শনিবার, ৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

কান্না থামছে না পাহাড়ে

১৫ বছরে ৩৫০ জনের মৃত্যু বৃষ্টির মৌসুম এলেই আতঙ্ক

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

কান্না থামছে না পাহাড়ে

২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড়ধস কেড়ে নেয় ১২৭ প্রাণ। এরপর গঠিত হয় ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’। কমিটির বৈঠক হয়, সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু পাহাড়ের মালিকরাই উদাসীন। ফলে পাহাড়ের কান্না কোনোমতেই থামে না। প্রতিনিয়তই প্রভাবশালী মহল দিনরাত সমানেই কাটছে পাহাড়। সাবাড় হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় খুঁটি খ্যাত প্রাকৃতিক এ সম্পদ। বৃষ্টি নামলেই তৈরি হয় পাহাড়ধসের শঙ্কা, আতঙ্ক। গত ১৫ বছরে পাহাড় ধসে মারা যান অন্তত ৩৫০ জন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের গবেষণাসূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরে ব্রিটিশ আমলে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ ১৭৬০ সালে প্রথম পাহাড় কাটার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম শহরসংলগ্ন ২০০টির বেশি ছোট-বড় পাহাড় ছিল। ১৯৭৬ সালে নগরের পাহাড়ের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটার। মাত্র ৩২ বছরে ১৮ দশমিক ৩৫ বর্গ কিলোমিটার পাহাড় কর্তন হয়। হারিয়ে যায় ৫৭ শতাংশ পাহাড়। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) ৩০ মে ‘পাহাড়রক্ষা’ শীর্ষক সেমিনারে ‘গত চার দশক আগে নগরে ২০০ পাহাড় ছিল। এর ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গত ৪০ বছরে ১২০টি পাহাড় বিলীন হয়ে যায়’ বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়। চবির ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ বলেন, ‘পাহাড় কোনোমতেই কাটা যাবে না। কাটলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ভারসাম্য নষ্ট হয়। অবশ্য এর নেতিবাচক খেসারত ইতোমধ্যে আমরা দিচ্ছি। তাই পাহাড় কাটা রোধে নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং স্থানীয়দের কঠোর অবস্থান নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘পাহাড়ের পরিবেশগত ছাড়াও অর্থনৈতিক অবদানও আছে। বিশে^র ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ মানুষ পাহাড়নির্ভর জীবিকা নির্বাহ করে। পাহাড়ে চাষাবাদ হয় নানা ধরনের অর্থকরী ফসল। পাহাড়ের কাঠ বিক্রিও একটি বড় পেশা। তা ছাড়া পাহাড়ে আঁকাবাঁকা ছড়ার বালুও ব্যবহৃত হয় আবাসন নির্মাণে।’ বেলার নেটওয়ার্ক মেম্বার আলীউর রহমান বলেন, ‘গত ৪০ বছরে চট্টগ্রাম নগর থেকে ৬০ শতাংশ পাহাড় বিলীন হয়ে গেছে। তাই বাকি পাহাড় রক্ষায় এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর, সিডিএ ও সিটি করপোরেশনকে এক হয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে।’

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, ইতোমধ্যে এ কমিটির ২৩টি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। সংস্থাগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসন নিয়মিত তদারকি করে। তিনি বলেন, গত বছর ২৪-৩০ জুলাই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে ২৫০টি পরিবারকে উচ্ছেদ ও ২৪ জুলাই অতিবর্ষণের সময় ১৩০টি পরিবারকে আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। তা ছাড়া প্রতি বছরই বর্ষার সময় অভিযানের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু পরে তারা আবারও ফিরে আসে। জানা যায়, ২০০৭ সালে এক দিনেই পাহাড় ধসে নারী, শিশুসহ মারা যান ১২৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে মারা যান ১৭ জন। ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন পাহাড় ধসে মারা যান ২৪ জন। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়ালধসে মারা যান দুজন। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান তিনজন, একই বছর ২১ সেপ্টেম্বর মাঝিরঘোনায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর মহানগরের আকবর শাহ থানার ফিরোজ শাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান চারজন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগে পাহাড় ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগর সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরে সরকারি-বেসরকারি অতিঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে ১৭টি। এসব পাহাড়ের পাদদেশই বাস করে ১ হাজার ২৩৫টি পরিবার। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় অবৈধভাবে বাস করা পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে- বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিঙ্ক রোড সংলগ্ন পাহাড়ে ৪০০ পরিবার, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে নয়টি পরিবার, রেলওয়ের মালিকানাধীন পাহাড়ে ১০টি পরিবার, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২২টি পরিবার, পূর্ব ফিরোজ শাহ ১ নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, মধু শাহ পাহাড়ে ৩৪টি পরিবার, পলিটকেনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩টি পরিবার, কৈবল্যধামস্থ বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি পাহাড়ে ২৬টি পরিবার, হারুন খান পাহাড়ে ৩৩টি পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩৪টি পরিবার, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়ে ১৬২টি পরিবার, লালখান বাজার মাদরাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ১১টি পরিবার।

এম আর সিদ্দিকীর পরিবার পাহাড়ে আটটি পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৩২টি পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১টি পরিবার ও আমিন কলোনি সংলগ্ন ট্যাংকির পাহাড়ে ১৬টি পরিবার।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর