শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
পার্বত্য শান্তিচুক্তি ২৫ বছর আজ

সন্ত্রাস চাঁদাবাজিতে ম্লান পাহাড়ের উন্নয়ন

শিমুল মাহমুদ

তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে সশস্ত্র সন্ত্রাস, প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিয়মিত লাশ পড়ছে। রক্ত ঝরছে সাধারণ মানুষের। আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা নিত্যসঙ্গী লাখো মানুষের। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির কারণে চার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে গত বছরে শতাধিক মানুষ গুম-খুন হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, গত ২৪ বছরে পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের হাতে ৯ শতাধিক মানুষ খুন হয়েছেন। গুম হয়েছে প্রায় দেড় হাজার। বছরে তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজিতে লিপ্ত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। এই প্রেক্ষাপট সামনে রেখে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্যাঞ্চলে শান্তির বার্তা নিয়ে স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। সরকারের তিন মেয়াদে শান্তিচুক্তির আলোকে পাহাড়ের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্যবাসীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের নানা প্রচেষ্টা ম্লান হয়ে যাচ্ছে চার সন্ত্রাসী গ্রুপের সন্ত্রাস ও জবরদস্তিতে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে জেএসএস (মূল) ও ইউপিডিএফ (মূল) এর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও গুম-খুনের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। সংস্কারপন্থি হিসেবে এই দুই সশস্ত্র গোষ্ঠীর দুটি উপ-দলও সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে জড়িত। ভুক্তভোগী বাঙালি ও পাহাড়িরা অভিযোগ করেন, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গাছের ফল, ফসল, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষক-শ্রমিক-মৎস্যজীবী, সড়কে চলাচলকারী যানবাহন, চাকরিজীবী, স্থানীয় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবার, দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানি, জমি কেনাবেচা, এমনকি ডিম-কলা বিক্রি করতে গেলেও চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি প্রায় ৫১ ভাগ মানুষ, বাঙালি ৪৯ ভাগ। সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিরা শান্তির পক্ষে। কিন্তু আধিপত্যের লড়াই, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত তাদের জীবন। অভিযোগ রয়েছে, সশস্ত্র গ্রুপের শীর্ষ নেতারা চাঁদাবাজির টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। বিদেশেও বাড়ি আছে কারও কারও।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে এলএমজি, এসএমজি/একে৪৭, ৭.৬২ মি.মি. রাইফেল, এম-১৬ রাইফেল, জি-৩ রাইফেল, ০.২২ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, পিস্তল, মর্টার, দেশীয় পিস্তল, দেশীয় বন্দুক, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ রকেট লাঞ্চারও রয়েছে।

এদিকে পার্বত্যাঞ্চলে গত ২৪ বছরে গুম হওয়াদের মধ্যে ৬০ ভাগ মুক্তিপণের টাকা দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। বাকিদের বিভিন্ন জঙ্গলে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। তবে সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে পাহাড়ের অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না। যারা সাক্ষী দিতে যায়, তাদেরও শাস্তি পেতে হয়। অনেকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু সাক্ষীর অভাবে তাদের সাজা হয়নি।

 

সন্ত্রাসে ম্লান পাহাড়ের উন্নয়ন

ফাতেমা জান্নাত মুমু, রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, যে পাহাড়ে ছিল না সড়ক। যে পাহাড় দেখেনি কখনো বিদ্যুতের আলো। যে পাহাড়ে ছিল না কোনো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল- সে পাহাড়ে এখন সড়ক, সেতু, কালভার্ট, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যুতে আলোকিত। উন্নয়নে বদলে গেছে তিন পার্বত্য জেলা। ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পরও পাহাড়ে কাক্সিক্ষত শান্তি ফিরেনি। বন্ধ হয়নি রক্তপাত, খুন, গুম, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি। সূত্র জানায়, পার্বত্য শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে ৪৮টি ধারা পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৫টি আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, তিন পার্বত্য জেলায় পরিষদ, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের আলাদা কোটা, সরকারি চাকরি,  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু, পার্বত্য ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হয়েছে। উপজেলা ও ইউনিয়নে বিদ্যুৎ সংযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তথ্য ও প্রযুক্তি, যোগাযোগ উন্নয়ন, মসজিদ, মন্দির, বিহার, সমাজকল্যাণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, প্রতিবন্ধী ও নারী উন্নয়ন, গৃহ নির্মাণ, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, পর্যটনসহ অসংখ্য খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়। সরকারের এসব উন্নয়নের সাফল্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসে, চাঁদাবাজিতে। রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, চুক্তির পর সরকার পার্বত্যাঞ্চল উন্নয়নের কথা রেখেছে। কিন্তু সন্তু লারমা পাহাড়ি-বাঙালির শান্তি সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রাখেননি। জেএসএস উল্টো পার্বত্যাঞ্চলে সরকারি দল নিধনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির আগে শান্তিবাহিনী নামে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন থাকলেও তা এখন ভেঙে ছয়টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনে রূপ নিয়েছে। তাদের অত্যাচার-নির্যাতনে জিম্মি পাহাড়বাসী।

তবে চুক্তির পরও পাহাড়ে অশান্তির জন্য নিজেদের দায় অস্বীকার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ও সাবেক এমপি উষাতন তালুকদার বলেন, চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড় অশান্ত রয়েছে। তার জন্য জনসংহতি সমিতি দায়ী নয়। পাহাড়ে এখনো সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রয়েছে। তবে ওই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জনসংহতির সম্পৃক্ততা নেই। চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে কিছু উগ্রবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী জনসংহতির নাম ক্ষুণ্ন করতে এ কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর