদ্ধ করতে চান। সুতরাং যে কেউ বাজারে গিয়ে এই দোয়া পড়লে, আশা করা যায় তিনি অবশ্যই ১০ লাখ নেকি অর্জন করবেন।

 

কোরআনে বর্ণিত হুদহুদ পাখি

অনন্য সুন্দর একটি পাখি। নাম হুদহুদ। পাখিটিকে দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সৌদি আরবে শীতের অবসান এবং বসন্ত শুরুর অন্যতম লক্ষণ হলো- হুদহুদ পাখির আগমন। হুদহুদকে ইতিহাসের পাখিও বলা হয়। এটি আকারে ছোট। সৌন্দর্যে অনন্য। হজরত সোলায়মান আলাইহিস সালামের রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত হতো এই পাখি। তিনি পশুপাখিদের ভাষা বুঝতেন। আল্লাহতায়ালা তাঁকে এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করেছিলেন। একজন নবী এবং একই সঙ্গে রাজার অনেক কাজ করত হুদহুদ পাখি। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কী হচ্ছে, কী চিন্তা-ভাবনা চলছে, কোথায় কী ঘটছে, কোন রাজা কোথায় সৈন্য পাঠাচ্ছে। কেন পাঠাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য হজরত সোলায়মান (আ.) হুদহুদ পাখি ব্যবহার করতেন। পবিত্র কোরআনের ২৭ নম্বর সুরা আন নমলের ২০ থেকে ৩১ নম্বর আয়াতে হজরত সোলায়মান (আ.)-এর সংবাদ সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে হুদহুদ পাখির উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একদিন হজরত সোলায়মান (আ.) পক্ষীদের খোঁজখবর নিলেন। অতঃপর বললেন, কী হলো, হুদহুদকে দেখছি না কেন? নাকি সে অনুপস্থিত? আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা হত্যা করব। যদি সে অনুপস্থিত থাকার যথাযথ কারণ না দেখায়। কিছুক্ষণ পর হুদহুদ এসে বলল, আপনি অবগত নন, এমন একটি বিষয়ে আমি অবগত হয়েছি। আমি সাবা থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি। আমি এক নারীকে সাবাবাসীদের ওপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেওয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে। আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সেজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলি সুশোভিত করে দিয়েছে। অতঃপর তাদের সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। অতএব তারা সৎপথ পায় না (সুরা আন নমল-২০-২৪)। হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) একদা নও মুসলিম ইহুদি পন্ডিত আবদুল্লাহ বিন সালামকে জিজ্ঞাসা করেন, এত সব পাখি থাকতে বিশেষভাবে হুদহুদ পাখির খোঁজ নেওয়ার কারণ কী ছিল? জবাবে তিনি বলেন, হজরত সোলায়মান (আ.) তাঁর বিশাল বাহিনীসহ ওই সময় এমন এক অঞ্চলে ছিলেন, যেখানে পানি ছিল না। আল্লাহতায়ালা হুদহুদ পাখিকে এই বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যে, সে ভূগর্ভের বক্ষসমূহ এবং ভূগর্ভে প্রবাহিত পানি ওপর থেকে দেখতে পায়। হজরত সোলায়মান (আ.) হুদহুদকে এ জন্যই বিশেষভাবে খোঁজ করছিলেন যে, এতদাঞ্চলে কোথায় মরুগর্ভে পানি লুকায়িত আছে। সেটা জেনে নিয়ে সেখানে জিন দ্বারা খনন করে দ্রুত পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়। একদা হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হুদহুদ পাখি সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন। তখন নাফে ইবনুল আজরক তাঁকে বলেন, জেনে নিন হে মহাজ্ঞানী! হুদহুদ পাখি মাটির গভীরে দেখতে পায়। তবে তাকে ধরার জন্য মাটির ওপরে বিস্তৃত জাল সে দেখতে পায় না; যখন সে তাতে পতিত হয়। জবাবে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন তাকদির এসে যায়, চক্ষু অন্ধ হয়ে যায়। চমৎকার এ জবাবে মুগ্ধ হয়ে ইবনুল আরাবি বলেন, এরূপ জবাব দিতে কেউ সক্ষম হয় না, কোরআনের আলেম ব্যতীত। হুদহুদ পাখির দৈহিক গঠন, বিশেষ করে মাথার লম্বা চূড়া আর পালকের বিন্যাস বেশ চমকপ্রদ। প্রজনন ঋতুতে মাথার লম্বা চূড়ায় কিছুটা লালচে আভা দেখা যায়। মাটি থেকে গাছের ডালে উড়ে বসলে খোঁপাটি ছড়িয়ে গিয়ে পাখার মতো খুলে যাওয়ার দৃশ্যটি প্রকৃতপক্ষেই মনোমুগ্ধকর।

 

পশুপাখির প্রতি ভালোবাসাও ইসলামের শিক্ষা

অনেকেই খাঁচায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি কিংবা পশু পালন করেন। এটা জায়েজ আছে। কিন্তু শর্ত হলো, তাদের যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে, কোনো ধরনের কষ্ট দেওয়া যাবে না। এটা ইসলামে নিষেধ

এই পৃথিবী আল্লাহতায়ালার অপার দান। পৃথিবীতে রয়েছে নানা রং, অপূর্ব রূপ। উঁচু-নিচু পর্বত, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ। বিস্তীর্ণ বনভূমি আর শীতের কুয়াশা। বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি, নদীর স্রোতধারা আর সাগরের ঢেউ। পাখিদের কলরব, জীবজন্তুর অবাধ বিচরণ। এসব মিলেই আমাদের পৃথিবী। বিশাল এই সৃষ্টিজগতে মানুষকে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত ও সৃষ্টির সেরা মানুষ। সৃষ্টিজগতের সবকিছুই মানুষের সেবায় নিয়জিত। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের রয়েছে কিছু দায়দায়িত্ব। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনিও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন’ (সুনানে আবু দাউদ)। পৃথিবীতে জানা-অজানা নানা ধরনের জীবজন্তু রয়েছে। এসবের প্রতি মায়া-মমতা পোষণ করতে হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না (সহিহ মুসলিম)। হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একটি পিঁপড়া নবীকুলের কোনো এক নবীকে কামড় দিলে ওই নবী পিঁপড়ার বাসা জ্বালিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন। ফলে তা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। তখন আল্লাহতায়ালা এ মর্মে অহি পাঠালেন যে, একটি মাত্র পিঁপড়া তোমাকে কামড় দিল, তাতে কিনা তুমি উম্মত ও সৃষ্টিকুলের এমন একটি সৃষ্টি দলকে জ্বালিয়ে দিলে যারা তাসবিহ পাঠ করছিল? (সহিহ মুসলিম)। বর্ণিত হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, অযথা কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া অনুচিত। আরেক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, এক যৌনকর্মী প্রচন্ড গরমে হেঁটে যাচ্ছিল। পথে একটি কুকুরকে দেখতে পেল পিপাসায় কাতর হয়ে কূপের কাছে চক্কর দিচ্ছে। পিপাসায় তার জিহ্‌বা বেরিয়ে গেছে। তখন সে তার চামড়ার মোজা দিয়ে কূপ থেকে কুকুরের জন্য পানি তুলে আনল এবং কুকুরকে পান করাল। এতে আল্লাহতায়ালা তাকে মাফ করে দিলেন (সহিহ মুসলিম)। অবৈধ যৌনকর্ম নিকৃষ্টতম পাপ। কিন্তু একটি অসহায় প্রাণীর প্রতি সে দয়াপ্রবণ হয়েছে, তাই আল্লাহতায়ালা তার ওপর দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দিয়েছেন। হজরত আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, এক স্ত্রীলোককে একটি বিড়ালের কারণে আজাব দেওয়া হয়। কারণ সে বিড়ালটিকে বেঁধে রাখত। নিজেও পানাহার করাত না আবার ছেড়েও দিত না, যাতে সে জমিনের পোকা-মাকড় খেতে পারে। অবশেষে বিড়ালটি মারা গেল (সহিহ মুসলিম)। কী অবাক কথা! একজন অসতী নারী জীবের সেবা করে জান্নাত পেল, আর একজন সতী নারী জীবে কষ্ট দিয়ে শাস্তিযোগ্য হলো। হজরত কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) গর্তে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন (সুনানে আবু দাউদ)। কারণ, গর্তে বিভিন্ন প্রজাতির পোকা-মাকড় বসবাস করে। পেশাব করলে তাদের বসস্থান নষ্ট হবে, কষ্ট হবে। তাই হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) গর্তে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন। আরবদের কাছে নানা রকম উট ও গাধা থাকত। হজরত রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছেও সদকার উট আসত। এগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য আরবরা লোহা গরম করে প্রাণীর মুখে দাগ লাগাত। এতে পশুগুলোর কষ্ট হতো। তাই রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা গাধা কিংবা উটের মুখে দাগ লাগিও না। যদি লাগাতেই হয়, তবে নিতম্বের ওপর দাগ লাগাও (সহিহ মুসলিম)। প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর আসল নাম হলো আবদুর রহমান ইবনে সখর। কিন্তু তিনি বিড়ালের বাচ্চা সঙ্গে রাখতেন। প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি এমন করতেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা পাঁচটি প্রাণীর নামে সুরার নামকরণ করেছেন। আবার ‘আনআম’ পশুসম্পদ নামে স্বতন্ত্র একটি সুরা নাজিল করেছেন। এসব কিছুই পশুপাখির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন। পৃথিবীতে অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি রয়েছে। জলে-স্থলে কিংবা উভচরে তারা বসবাস করে। এগুলোর সবই পরিবেশবান্ধব। পরিবেশের ভারসাম্য রাখতে এসব পশুপাখির বিকল্প নেই। পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। তাদের যত্ন নেওয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। অনুগ্রহপ্রাপ্তির সোপান। সুতরাং আমরা কখনো নিজেদের আনন্দের জন্য তাদের কষ্ট দেব না। অনেকেই খাঁচায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি কিংবা পশু পালন করেন। এটা জায়েজ আছে। কিন্তু শর্ত হলো, তাদের যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে, কোনো ধরনের কষ্ট দেওয়া যাবে না। এটা ইসলামে নিষেধ। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম যখন রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করলেন, দেখলেন ভবনের চারপাশের বেষ্টনীর ওপর কাচের টুকরা দেওয়া। তিনি সেগুলো অপসারণ করেছিলেন। কারণ ভাঙা কাচের ওপর পাখি বসতে পারে না। পৃথিবীতে পাখিপ্রেমের এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে। আবার এর বিপরীতও আছে। একটি পত্রিকার সংবাদে প্রকাশ, ইতালিতে শত শত পাখি মরে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আতশবাজির কারণে পাখিগুলো মারা গেছে। এসব নির্মম দৃশ্য, পাপের কাজ। আসুন আমরা পশুপাখিকে ভালোবাসি। সৃষ্টিজীবের প্রতি দয়া করি। আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রতি দয়া করবেন। পশুপাখির প্রতি সামান্য ভালোবাসা হতে পারে পরকালে আমাদের নাজাতের অসিলা।

 

৪০ লাখ নেকির দোয়া

মুমিন-জীবনে আমলের গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন হাদিসে সহজে ও অল্প সময়ে বিপুল সওয়াব লাভের আমলের কথা বর্ণিত হয়েছে। আমলগুলো নিতান্ত সহজ কিন্তু অজস্র ও অগণিত ফজিলতপূর্ণ। তাই অফিসে-বাসায় কাজের ফাঁকে কিংবা চলার পথে সামান্য অবসরে আমলগুলো নিমিষেই করা যায়। এমন একটি সহজ আমলের ব্যাপারে আলোচনা করব। এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, দোয়াটি পড়লে ৪০ লাখ নেকি দেওয়া হবে। সাহাবি তামিম দারি (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই দোয়াটি ১০ বার পড়বে, আল্লাহতায়ালা তার আমলনামায় ৪০ লাখ নেকি লিখে দেবেন। (তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ ও তাবরানি)। দোয়াটির আরবি উচ্চারণ : আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু। ইলাহান ওয়াহিদান-আহাদান সামাদান। লাম ইয়াত্তাখিজ সাহিবাতান ওয়ালা ওয়ালাদা। ওয়ালাম ইয়াকুল লাহু কুফুওয়ান আহাদ। অর্থ : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। একক উপাস্য, একাই, অমুখাপেক্ষী, তাঁর স্ত্রী-সন্তান নেই। তাঁর সমকক্ষও কেউ নেই। যেসব সহজ আমলে বেশি সওয়াব, বেশি বেশি সওয়াব লাভ ও নেকি অর্জন প্রতিটি মুমিনের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমানের পর আমলের মাধ্যমেই আখেরাতে জান্নাত ও নাজাত লাভ হবে। সহজে আমল করা ও গুনাহ মাফ সম্পর্কে হাদিসে বেশ কিছু লেখা রয়েছে। পাঠকদের জন্য সেসব আমল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণকর।

সর্বশেষ খবর