দেশের সর্ববৃহৎ ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পেরেকের মতো গেড়ে থাকা পাহাড় আর সবুজের অভয়ারণ্য সমতল ভূমিতে বেষ্টিত। প্রকৃতির আপন মায়ায় গড়ে উঠা শাটলের এই বিদ্যাপীঠের যাত্রা শুরু ১৮ নভেম্বর ১৯৬৬ সালে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে পাহাড়ি ও সমতল ভূমি মিলিয়ে ২২৯৮ একর ভূমিতে এর অবস্থান। সূবর্ণ জয়ন্তীর গৌরবে গৌরবান্বিত এই প্রতিষ্ঠান এবার ৫৪ পেরিয়ে পা রাখছে ৫৫-তে। দীর্ঘ পথ চলায় এই বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখে যাচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গণে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করতে যাচ্ছে নানা অনুষ্ঠানমালার। যার মধ্যে রয়েছে বুধবার (১৮ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক সকালে ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ, কেক কাটা ও উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা। এছাড়া বিকেলে শহরের চারুকলা ইনিস্টিউটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন করবে চবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। স্বল্প পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে এতে থাকবে বেলুন উড়ানো, কেক কাটা ও আলোচনা সভা।
১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চারটি বিভাগ নিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিম-পট্টি মৌজার ২২৯৮ একর জায়গাজুড়ে পাহাড়ের কোল ঘেষে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক দিয়ে এটি তৃতীয় বৃহত্তম এবং আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে ৪৮টি বিভাগ ও ৭টি ইনস্টিটিউট। যাতে রয়েছে ২৩ হাজার ৫৫৪ জন শিক্ষার্থী ও ৯২৫ জন শিক্ষক। আরও রয়েছে ৪ লক্ষাধিক বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। যেখানে আছে দেশ-বিদেশের দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ অনেক বই, সাময়িকী, পত্র-পত্রিকা, জার্নাল ও পান্ডুলিপি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে তিনটি ভিন্নধর্মী নিজস্ব জাদুঘর। যাতে দেখা মিলে দুর্লভ অনেক সংগ্রহের।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে শিক্ষার্থী পরিবহণের জন্য নিজস্ব শাটল ট্রেন। যা বিশ্বের দ্বিতীয় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এছাড়া রয়েছে দৃষ্টিনন্দন রাজনীতি, বিনোদন, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের আঁতুরঘর খ্যাত ঝুপড়ি, ঝুলন্ত সেতু, পাহাড়, ঝরণা, লেক, শতাধিক প্রজাতির পাখি, বানর, মায়া হরিণ, শূকর, সজারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণি ও আড়াইশ’ প্রজাতির বৃক্ষের সংগ্রহ। আগামী ৫ বছরের মধ্যে ৪০০ প্রজাতির বৃক্ষের সংগ্রহশালা হতে যাচ্ছে এখানে।
এছাড়াও জীববৈচিত্র্যের অনিন্দ্য সুন্দর মনোমুগ্ধকর অনেক স্থাপনা রয়েছে এখানে। এরমধ্যে স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ মিনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখেই রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে তৈরি ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’ এবং মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য ‘জয় বাংলা’।
মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের যেকোন আন্দোলন-সংগ্রামে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। মহান মুক্তিযুদ্ধে চবির ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী তাদের জীবন বিলিয়ে নিজেদের ত্যাগের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. হোসেন পেয়েছেন বীর প্রতীক খেতাব। এছাড়া ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের ক্রান্তিলগ্নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিলো দৃঢ়চেতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে এখানে রয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, অঙ্গন, আবৃত্তি মঞ্চ, উত্তরায়ণ, সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন, সব্যসাচী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অব ডিবেট, সিইউ মুনা, বিজ্ঞান ক্লাব, প্রথম আলো বন্ধুসভাসহ বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক সংগঠন।
৫৪ বছরের এই পথচলায় চবি জন্ম দিয়েছে অসংখ্য রথী-মহারথীর। যাদের মধ্যে রয়েছে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ভৌত বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, সৈয়দ আলী আহসান, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুন, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবুল ফজল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান প্রমুখ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির। যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকও ছিলের একই বিভাগের শিক্ষার্থী, তথ্যমন্ত্রী ড.হাসান মাহমুদ ছিলেন রসায়ন বিভাগের ছাত্র।
প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী রক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মনজুরুল কিবরিয়া পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা পুরস্কার, শিক্ষক ড. মো. শাহাদাত হোসেনের নতুন মাছের প্রজাতি আবিষ্কার ও শনাক্তকরণ, শিক্ষক ড. শেখ আফতাব উদ্দিনের কম খরচে সমুদ্রের পানি সুপেয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার, অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরীর বঙ্গোপসাগর নিয়ে মানচিত্র তৈরি এবং ড. আল আমিনের লেখা বই যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স বুক হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন সাবেক ছাত্র সাজিদ আলী হাওলাদার, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র শাখাওয়াত হোসেন ও তার দলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বে, সাফ গেমসে স্বর্ণপদকজয়ী মাহফুজা খাতুন শিলা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। এছাড়া গুগলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেওয়া সুমিত সাহা এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বিতর্ক অঙ্গনে এখানকার শিক্ষার্থীদের রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল