ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল বিশ্বসেরা দার্শনিক সক্রেটিসের বিরুদ্ধে। বলা হয়েছিল, তিনি ধর্মের ক্ষতি করছেন। ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আদালতে তাঁর বিচার হয়। ৫০১ জনের জুরিবোর্ডের সামনে তিনি দোষী প্রমাণিত হন। দেওয়া হয় মৃত্যুদন্ড। হেমলক বিষপানের মধ্য দিয়ে তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এর আগে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল দোষ স্বীকার করে আপস করে নিতে। কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি সক্রেটিস। আড়াই হাজার বছর পর আদালতেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন সক্রেটিস। এখন তাঁকে মানা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তাঁকে নিয়েই আজকের রকমারি-
বিয়ে, সংসার ও বিতর্ক
স্ত্রী জ্যানথিপের গর্ভে জন্ম হয় সক্রেটিসের তিন ছেলের। তাঁর দাম্পত্য জীবন নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে রয়েছে চরম বিতর্ক। অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেন, জ্যানথিপের ঘরে সক্রেটিসের প্রথম সন্তান ল্যাম্প্রোক্লেসের জন্ম হয়। পরে সক্রেটিস এক নারীকে বিয়ে করেন, যার নাম মির্তো। মির্তোর গর্ভে জন্ম হয় সক্রেটিসের অপর দুই ছেলে সফ্রোনিসকাস এবং মেনেক্সেনাস।
তবে আরেক দল মনে করে, সক্রেটিস আসলে দুই বিয়ে করে একসঙ্গেই সংসার করেন। তাদের যুক্তি ছিল এথেন্সে তখন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা কম ছিল। সংসার জীবন মোটেই সুখের ছিল না সক্রেটিসের। প্রতিদিনই সক্রেটিসের সঙ্গে স্ত্রীর ঝগড়া হতো। এক দিন প্রচন্ড রাগান্বিত জ্যানথিপ চিৎকার করেই যাচ্ছিলেন।
অন্যদিকে সক্রেটিস বরাবরের মতো নিশ্চুপ ছিলেন। এতে আরও রাগান্বিত হয়ে একপর্যায়ে জ্যানথিপ সক্রেটিসের মাথায় এক বালতি পানি ঢেলে দেন। ঠিক তখন সক্রেটিস তার বিখ্যাত উক্তিটি করেন- ‘আফটার থান্ডার কামস দ্য রেইন।’ বিয়ে সম্পর্কে তাঁর আরও একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘আপনি বিয়ে করুন আর না-ই করুন, উভয় ক্ষেত্রে পস্তাবেন।’
যোদ্ধা জীবন
সক্রেটিসকে শুধু ভবঘুরেই যদি মনে করেন তাহলে ভুল হবে। তিনি ছিলেন সাহসী যোদ্ধা। সক্রেটিস তাঁর মিলিটারি দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। তিনি পতিদা যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন। তাঁর রণকৌশল সত্যিই প্রশংসনীয় ছিল। তিনি এথেন্সের জেনারেল অ্যালসিবিয়াদেসের জীবন বাঁচান। এ ছাড়া দিলিয়াম এবং অ্যাম্ফিপোলিসের যুদ্ধেও অংশ নেন সক্রেটিস।
ভাবা হতো ধর্ম, গণতন্ত্রের শত্রু
সক্রেটিস বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষভাবে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে সাহিত্য, সংগীত এবং অ্যাথলেটিকসে তাঁর দখল ছিল
একসময় ডেমোক্র্যাটরা সক্রেটিসকে গণতন্ত্রের শত্রু ভাবতে শুরু করে। অ্যাম্ফিপোলিসের যুদ্ধের সাত বছর পর আনুমানিক ৪১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এথেন্সে দেবী হার্মিসের কিছু মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। দেবী হার্মিসকে বলা হয় ভ্রমণকালীন নিরাপত্তা দেবী। এ ঘটনার পরপর পুরোহিত ছাড়াই ‘ইলিউসিনিয়ান শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান’ নিজেদের বাড়িতে পালন করে যা রীতিবিরোধী ছিল। এসব কাজে যার নামটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত ছিল তিনি অ্যালসিবিয়াদেস। এর ফলে নৌবাহিনী থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এই ধর্মবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য অনেকের শাস্তি হয়। দেখা যায়, শাস্তি পাওয়া অনেকেই সক্রেটিসের ঘনিষ্ঠ ছিল। পরে সন্দেহের দৃষ্টি পড়ে সক্রেটিসের ওপর। এত কিছুর মধ্যেই ৪১১ খিস্টপূর্বাব্দে একদল লোক গণতন্ত্র অস্বীকার করে ক্যু করে বসে। বলাবাহুল্য, অ্যালসিবিয়াদেসের সমর্থক ছিলেন। আরও কিছু ঘটনায় অ্যালসিবিয়াদেস হয়ে ওঠেন এথেন্সের ডেমোক্র্যাটদের প্রধান শত্রু। ফলে অ্যালসিবিয়াদেসের সব কর্মকান্ডের পেছনে সক্রেটিসের হাত আছে বলেই ধারণা করে এথেন্সবাসী।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
সক্রেটিস ৪৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মতান্তরে ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের সিরকা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সফ্রোনিসকাস। যিনি ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি ও ভাস্কর। আর সক্রেটিসের মা ফায়েনারেত ছিলেন একজন ধাত্রী। অ্যালোপেস নামক রাজনৈতিক অঞ্চলে বেড়ে ওঠেন সক্রেটিস। তাই শৈশব থেকেই রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। এথেন্সের নিয়ম ছিল ১৮ বছর বয়সের সব যুবককে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হতো। তরুণদের মূল দায়িত্ব ছিল মিলিটারিতে যোগ দেওয়া। অন্যদিকে মিলিটারি-বিষয়ক বিভিন্ন দিক নির্ধারণ এবং বিচার বিভাগ পরিচালনার জন্য যে অ্যাসেম্বলি ছিল তাতেও যোগ দিতে হতো। এসব কাজে কোনো আপত্তি ছিল না সক্রেটিসের। তখনকার এথেন্স সমাজে নারীর সৌন্দর্যের চেয়ে পুরুষের সৌন্দর্য নিয়ে চর্চা হতো। সক্রেটিস ছিলেন অতিমাত্রায় কুৎসিত! কিন্তু নিজের চেহারা নিয়ে মোটেই দুঃখিত ছিলেন না তিনি। যে কোনো মানুষের জীবনে তার বাবা-মায়ের ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। সক্রেটিসও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
যুবক সক্রেটিসকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন তাঁর বাবা। তিনি এথেন্সের সব যুবকের মতো সাধারণ বাধ্যতামূলক শিক্ষার পাশাপাশি সক্রেটিসের উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ফলে সক্রেটিস বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষভাবে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে সাহিত্য, সংগীত এবং অ্যাথলেটিকসে তাঁর দখল ছিল। সক্রেটিস কাব্যচর্চায় পারদর্শী ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি সংগীতে এবং শরীরচর্চায়ও দক্ষ হন। আবার বাণিজ্যটাও ভালোভাবেই রপ্ত করেন সক্রেটিস।
প্রাচীন গ্রিসের বিশেষ একজন
সক্রেটিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক। এথেন্স নগর-রাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন তিনি। নিজে কিছু রচনা করে না গেলেও তাঁর দর্শন এবং জীবনকাহিনি আমরা জানতে পারি তাঁর প্রখ্যাত শিষ্য প্লেটোর রচনাবলি থেকে। প্লেটোর সব গ্রন্থেরই নায়ক হচ্ছেন সক্রেটিস। পথে-ঘাটে সবখানে তত্ত¡কথার আলোচনা করতেন সক্রেটিস। তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, কোনো কিছুকেই তিনি বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করতেন না। জ্ঞানের অন্বেষণেই সর্বদা ব্যস্ত রাখতেন নিজেকে। তাঁর মতে, জ্ঞান হচ্ছে আসলে জিজ্ঞাসা এবং অন্বেষা। তিনি বলতেন, আমরা সবাই নিশ্চিন্তে সব সময় বলি, আমরা সবকিছু জানি। আসলে আমরা কতটুকু জানি? সক্রেটিসকে সবাই সবচেয়ে জ্ঞানী বলতেন সে সময়। উল্টো তিনি পরিহাস করে বলেছিলেন, আমাকে কেন লোকে জ্ঞানী বলে, আমি কতটুকু জানি, এ প্রশ্নের রহস্যভেদ করার জন্য আমি কত মানুষকে প্রশ্ন করেছি। নানা সমস্যা সম্পর্কে আমি তাদের প্রশ্ন করেছি। যাকে প্রশ্ন করেছি, সে-ই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। দিনের পরিভ্রমণ শেষে ক্লান্ত দেহে আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। এত সব জ্ঞানীর সঙ্গে আমার যদি কিছু পার্থক্য থাকে তা এই যে, আমি জানি যে আমি কিছু জানি না; কিন্তু এরা জানে না যে এরা কিছু জানে না। সরলতা এবং জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে এথেন্সের তরুণদের কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব করে তোলে। তাঁর জনপ্রিয়তা, প্রচলিত ধর্ম এবং রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে তরুণদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তৎকালীন এথেন্সের নীতিনির্ধারকরা। এথেন্স সরকার সক্রেটিসকে তরুণদের বিপথগামী করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। সক্রেটিস ক্ষমা প্রার্থনা করে রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ সম্পর্কে আর কোনো প্রশ্ন তুলবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিলেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে বলে শর্ত দেওয়া হয়। অন্যথায় হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করতে হবে। সক্রেটিসের শিষ্যরা তাঁকে গোপনে কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু ন্যায়পরায়ণ সক্রেটিস ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা গোপনে পলায়ন কোনোটাই করতে রাজি হননি। উল্টো তিনি বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, তাঁকে বিচার করার কোনো অধিকার তাদের নেই। কিন্তু রাষ্ট্রের বিচারালয় হিসেবে তিনি তাদের রায় মেনে নেন। হেমলক বিষ পান করে অকম্পিতচিত্তে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবন ত্যাগের এ কাহিনি তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। সক্রেটিস তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন, স্বেচ্ছায় কেউ কুকর্ম করে না। সক্রেটিসের বিবেচনায় এটা একেবারেই অসম্ভব যে, কেউ জেনেশুনে পাপ করবে। তাঁর মতে, সত্যি কেউ যদি ভালোকে ভালো জানে তবে সে ভালো কাজটিই করবে। আর তুমি যা করছ এর চেয়ে উত্তম বিবেচনাবোধ তোমার থাকলে তুমি সেটাই করতে।
হেমলক বিষপানে কার্যকর মৃত্যুদন্ড
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। বলা হয়, তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ধর্মের ক্ষতিসাধন করেছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা তিনি বিশ্বাস করতেন না। কারণ সেখানে দেখা যেত, দেবতারা সব সময় মানুষের উপকার করছেন না। বরং কখনো হিংস্র হয়ে উঠেছেন। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, দেবতারা এ রকম হতে পারেন না কখনই। দেবতারা নিশ্চয়ই সর্বদা সত্যবাদী, উপকারী এবং জ্ঞানী। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, দেবত্ব যৌক্তিকতার অপর নাম। ফলে সক্রেটিসের ওপর অভিযোগ করা হয় তিনি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেননি এবং যুবসমাজকেও ধর্মবিরোধী করেছেন। সক্রেটিসের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো তাঁর সমসাময়িক সমাজ ছিল রক্ষণশীল এবং সংকীর্ণমনা। তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আদালতে সক্রেটিসের বিচারের রায় দেওয়ার জন্য ৫০১ জন জুরির সমন্বয়ে জুরিবোর্ড গঠন করা হয়েছিল।
২২১ জনের নির্দোষ ঘোষণার বিপরীতে ২৮০ জন সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। এর পরও সক্রেটিস নিজের যুক্তিতে অনড় ছিলেন। সত্য থেকে একবিন্দু নড়েননি তিনি। নিয়ম অনুযায়ী সক্রেটিসকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি নিজের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছেন কি না। কিন্তু সক্রেটিস নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং তাঁর কর্মকান্ডকে যুক্তিযুক্ত বলেন। তিনি বিচারকদের কটাক্ষ করেন। ফলে হেমলক বিষ পানের মধ্য দিয়ে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়। মহাজ্ঞানীর করুণ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে ইতিহাস। এমন ঘটনা ইতিহাসে আরও অনেক মনীষীদের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।
সক্রেটিক সমস্যা
দীর্ঘদিন ধরে সক্রেটিস সম্পর্কে নানা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করে এলেও ১৯ শতকে প্রথম ‘সক্রেটিক সমস্যা’ শব্দটির পরিচয় ঘটে। সর্বত্র আলোচনা শুরু হয় এ নিয়ে। সক্রেটিসের জীবন, তাঁর দর্শন ও অন্যান্য বিষয় আলোচনা করতে গেলে ইতিহাসবিদরা যে সমস্যার সম্মুখীন হন তাকেই বলা হয় ‘সক্রেটিক সমস্যা’। সক্রেটিসের দর্শন সম্পর্কে কোনো লিখিত দলিল না থাকায় সৃষ্টি হয় মূল সমস্যা। সক্রেটিসের কয়েকজন অনুসারী তাঁর সঙ্গে কথোপকথনগুলো লিখে গিয়েছিলেন। ‘লোগোই সক্রাটিকো’ বা ‘সক্রেটিক অ্যাকাউন্টস’ নামে লেখাগুলো পরিচিত। এদের মধ্যে কেবল প্লেটো আর জেনোফোনের লেখাই পাওয়া যায়। উনিশ শতক পর্যন্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রেটিসকে জানার অবলম্বন ছিল জেনোফোনের লেখা। তবে ফ্রেডরিখ শ্লেইয়ারম্যাসার তাঁর গবেষণায় দেখান যে, কেবল জেনোফোনের ওপর নির্ভর করে সক্রেটিস ও তাঁর দর্শন ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এর থেকে প্লেটোর লেখা সক্রেটিস সম্পর্কে অধিক স্বচ্ছ ধারণা পেতে সাহায্য করে। এর বাইরেও তিনি আরও একজনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি হলেন অ্যারিস্টোফেন। তাছাড়া প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলও সক্রেটিস সম্পর্কে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে যান।
হার মেনেছিল মৃত্যুভয়
হয় মৃত্যু একটি স্বপ্নহীন চিরস্থায়ী ঘুম, নয় নতুন আরেকটি জীবনের শুরু...
মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে সবার। কেউ এই মৃত্যু এড়াতে পারে না। তাই সব সময়ই মানুষের মনে কাজ করে মৃত্যুভয়। কিন্তু সক্রেটিস ছিলেন ব্যতিক্রম। সক্রেটিস নিজস্ব যুক্তি দিয়ে মৃত্যুভয়কে হার মানিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, মৃত্যুর স্বরূপ আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় তা সত্য কিন্তু মৃত্যুর পরে কী হবে তাকে আমরা দুটি সম্ভাবনায় সীমাবদ্ধ করে ফেলতে পারি। সক্রেটিসের মতে, এগুলোর কোনোটাই ভীতিকর কিছু নয়। তিনি বললেন, হয় মৃত্যু একটি স্বপ্নহীন চিরস্থায়ী ঘুম, নয় নতুন আরেকটি জীবনের শুরু। এ দুটো ছাড়া আর কী হতে পারে! আর নতুন আরেকটি জীবনও সক্রেটিসের কাছে ভালোই মনে হয়েছিল। কারণ অবশ্যই পূর্বে গত হওয়া মানুষদের দেখা পাওয়া যাবে সেখানে। সক্রেটিস কল্পনা করতেন হেডিস নামক এক কল্পলোকের। যেখানে মানুষ পরকালে যাবে। যে জগৎটা অনেকটা এথেন্সের মতোই। কিন্তু এথেন্সে যেমন মানুষ তার দৈহিক রূপ নিয়ে বাস করত, এখানে মানুষ বাস করবে শুধুই মন হিসেবে। কারণ মৃত্যু যদি ঘুম না হয়ে আরেকটি জীবন হয়, সেই জীবনে তো আর আমাদের দেহ থাকা সম্ভব নয়। দেহের তো ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে, পড়ে আছে পৃথিবীতেই। অকাট্য যুক্তি। এভাবেই সারা জীবন যুক্তির মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করেন সক্রেটিস। মৃত্যু নিয়ে অনেকেই অনেক রকম কথা বলে গেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় বিষয় হলো মৃত্যু। সক্রেটিস এটা বুঝেছিলেন যে, তাঁর দর্শনচর্চা করতে শুধু মন থাকাটাই যথেষ্ট হলেও যাদের দৈহিক কাজকর্ম করতে বেশি ভালো লাগে, তাদের নিশ্চিতভাবেই পরকাল ভালো লাগবে না। তাই তিনি বলেছিলেন, আমাদের পৃথিবীর জীবনে দেহের পেছনে সময় না দিয়ে মনের পেছনেই সময় দেওয়া উচিত। কারণ মনটাই অবিনশ্বর। আর এটা করতে পারলেই দৈহিক মৃত্যু আর আমাদের কাছে ভয়ংকর মনে হবে না, বরং মৃত্যুর চিন্তা আমাদের আনন্দিত করবে। এই মানসিকতার কারণেই সক্রেটিস মৃত্যুকে ভয় পেতেন না। একটু ভেবে দেখলে কিন্তু যে কেউ বুঝবে যে সক্রেটিসের দর্শন হাজার হাজার বছর ধরে এখনো আলোচিত এবং আধুনিক। আর এ কারণেই সক্রেটিস হয়ে উঠেছেন বিশ্বসেরা দার্শনিক।
আড়াই হাজার বছর পর নির্দোষ প্রমাণ
সক্রেটিসের মৃত্যুর প্রায় আড়াই হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। এত বছর পরও গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের ওনাসিস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আধুনিক একটি আদালতে বিচারের রায় নিয়ে নতুন করে শুনানি হয়। তাতেই বলা হয় সক্রেটিস সম্পূর্ণ নির্দোষ। একবার ভাবুন তো! একই মামলার দুটো কাঠগড়া, মাঝখানে শুধু সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান। প্রথম কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সক্রেটিস আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছিলেন। আর এ সময়ের আদালতে তাঁর পক্ষ নিয়ে লড়েন গ্রিসসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের ঝানু উকিলরা।
সক্রেটিসের দর্শন
সত্যিকারের জ্ঞান
এথেন্সবাসীর মতে, দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির ডেলফিতে দৈববাণী হয়েছিল যে, সক্রেটিসই হচ্ছে জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষ। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, তখনই সত্যিকারের জ্ঞানী হওয়ার পথে হাঁটতে পারবে যখন জানবে তুমি কিছুই জানো না। তাই সক্রেটিস জুরিদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমি প্রমাণ করতে চাইলাম অ্যাপোলোর মন্দির ডেলফির দৈববাণী ভুল। তাই আমি প্রথমে গেলাম রাষ্ট্রপরিচালকদের কাছে এবং দেখলাম যাদের সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী বলে মনে করা হচ্ছে তারাই সবচেয়ে বেশি মূর্খ।
তখন আমি বুঝলাম আমি তাদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী, কারণ আমি অন্তত এইটুকু জানি যে, আমি কিছুই জানি না। তারপর আমি কবিদের কাছে গেলাম এবং দেখলাম তারা জ্ঞানের সাহায্যে নয় বরং দৈবজ্ঞানীদের মতো অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্য রচনা করেন। তারা অনেক চমৎকার কথা বলেন কিন্তু যা বলেন তার কিছুই বোঝেন না। অথচ কবিরা মনে করেন তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। তারপর আমি গেলাম কারিগরদের কাছে, দেখলাম তারা অনেক কিছুই জানেন, যা আমি জানি না। যেমন জাহাজ কিংবা জুতা তৈরি করা। কিন্তু কবিদের মতো তারা বিশ্বাস করেন তাদের জানা বিষয়গুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন জুতা তৈরি করা। এ বিশ্বাস তাদের জ্ঞানী হতে বাধা দেয়। এসব কিছু দেখেশুনে আমি সিদ্ধান্তে এলাম যে, আসলে কেউই জ্ঞানী নয়- রাষ্ট্রপরিচালকরা নয়, কবিরা নয়, কারিগররা নয় এমনকি আমিও নই, যার সম্পর্কে ডেলফিতে দৈববাণী শোনা গিয়েছিল। কিন্তু আমি অন্তত এইটুকু জানি যে, আমি কিছুই জানি না। সক্রেটিস আসলে বলতে চেয়েছেন নিজের বিশ্বাস ধরে আঁকড়ে রাখলে কখনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। তিনি যখন সবাইকে প্রশ্ন করতেন তখন সবাই নিজস্ব ধারণা মতে উত্তর দিত এবং সেই বিশ্বাসেই অটুট থাকত।
আত্মিক উন্নয়ন
জ্ঞান ও সত্যচর্চার মাধ্যমে আত্মার উন্নয়ন বা পরিচর্যা করাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন সক্রেটিস। তিনি বলেছেন, আমি এথেন্সের ছোট-বড় সবাইকে বলি, তোমরা তোমাদের শরীর বা অর্থের পেছনে ছুটো না। তোমাদের প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আত্মার উন্নয়ন সাধন। যত দিন সত্য ও জ্ঞানের খোঁজ না পাও তত দিন পর্যন্ত অর্থ, যশ ও প্রতিপত্তির কথা চিন্তা করো না। সততা অর্থ থেকে আসে না বরং সততাই অর্থ ও অন্যান্য ভালো জিনিসগুলো টেনে আনে। এটাই আমার শিক্ষা। যদি এই মতবাদ এথেন্সের যুবসমাজকে কুপথে নেয় তবে আমি দোষী। যদি কেউ বলে আমি এসব ছাড়া অন্যকিছু শিখিয়েছি, তবে সে মিথ্যুক। সক্রেটিস স্পষ্টতই বলেছেন যে, জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই আত্মার উন্নয়ন সাধিত হয়। আর প্রকৃত জ্ঞান পেতে হলে ইহজাগতিক লোভনীয় মোহ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
রাষ্ট্র হচ্ছে বিশাল ঘোড়ার মতো
ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে আদালতে যখন সক্রেটিসের বিচার হচ্ছিল তখন তিনি এথেনীয়দের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তোমরা যদি আমাকে দোষী সাব্যস্ত কর, তাহলে যারা আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন সেই দেবতাদের বিরুদ্ধাচরণ করে পাপ করবে। আমি একটি ডাঁশ মাত্র। (এক প্রকার মাছি যেটা গরু, ঘোড়া ইত্যাদির রক্ত পান করে) যাকে দেবতারা এই রাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন। কারণ রাষ্ট্র হচ্ছে একটি বিশাল ঘোড়ার মতো, বিশাল বপুর জন্য এটি অলস ও মন্তর গতিসম্পন্ন হয়ে পড়ে। আমার দায়িত্ব হচ্ছে হুল ফুটিয়ে এটা চাঙ্গা করা। এজন্যই সব সময় সব জায়গায় আমি তোমাদের আলোকিত করে জাগানোর চেষ্টা করি। তোমরা আমার মতো আর কাউকে এত সহজে খুঁজে পাবে না। অতএব আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি। এখানে নিজের উপযোগিতা তুলে ধরেছেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিস। তখনকার রক্ষণশীল সমাজের সংকীর্ণমনা মানুষেরা তাঁকে ধারণ করার উপযোগী ছিল না। তারা আধুনিক নিত্যনতুন চিন্তা গ্রহণ করতে পারত না। ফলে তারা সক্রেটিসকে অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত করে যার পরিপ্রেক্ষিতে সক্রেটিস রাষ্ট্রকে একটি বিশাল ঘোড়ার ন্যায় তুলনা করেন এবং রাষ্ট্রকে চাঙ্গা করার উপায় বোঝানোর চেষ্টা করেন। কুসংস্কার আর গোঁড়ামি থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছিলেন তিনি।
জ্ঞানেই পুণ্য অজ্ঞতায় পাপ
সক্রেটিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দর্শন হলো- জ্ঞানেই পুণ্য। এই নীতি অনুযায়ী ভালোকে জানা মানে ভালো কাজ করা। সক্রেটিস বলতেন, মানুষ খারাপ কাজ করে শুধু তার অজ্ঞতার জন্য। পৃথিবীতে শুধু একটিই ভালো আছে তা হলো ‘জ্ঞান’।
আর একটিই খারাপ আছে, আর তা হলো অজ্ঞতা। যদি জ্ঞানেই পুণ্য লাভ হয় আর জ্ঞান অর্থ যদি হয় ভালো কাজ করা তাহলে একজন লোক কখনই খারাপ কাজে নিজেকে জড়াবে না। যদি জড়ায় তাহলে বুঝতে হবে সে ভালোকে জানতে ব্যর্থ হয়েছে।