শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক সুতানাল দীঘি। কথিত আছে ভালোবেসে ৬০ একরের এই দীঘি খনন করা হয়। সুতানাল ছাড়াও কমলা রাণী বা বিরহিনী দীঘি নামে পরিচিতি রয়েছে দীঘিটির। তবে এলাকায় সুতানাল পুকুর নামে পরিচিত। দীঘিটি কে, কখন, কোন উদ্দেশ্যে খনন করেছিলেন, তার ইতিহাসনির্ভর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে এলাকার প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, মোগল আমলের শেষের দিকে এ গ্রামে সামন্ত রাজার বাড়ি ছিল। আবার কেউ বলেন এখানে বৌদ্ধ বিহার ছিল। কথিত আছে সামন্ত রাজার স্ত্রী কমলা রাণীকে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশের জন্য উপহার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রাণী তখন রাজাকে বলেন, ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে আপনি এমন কিছু দান করুন যা যুগ যুগ ধরে মানুষ মনে রাখে। সে মতেই রাজা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন অবিরাম একরাত একদিন সুতা কাটা হবে। যে পরিমাণ সুতা হবে, সেই সুতার সমপরিমাণ লম্বা এবং প্রশস্ত একটি দীঘি খনন করা হবে। এলাকার জনগণ দীঘির পানি ব্যবহার করবে। আর তোমাকে স্মরণ করবে।
এরপর দিনের পর দিন খননকাজ চলে। নির্মিত হয় বিশাল এক দীঘি। এক পাড়ে দাঁড়ালে অন্য পাড়ের লোক চেনা যায় না। কথিত আছে খননের পর দীঘিতে পানি ওঠেনি। পানি না ওঠায় সবাই চিন্তিত। কমলা রাণী তখন স্বপ্নাদেশ পান ‘গঙ্গাপূজা কর নরবলি দিয়া, তবেই উঠিবে দীঘি জলেতে ভরিয়া।’ স্বপ্ন দেখে রাণী চিন্তিত হয়ে পড়েন। নরবলি না দিয়ে রাণী গঙ্গামাতাকে প্রণতি জানানোর জন্য মহাধুমধামে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দীঘির মাঝখানে গঙ্গাপূজার আয়োজন করা হয়। কমলা রাণী গঙ্গামাতার পায়ে প্রার্থনা জানিয়ে বলেন, ‘কোনো মায়ের বুক করিয়া খালি, তোমারে দিব মাতা নরবলি। আমি যে সন্তানের মা, আশায় করিয়া ক্ষমা কোলে তুলিয়া নাও। মা পূর্ণকর তোমার পূজা।’
হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে দীঘিতে পানি উঠতে লাগলো। লোকজন দৌড়ে পাড়ে উঠতে পাড়লেও দীঘির টইটম্বুর পানিতে রাণী তলিয়ে গেলেন। কমলা রাণী আর তীরে উঠতে পাড়েননি। সেই থেকে কমলা রাণী বা সুতানাল দীঘি নামে পরিচিতি পায়।
সাবেক এমপি ও মন্ত্রী অধ্যাপক আবদুস সালাম রচিত ‘নালিতাবাড়ী মাটি মানুষ এবং আমি’ বই থেকে জানা যায়, খ্রিস্ট্রীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শালমারা গ্রামে সশাল নামের এক গাড়ো রাজা রাজত্ব করতেন। সামশ ইলিয়াস শাহ তখন বাংলার শাসন কর্তা। সশাল রাজার রাজধানী ছিল শালমারা গ্রামে। ১৩৫১ সালে তিনি সশালের বিরুদ্ধে সেনা প্রেরণ করেন। রাজা পলায়ন করে আশ্রয় নেন জঙ্গলে। পরে সশাল রাজা শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার পর দীঘির মাঝখানে ছোট একটি ঘর তৈরি করে দীঘির চারদিকে পরিখার মতো খনন করেন। রাজা যখন সেখানে অবস্থান করতেন, তখন তার বাহিনী বড় বড় ডিঙি নৌকা নিয়ে দীঘির চারদিকে পাহাড়া দিতো। কালক্রমে, ওই ভূ-খণ্ডটি ধসে দীঘিতে রূপ নিয়েছে। রাজার শেষ বংশধর ছিলেন রাণী বিরহীনি। এজন্য দীঘিটি রাণী বিরহীনি নামেও পরিচিতি পায়। ১৯৪০ সালে সরকারি ভূমি জরিপে দীঘিটি বিরহীনি নামেই রেকর্ড হয়েছে। তবে দীঘিটি খননের সত্যিকার দিন, ক্ষণ ও ইতিহাস জানা যায়নি।
১৯৮৩ সালে এই দীঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ‘সুতানালি দীঘিরপাড় ভূমিহীন মজাপুকুর সমবায় সমিতি।’ বর্তমানে সমিতির সদস্য সংখ্যা ১১৮ জন। সব সদস্যই দীঘির পাড়ে বসবাস করেন। দীঘিটি ১৯৮৩ সাল থেকে ভূমিহীন সমিতি প্রতি বছর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করতো। কিন্ত ২০০৪ সালে যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরা যুব সমিতি নামে নাম দিয়ে দীঘিটি দখলে নেওয়ার জন্য একটা মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি আদালতে চলমান রয়েছে। তাই দীঘিটি জেলা প্রশাসকের খাস কালেকশন হিসেবে ভূমিহীন সমিতির দখলে রয়েছে।
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নে মধ্যমকুড়া গ্রামে ৬০ একর জমির উপর দীঘিটি অবস্থিত। উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে দীঘিটির অবস্থান। দীঘিটিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর সৌখিন মৎস্য শিকারিদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মৎস্য শিকারি ও উৎসুক মানুষের আনাগোনায় এলাকার পরিবেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। এ দীঘির মাছ খুব সুস্বাদু বলে প্রশংসা রয়েছে।
তবে সচেতন নাগরিকদের অভিমত, পর্যটক আকর্ষণে ঐতিহাসিক এ দীঘিকে ঘিরে সরকারিভাবে আজো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পুকুরের পাড়ে চারদিকে পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য রাস্তা বা বসার ব্যবস্থা করা হলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন দেখতে আসতো। সরকারিভাবে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এই পুকুরকে কেন্দ্র করে দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হতে পাড়ে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, দীঘিটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য খুব শিগগিরই সরেজমিন দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই