চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা থমকে আছে ইক্যুইপমেন্ট সংকটে। এমনিতেই সাম্প্রতিক দু'দফা ধর্মঘটের প্রভাব রয়েছে, তার উপর আছে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য বৃদ্ধিতে কন্টেইনার ও কার্গো পরিবহনের চাপ। এ দু’য়ের মাঝে ইক্যুইপমেন্ট সংকট যেন গলাটিপে হত্যা করছে দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দরের প্রত্যাশিত গতিকে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জাহাজের টার্ন এরাউন্ট টাইম ক্ষেত্রবিশেষে ৭২ ঘণ্টা ছাড়িয়ে আরো একদিন দীর্ঘ হচ্ছে, আউটারে অলস বসে থাকছে ভ্যাসেল।
বন্দরের দায়িত্বশীলরা অবশ্য বলছেন, গতিশীলতা বাড়াতে ইক্যুইপমেন্ট সংকট কাটানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ি নেতা ও বন্দরের স্টেক হোল্ডাররা জানান, প্রায় ১২'শ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দরের অতিপ্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট ক্রয় প্রক্রিয়া নানাভাবে বাধাগ্রস্থ হয়ে কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না অন্তত অর্ধযুগ। এতে করে বন্দরের সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এত সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আশায় বুক বেধে আছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) ও এর ব্যবহারকারীরা। গেল বৃহস্পতিবারে সব মিলিয়ে বন্দর হ্যাল্ডলিং করে ৩৩ হাজার ৬৪৮ টিইইউস। এর মধ্যে এফসিএল ২৮ হাজার ৬০৯, এলসিএল ১৭৬ ও আইসিডিতে যায় ৬৫।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, ২০১৯ সালের মধ্যে তিন মিলিয়ন টিইইউস হ্যান্ডলিং চাহিদা হবে চট্টগ্রাম বন্দরের। ২০২০ নাগাদ ৩.৫ মিলিয়ন টিইইউস সরবরাহ থাকবে। এই চাহিদা মেটাতে অবশ্যই পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল চালু করতে হবে।
পোর্ট ইউজার্স ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (সিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম তালুকদার বলেন, মধ্যখানে ধর্মঘটের কারণে বন্দর হ্যান্ডলিংয়ে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিলেও তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। তবে বন্দরের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। আর এ লক্ষ্যে পর্যাপ্ত ইক্যুইপমেন্ট যত দ্রুত সম্ভব সংগ্রহ করতে হবে।
বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বন্দরে এখন তেমন বড় ধরনের কোন জট কিংবা জটিলতা নেই। তবে ইতোমধ্যে হওয়া ধর্মঘট এবং পর্যাপ্ত ইক্যুইপমেন্টের অভাবে সামগ্রিক হ্যান্ডলিংয়ের গতি প্রত্যাশিত নয়। এ কারণে মাঝেমধ্যে আউটারে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে যেতে পারছে না জাহাজ। অনেক সময় বাড়তি ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষমান থাকতে হচ্ছে।
বন্দরের বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর ‘সাইফ পাওয়ারটেক’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ইক্যুইপমেন্ট স্বল্পতাতো রয়েছেই। যে কারণে মাঝেমধ্যে ‘টার্ন এরাউন্ড টাইম’ একদিন বাড়তি হচ্ছে। তবে সার্বিক অর্থে জট কমেছে। আগামী মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ১১টি আরটিজি (রাবার টায়ার গ্যান্ট্রি) কেনা হচ্ছে। এ ছাড়া গ্যান্ট্রি ক্রেন কেনা হলে গতিশীলতা আরো বাড়বে। ২০১৮ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ সংকট কাটবে। অন্যদিকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আরো অন্ততঃ ৩০টি স্ট্র্যাডাল ক্যারিয়ার প্রয়োজন।
সময়ের বাড়তি চাহিদা মেটাতে ২০২০ সালের মধ্যে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল এবং ২১/২২ সালের মধ্যে ‘বে টার্মিনাল’ নির্মিত হবে বলে আশা করছেন তিনি।
শিগগির আরো অন্ততঃ সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকার ইক্যুইপমেন্ট কেনা হচ্ছে বলে জানিয়ে আশাবাদের কথা-ই বললেন বন্দর ব্যবহারকারি বড়তাকিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ এলিট। তার মতে, পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ হলে ২০১৯ সালের মধ্যেই আরো ৪টি জেটি সংযুক্ত হচ্ছে বন্দরে, যা হলে গতিশীলতা আরো বাড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) এর সদস্য জাফর আলম অবশ্য আশাবাদী সম্ভাব্য সব ইক্যুইপমেন্ট যুক্ত হলে হ্যান্ডলিং ক্ষমতা দ্বিগুণ হবে বলে। তিনি জানান, অন্ততঃ আরো ৬ থেকে ৭ মাস লাগতে পারে প্রত্যাশিত ইক্যুইপমেন্টগুলো ক্রয়ে। এরই মধ্যে ৬টি আরটিজি ও ৬টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন কেনা হচ্ছে। আগামী মাসের ৬ তারিখ উন্মুক্ত হবে ৬টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের টেন্ডার। এছাড়াও আরএমজি, আরো ৬টি আরটিজি এবং ৪টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ অন্য ইক্যুইপমেন্টগুলো কেনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান ইতোমধ্যে এই বন্দরের আরো সক্ষমতা বাড়াতে ‘বে-টার্মিনাল’সহ আরো কয়েকটি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান। পর্যাপ্ত ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ উদ্যোগ ও প্রক্রিয়াধীন বলে জানান মন্ত্রী এবং বন্দরের দায়িত্বশীলগণ।
তারা বলছেন, নৌবাণিজ্য বাড়তে থাকায় বাড়ছে আমদানি-রপ্তানির হার। জাহাজের আগমনের রেকর্ডও পুরনো রেকর্ড ভাঙছে। গেল বছর ২০১৬ সালে জাহাজ আগমনেরও নতুন রেকর্ড হয়েছে।
কার্গো পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রেও নতুন রেকর্ড গড়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ। গেল বছর প্রায় সাত কোটি টন পণ্য ওঠানামা করে, যা পূর্ববর্তী ২০১৫ সালে ছিল পাঁচ কোটি টন। প্রবৃদ্ধি এক্ষেত্রে সাত শতাংশেরও বেশি বলে জানান দায়িত্বশীলরা।
এদিকে ২০১৬ সালে এসে কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে প্রায় সাত কোটি টন, যা এযাবৎকালে সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে, ক্রমাগত বাড়ছে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধিও। ২০১৪ সালে ১৭ লাখ ৩১ হাজার ২১৯ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়, যাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। পরের বছর ২০১৫ সালে এসে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৭ শতাংশ বেড়ে যায়, যা ছিল পূর্ববর্তী ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৬ সালে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ টিটিইউস কন্টেইনার হ্যান্ডেলের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ছয় শতাংশের বেশি, যা কিনা ১২৮ বছরে ইতিহাসে সর্বোচ্চ হ্যান্ডলিংয়ের রেকর্ড। পূর্ববর্তী বছর ২০১৫ সালে হ্যান্ডলিং এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ লাখ কন্টেইনার। এর মধ্য দিয়েই এ বন্দর প্রথমবারের মতো ‘টু মিলিয়নস ক্লাবে’ প্রবেশ করে।
ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রস্তাবিত ‘বে-টার্মিনাল’ যত দ্রুত সম্ভব নির্মাণ, পর্যাপ্ত ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ জরুরি বলে মনে করছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।
চবক সূত্র জানায়, বে-টার্মিনালটি হলে প্রবেশ করতে পারবে পাঁচ হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজও। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে যেখানে ৯ দশমিক ৫০ মিটারের অধিক গভীর কোন জাহাজ নোঙর করতে পারছে না সেখানে টার্মিনালটিতে অনায়াসে ঢুকতে পারবে ১৪ মিটার গভীর ড্রাফটের জাহাজও।
বিডি-প্রতিদিন/এস আহমেদ