এস আলম গ্রুপের চিনি কারখানার গুদামের আগুন দুই দিনেও নেভেনি। আগুন নেভাতে টানা পানি ছিটানোর ফলে অপরিশোধিত চিনি পুড়ে তরল বজ্যে রূপান্তরিত হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। ফলে নদীর জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। ভেসে উঠছে শত শত মাছ ও জলজ প্রাণী। কারখানার আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে বিকট গন্ধ। এরমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কারখানার আয়তন ও ক্ষয়-ক্ষতির হিসেব নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
গত সোমবার বিকালে চট্টগ্রামের একমাত্র চিনিকল এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের একটি গুদামে আগুন লাগে। আজ বিকাল ৫টায় এই রিপোর্ট লেখা সময় পর্যন্তও জ্বলছিল আগুন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুইদিন ধরে টানা পানি ছিটিয়েও নিভছে না আগুন।
গতকাল দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির কর্তারা দাবি করেছেন, আগুন তিনভাগের এক ভাগ নিভে গেছে। বুধবার গণমাধ্যমকর্মীদের ভেতরে ঢুকতে না দেয়ায় আগুনের পরিস্থিতি দেখার সুযোগ হয়নি।
পোড়া বর্জ্য নদীতে, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য
প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুযায়ী, ওই গুদামে ১ লাখ মেট্টিক টন অপরিশোধিত চিনি ছিল। এসব চিনির পুরোটাই পুড়ে গেছে। পোড়া চিনির উপর টানা পানি ছিটানোর ফলে এক ধরনের কালচে বর্ণের তরলে পরিণত হচ্ছে। এসব তরল পার্শ্ববর্তী ড্রেন হয়ে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। শুরু থেকে পরিবেশবাদীরা বিষয়টিকে জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি উল্লেখ করলেও কারখানা ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে পাত্তা দেয়নি।
তবে মঙ্গলবার রাত থেকে নদীর যে অংশে তরল বর্জ্য গিয়ে পড়ছে সে অংশের পানি বিবর্ণ হতে শুরু করে। নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণী নদীর কিনারে আসতে থাকে। বুধবার সকাল থেকে টেংরা, চিংড়ি, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী নদীর পনিতে ভাসতে থাকে। এসময় স্থানীরা পানিতে নেমেই এগুলো ধরতে পারছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোড়া চিনি পানি মিশ্রিত হয়ে ক্যামিকেলে রূপান্তরিত হয়ে জীববৈচিত্র্যকে হুমকিতে ফেলছে। এই পরিস্থিতিতে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের ল্যাবে নদীর পানি পরীক্ষা করে করে প্রতিষ্ঠানটির চিফ কেমিস্ট কামরুল আলম জানান, চিনি পুড়ে কার্বনডাই অক্সাইড হয়ে নদীতে মিশছে। ক্যামিকেল নদীতে মেশার ফলে নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে পানিতে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে সামুদ্রিক প্রাণী ভেসে উঠছে। একই মত পোষণ করেছে জেলা মৎস দফতরও।
বুধবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, কারখানার পার্শ্ববর্তী ড্রেন দিয়ে ক্রমাগত তরল বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ছে। স্থানীদের ভাষ্যমতে, সোমবার রাত থেকে এমন বর্জ্য নদীতে পড়া শুরু করে। গত দুইদিন ক্রমাগত পড়ছে। বুধবার দুপুরে কিছু পরিবেশবাদীর দাবির পর এস আলমের পক্ষ থেকে কিছু বর্জ্য কারখানার বাইরে সমতল জায়গায় ডাম্পিং করতে দেখা গেছে।
কারখানার আয়তন ও ক্ষতির হিসেবে ধোঁয়াশা
প্রতিষ্ঠানটির দাবি, গুদামটির আয়তন ৬৫ হাজার বর্গফুট। সেখানে ১ লাখ মেট্টিক টন বা ১০ কোটি কেজি চিনি ছিল। প্রতি কেজি ১০০ টাকা হিসেবে ১ হাজার কোটি টাকা ক্ষয়-ক্ষতি হতে পারে। যদিও ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, গুদামটির আয়তন ৩০-৩৫ হাজার বর্গফুট ও উচ্চতায় পাঁচতলা ভবনের সমান হতে পারে। এই আকারের গুদামে কী পরিমাণ চিনি রাখা যেতে পারে সে বিষয়ে ধারণা দিতে পারেননি ওই কর্মকর্তা। কারখানার একাধিক কর্মকর্তাকে সোমবার রাত থেকে বুধবার পর্যন্ত গুদামে রাখা চিনির পরিমাণ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করতে দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে গ্রুপের জিএম মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিনি কারখানায় আগুনের কারণে বাড়তি দামে চিনি বিক্রির চেষ্টা করতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা আগেই সতর্ক করেছি। আমাদের পর্যাপ্ত চিনিও মজুদ আছে।’
দুইদিনেও নেভেনি আগুন
কারখানাটিতে আগুন লাগে সোমবার বিকাল ৪টায়। ছয়ঘণ্টা পর আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ওইদিন দিবাগত রাত, মঙ্গলবার ও বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্তও আগুন পুরোপুরি নেভেনি। চিনির কাঁচামালে অক্সিজেন ও কার্বনের উপস্থিতি থাকায় সহজে আগুন নেভানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। বুধবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত কারখানার অভ্যন্তরে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিটের কর্মীদের নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে দেখা গেছে। তবে ইতিমধ্যে গুদামের প্রায় অর্ধেক অংশের আগুন নিভেছে বলে জানা গেছে। কারখানাটিতে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত