মুক্তিযুদ্ধের তীর্থস্থান মেঘালয়ে যুদ্ধকালীন সতীর্থদের পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় বাংলাদেশের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া ভারতীয় সহোদর আমজাদ হোসেন ও আহমদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার বর্ণনা দেন। সেই সময়ে যুদ্ধে যোগ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর এখন এসেছেন ভারত সরকারের আমন্ত্রণে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে। এতগুলো বছর পর মেঘালয়ের শিলংয়ের মাটিতে পা রেখে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। গতকাল শিলংয়ের হোটেল পাইনউডে মিলিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এ মিলনমেলায় মুক্তিযুদ্ধকালের লড়াই-সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট, আবেগ-অনুভূতির স্মৃতিচারণ করেছেন তারা। ভারত সরকারের সৌজন্যে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন সফররত বাংলাদেশের ১৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এতে অংশ নেন আসাম-মেঘালয় অঞ্চল থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের কয়েকজনের স্বজন।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী (বীর বিক্রম)। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আসাম-মেঘালয়সহ সারা ভারতের মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি ভারতের ১১ শতাধিক সেনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলংয়ে ৫২ জন শহীদকে সমাহিত করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান থাকবে যেন শিলংয়ে শহীদদের সমাধিস্থলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরাসহ আরও যেখানে শহীদরা সমাহিত হয়েছেন, সেখানেও যেন এমন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের অক্ষরে লেখা। এ ইতিহাসগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও পৌঁছে দিতে হবে, যেন এই সম্পর্কের শেকড় সবাই জানে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল শিলংয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসে, টগবগে যুবক তখন এসেছিলাম যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। আর শেষ বয়সে এখন এলাম বন্ধু ভারত সরকারের আমন্ত্রণে। শিলংয়ের মানুষের তখনকার সহযোগিতা আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কখনো ভুলতে পারব না। এত বছর পর সেই স্মৃতির জায়গায় আসতে পেরে ভীষণ গর্ববোধ হচ্ছে, ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব এলাহী (বীরপ্রতীক) বলেন, আসাম-মেঘালয়সহ ভারতের এসব এলাকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীর্থভূমি। এ তীর্থভূমি থেকে এখানকার মানুষের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তারপর দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ে নেমেছেন।
তীর্থভূমিতে এসে সেই সময়ের স্মৃতিচারণের সুযোগ দেওয়াটাকে সম্মানের উল্লেখ করে তিনি এ আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল খাঁ মা-বাবার বাধা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, যেই আবেগ নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম, দেশ গড়তে সেই আবেগ ধারণ করতে হবে তরুণ প্রজন্মকেও।
অনুষ্ঠানে আরও স্মৃতিচারণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম, এম ফরিদুজ্জামান খান, মো. হারুন উর রশীদ, নাজমুল হাসান পাখি, গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাস, হাজী আবদুল জলিল, শফিকুল বাহার মজুমদার, শরীফ উদ্দীন, মো. শাহজাহান, আবুল বাশার, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি (বীরপ্রতীক)।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনস্বীকার্য ভূমিকার জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন শিলংয়ের তিন ভাই-বোন আহমেদ হোসাইন, আফজাল হোসাইন ও আশরাফী বেগম। এদের মধ্যে দুই ভাইও ছিলেন অনুষ্ঠানে। এ ছাড়া ছিলেন আরেক পুরস্কারপ্রাপ্ত বীর সেনানী অঞ্জলি লাহিড়ীর ভাগ্নে সুরজিৎ ও কয়েকজন ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধার স্বজন।
৮৮ বছর বয়সী আহমেদ হোসাইন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫২ শহীদের মৃতদেহ আসে শিলংয়ে। তাদের শিলং মুসলিম কবরস্থানে দাফন করা হয়। এই ইতিহাস অনেকেরই অজানা।
একটি ঘটনা তাকে অনেক বেশি নাড়া দিয়েছে উল্লেখ করে আহমেদ হোসাইন বলেন, এক দিন একটি লাশ এলো, বস্তা খুলে দেখি ১২-১৩ বছরের কিশোর, তার বুকে গুলি, এই ঘটনা আমাকে বেশ আলোড়িত করে। এমন বাচ্চাদেরও হত্যা করতে পারল হানাদার বাহিনী? এ ঘটনাই আমাকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে আসে।
এ সময় কর্নেল সাজ্জাদ জহির, ক্যাপ্টেন আনোয়ারসহ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তার স্মৃতি বর্ণনা করেন আহমেদ হোসাইন।
