বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

চিকিৎসাবঞ্চিত সীমান্তবর্তী চার উপজেলার মানুষ

গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল

ফারুক আল শারাহ, লাকসাম

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার গোহারুয়ায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ শয্যা সরকারি হাসপাতাল স্থাপিত হলেও জনবল ও যন্ত্রপাতি সংকটে চিকিৎসাসেবা চালু নেই। হাসপাতালটি উদ্বোধনের ১৭ বছরেও চিকিৎসাসেবার সুফল পাননি সীমান্ত এলাকার চার উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। দ্রুত হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালুর দাবি স্থানীয়দের। জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৫ এপ্রিল নাঙ্গলকোট উপজেলার জোড্ডা পশ্চিম ইউনিয়নের গোহারুয়া গ্রামে ২০ শয্যা হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হাসপাতালটির অবস্থান হওয়ায় নাঙ্গলকোট, সোনাইমুড়ি, মনোহরগঞ্জ ও সেনবাগ উপজেলার সীমান্ত এলাকার লক্ষাধিক মানুষ এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন। দুই বছর পর ২০০৬ সালের ১৩ জুন হাসপাতালের নির্মাণকাজ শেষ হয়। ওই বছর ১৭ অক্টোবর জনবল নিয়োগ না করেই তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান হাসপাতালটির বহির্বিভাগ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের প্রায় দুই মাসের মধ্যে জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কেটে যায় বছরের পর বছর। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় হাসপাতাল এলাকা ঝোপ-জঙ্গলে ছেয়ে যায়। হাসপাতালের চারদিকে সীমানাপ্রাচীর না থাকায় গো-চারণভূমিতে পরিণত হয়। ২০১৪ সালের ৪ জুন হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার জন্য কুমিল্লা জেলা তৎকালীন সিভিল সার্জন মুজিবুর রহমান স্বাস্থ্য সচিবের কাছে চিঠি দেন। চিঠিতে জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকের ছয়টি এবং নার্স ও কর্মচারীর ছয়টি পদ অনুমোদন দেওয়া হয়। বিভিন্ন পদে আরও জনবল প্রয়োজন থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয়নি। অন্তর্বিভাগে চিকিৎসার জন্য ছিল না কোনো শয্যা। সংকট আর সমস্যা থেকেই যায়।

সরকারি চিকিৎসাবঞ্চিত এলাকাবাসীর কথা বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম হাসপাতালটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে চালু করতে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে অনুরোধ করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ওই বছর ২২ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল হাসপাতালটি পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের চিকিৎসাসেবা চালুর নির্দেশ দেয়। ওই সময় স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী শওকত মহীবুর রব হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার জন্য ২ কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬০১ টাকা বরাদ্দ চান। কিন্তু ওই বরাদ্দ না দেওয়ায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন সমস্যা থেকে যায়।

নানা সংকট ও সমস্যার মধ্যে ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর পুনরায় হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন মজুমদার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহকারী পরিচালক ডা. মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মজিবুর রহমান হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন।

দ্বিতীয় দফায় হাসপাতালের বহির্বিভাগ উদ্বোধন করা হলেও চিকিৎসাসেবার চিত্র ছিল বেহাল। চিকিৎসক ও নার্সরা তাদের খেয়ালখুশিমতো আসতেন-যেতেন। ছিল না প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। নিয়োগপ্রাপ্ত দু-একজন চিকিৎসক তাদের সুযোগ-সুবিধামতো এলেও ধীরে ধীরে তারাও আসা বন্ধ করে দেন। এর পর থেকে একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) ও একজন ওয়ার্ডবয় দিয়ে সপ্তাহে দু-তিন দিন নামেমাত্র চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়।

এরই মধ্যে ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। ওই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসপাতালটি পুরোদমে চালু করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেন। চাহিদাপত্র পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত পূরণ না হওয়ায় হাসপাতালটি আর চালু করা সম্ভব হয়নি।

সূত্র জানান, সর্বশেষ ২০২০ সালের জুনে তিনজন ডাক্তার, তিনজন নার্স, একজন ওয়ার্ডবয় ও একজন অফিস সহকারীকে পদায়ন করা হয়। বর্তমানে সেখানে আউটডোরে সেবা দিচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। তবে অন্তর্বিভাগ সেবা দেওয়ার জন্য এখনো কোনো শয্যা স্থাপন করা হয়নি হাসপাতালটিতে।

বর্তমানে তিনজন চিকিৎসক ও তিন নার্সের নিয়োগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে হাসপাতালে না গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সময় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মাঝে-মধ্যে সেবা দিতে এলেও ঘণ্টাখানেক থেকে চলে যান তারা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, নিরাপত্তাজনিত কারণেই চিকিৎসকরা সেখানে অবস্থান করেন না। তবে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখেছেন।

গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালু না হওয়ায় মুমূর্ষু রোগীদের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণের ঘটনাও ঘটে।  প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবার সুফল না পাওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সীমান্ত এলাকার চার উপজেলার মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দ্রুত হাসপাতালটির অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ চালুর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর