বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস উপলক্ষে শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরাম ‘স্বাস্থ্যখাতে ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন। সভায় বক্তারা ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব, অবদান ও বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেন।
আজ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ফার্মাসিস্টস্ ফোরাম জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন।
উক্ত অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), ডিভিশনাল হেড, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, প্রফেসর ড. ফিরোজ আহমেদ, চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভগের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটস অ্যাসোসিয়েশেনের সাধারণ সম্পাদক এম আমিনুল ইসলাম, সিনিয়র ফর্মাসিস্ট বেলায়েত হোসেনসহ দেশ বরেণ্য ফার্মাসিস্ট নেতৃবৃন্দ।
অনুষ্ঠানের সভপতিত্ব করেন হারুন অর রশীদ, সভপতি, বাংলাদেশ ফার্মাসিস্টস ফোরাম এবং মূল বক্তব্য প্রদান করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ সৈকত এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মেগেদী হাসান তানভীর স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সিনিয়র সহসভাপতি মো. আজিবুর রহমান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান শরন।
সুদূর অ্যামেরিকা থেকে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবসের শুভেচ্ছা প্রেরণ করেন বাংলাদেশ ফার্মাসিস্টদের অভিভাবক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক, পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে ফার্মাসিস্টদের যে কদর রয়েছে, যে সম্মান তারা পান, বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টদের সেই অবস্থান দেওয়া যায়নি। স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন ও বর্তমান বাস্তব প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী এ দাবি পূরণ করতে পারেন। তিনি আরও বলেন, ফার্মাসিস্টদের দাবি পূরণ করা আজ সময়ের দাবি। আমাদের এই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে অবশ্যই টেবিলে বসতে হবে। এই বিষয়ে বসে সমাধান করা উচিত।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) বলেন, ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব আমরা অনুধাবন করি। আমার বিশ্বাস ডিজিটাল বিশ্বে এই আলোচনা শুধু এই প্রেস ক্লাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সকল ব্যক্তির কাছে এই আলোচনা পৌঁছে যাবে, এভাবেই একদিন ফার্মাসিস্টদের দাবি বাস্তবায়ন হবে আমি আশা করি।
আলোচনা সভায় বক্তারা ফার্মাসিস্টদের অবদানের পাশাপাশি দেশে ফার্মাসিস্টদের যোগ্য মর্যাদার অভাব বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তাদের বক্তব্যের মূল কথাগুলো প্রায় একই সুরে গাথা ছিল।
বক্তারা বলেন, দুঃখের বিষয় হলো উন্নত বিশ্বের হাসপাতালগুলোতে যেখানে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগসহ সকল বিভাগ, এমনকি ওয়ার্ডেও সফলতার সাথে চিকিৎসক এবং নার্সদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছে, সেখানে ১৯৬৫ সালে ফার্মেসি শিক্ষা চালু হলেও আজও বাংলাদেশে প্রকৃত হসপিটাল ফার্মাসিস্ট (গ্র্যাজুয়েট) চালু হয়নি। যার জন্য আমাদের দেশের রোগীরা ওষুধ পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার ভুল ব্যবহার, সঠিক ডোজের অভাবসহ নানা সমস্যায় পড়ছেন। এমনকি ভুল ওষুধ সেবনের ফলে এদেশে মৃত্যুর বেশ কিছু ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। সকল ক্ষেত্রে আমরা উন্নত বিশ্বে সরকারি কর্মকর্তা পাঠিয়ে ভালো বিষয়গুলো শিখে আসি। কিন্তু মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির জন্য ফার্মাসিস্টরা এই ক্ষেত্রে কাজ করছে আমেরিকা, সমগ্র ইউরোপ এমনকি ভারত, পাকিস্তানেও। এসব দেশগুলোর হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কিভাবে কাজ করছে, তার সুফল কিভাবে রোগীরা এবং ডাক্তাররা পাচ্ছেন তাহা জানার জন্য কি আমরা আমাদের কোনো টিম বিদেশে পাঠিয়েছি! সত্য কথা হলো-এসব নিয়ে জানতে আমাদের দেশের কোনো টিমকে কখনও যেতে দেখা যায়নি। আমাদের অনেক সিনিয়র রাজনীতিবিদ এমনকি বড় বড় ব্যবসায়ী, আমলারা বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, তারা কি দেশে এসে ভুলে যান, ওখানে কিভাবে চিকিৎসা তারা পেয়ে থাকেন। একজন হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হসপাতালে ডাক্তারের কাজে যেমন সহযোগিতা করতে পারে, তেমনি নার্সদের কাজেও গতি আনতে পারে।
মজার বিষয় হলো ২০১৬ সালের ওষুধ নীতিতে স্পষ্ট করে লিখা আছে, ওষুধের উৎপাদন, নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ সকল ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট রাখতে হবে, হসপিটালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিতে বলা হয়েছে। ওষুধ প্রশাসনে ফার্মাসিস্ট দিয়ে তদারকির কথা বলা হয়েছে। ২০১৮ সালের বাংলাদেশ গ্যাজেটে স্পষ্ট করে তিন স্থানে মেডিকেল কলেজ, হসপিটালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের পোস্ট দেওয়া হয়েছে। এই গ্যাজেটকে কেন্দ্র করে নিয়োগ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ফার্মেসি কাউন্সিলের চিঠি চালাচালি হচ্ছে ২০১৯ সাল থেকে। আজ পর্যন্ত চূড়ান্ত নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন চোখে পড়ল না।
স্বাস্থ্যসেবায় ফার্মাসিস্ট না থাকা কখনই এককভাবে ফার্মাসিস্টদের সমস্যা নয়, এদেশের সকল নাগরিক, সকল রোগীর জন্যই ক্ষতিকর। রোগীর জন্য নিরাপদ ওষুধ, নিরাপদ ওষুধের ব্যবহার এবং তার তদারকি করাই হসপিটাল ফার্মাসিস্টের দায়িত্ব। হসপিটালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কি ধরনের কাজ করে আসুন তার একটা ধারণা নেওয়া যাক।
হসপিটালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ওষুধ বিতরণ, ওষুধের মান পরীক্ষা, ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ এবং পুনরায় প্রণয়ন, ওষুধের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস, এক ওষুধের সাথে অন্য ওষুধের ব্যবহারে কন্ট্রাইন্ডিকেশন থাকলে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে ওষুধ পরিবর্তন করা, রোগীর ওষুধ ব্যবহারের তথ্য সংরক্ষণসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হসপিটালে ফার্মাসিস্টরা করে থাকেন। হাসপাতালে ওষুধের সংরক্ষণ এবং ওষুধের পরিমাণের পরিকল্পনার জন্যও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকা জরুরি। এছাড়াও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা ওষুধের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সকলকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে। ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার, খরচ নিয়ন্ত্রণ ফার্মাসিস্টদের হাতে থাকলে সরকারের যেমন ওষুধ অপচয় কমবে, তেমনি জনগণ সঠিক ওষুধ সঠিক নিয়মে পাবে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই