পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপচরের নাম চর ইমারশন। প্রায় দুই হাজার মানুষের বসতি এই চরে। ফসল, গরু আর মাছ এসবে পরিপূর্ণ চরটির লোকজন একটা কিছুর তবু অভাব বোধ করছিল। সেখানে কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না।
শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারবঞ্চিত ছিল ছোট্ট শিশুরা। শিক্ষার আলোতে আলোকিত হতে পারছিল না এই দ্বীপচরটি। সব কিছু থেকেও যেন কিছুই নেই অবস্থা। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা সেই শিশুদের কথা চিন্তা করে চরটিতে স্কুল নির্মাণের জন্য এগিয়ে আসে দেশের বৃহৎ শিল্প পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপ।
তাদের অর্থায়নে ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল’ চালু হয়। সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব নেয় বসুন্ধরা শুভসংঘ। মহতী এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে এগিয়ে আসে স্থানীয় লোকজন। সবার সার্বিক সহযোগিতায় ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল।
বছর যেতে না যেতেই স্কুলে শিক্ষার্থী বেড়ে দাঁড়ায় ১৪০ জনে। প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী নিয়মিত স্কুলে আসে। অভিভাবকদের চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বিচ্ছিন্ন চরটিতে আশার আলো জ্বেলেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। চরের শিশু ও অভিভাবকদের স্বপ্নের পাঠশালায় পরিণত হয় স্কুলটি।
স্থানীয় লোকজন জানায়, অনেক কষ্ট করে শতাধিক শিক্ষার্থী প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করত।
মাঝে একটি নদীতে খেয়া পার হয়ে স্কুলে যেত। স্কুলে যাওয়া-আসা নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। শিশুদের ঝুঁকির কথা ভেবে অনেক মা-বাবা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতেন না। এখন আর এই শিশুদের পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে নদী পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হয় না। বসুন্ধরা শুভসংঘের স্কুলে লেখাপড়া করছে ওরা। বসুন্ধরা শুভসংঘের এই মহতী উদ্যোগ সারা জীবন মনে রাখবে তারা। তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থী ইসমাইল হোসেন বলে, ‘আগে এখান থেকে হাঁইটা যাইয়া খেয়া পার হইয়া আবার হাঁটতাম। স্কুলে যাইতে দেড় ঘণ্টা হাঁটতাম। বর্ষার সময় হাঁইটা কাদা মাটির রাস্তা যাওয়া যাইত না। অনেক দিন স্কুলে যাওয়াও হইত না। এহন এই জায়গায় আমাদের স্কুল হইছে। আমরা সবাই মিলে স্কুলে আই, সাথে ছোট বোইনডারে লইয়া আই। স্কুল যহন আছিল না, অনেক কষ্ট করছি।’ আরেক শিক্ষার্থী তাবির হোসেন বলে, ‘আমরা খুব খুশি। এখন আর আমাদের দূরের স্কুলে যেতে হয় না। ওইটায় বেশি হাঁটা লাগে, এটায় লাগে না।’
শিক্ষার্থী সোহানের মা শিমুলি বেগম বলেন, ‘নিজে সামান্য লেখাপড়া করছি। পোলাডারে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। দূরের স্কুলে পাঠানো নিয়া চিন্তার শ্যাষ আছিল না। এখন প্রতিদিন সকাল হইলে পোলায় নিজেই বই-খাতা গোছাইয়া স্কুলে যায়। কী যে ভালো লাগে, এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই দুর্গম চরে থাহি পড়াশোনা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। যদি পোলাডারে মানুষের মতো মানুষ করতে পারি, তয় জীবনডা সার্থক হইবে।’
স্থানীয় বাসিন্দা রফিক সরদার বলেন, উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের ছোটবাইশদিয়া গ্রামের চর ইমারশন ও চরতোজাম্মেল এলাকায় কোনো স্কুল ছিল না। নদী পার হয়ে শিশুরা ছোটবাইশদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কোড়ালিয়া এ রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। দূরে স্কুল থাকায় পাঁচ-ছয় বছর বয়স হলেও অনেক মা-বাবা সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে স্কুলে পাঠাতেন না। সাত বছর হলে স্কুলের কথা চিন্তা করতেন। অনেক শিশু পড়ালেখাবিমুখ হয়ে ঝরে পড়ত। মা-বাবার সঙ্গে সাংসারিক কাজে হাত লাগাত। এভাবেই ঝরে যেত আগামীর সম্ভাবনা।
উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা বায়োজিদ ইসলাম বলেন, ‘বিচ্ছিন্ন ওই চরের শিশুরা দারছিড়া নদীর একটি খেয়া পার হয়ে পাশের ছোটবাইশদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কোড়ালিয়া এ রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে পড়াশোনা করত। কোমলমতি শিশুদের অনেক ভোগান্তি এবং নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকতেন অভিভাবকরা। ওই সব শিশুর কথা চিন্তা করে গত বছরের শুরুতে বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল নামে একটি স্কুলের কার্যক্রম চলছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. মিজানুর রহমান বলেন, রাঙ্গাবালী উপজেলা একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ। আবার এর থেকে বিচ্ছিন্ন আরেকটি এলাকা চর ইমারশন। সেখানকার শিশুদের কথা চিন্তা করে বসুন্ধরা শুভসংঘ সেখানে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কারণ শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে তারা। এই উদ্যোগে উপজেলা প্রশাসনের সব সহযোগিতা থাকবে।