শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চায়ন হলো লোক নাট্যদল (সিদ্ধেশ্বরী) প্রযোজিত নাটক ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’। পদাতিক নাট্য সংসদের সাত দিনের উৎসবের দ্বিতীয় দিন গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চায়ন হয় নাটকটি। বুদ্ধদেব বসু রচিত নাটকের নির্দেশনায় ছিলেন লিয়াকত আলী লাকী। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন স্বদেশ দাশগুপ্ত, রুবেল শঙ্কর, আবু বকর বকশী, মাসউদ সুমন, ফারহানা মিলি, শামীমা তুষ্টি, মুমু মাসউদ, মূসা রুবেল, মাশরুবা যুথি, অনন্যা নিশি ও মিতু রহমান। তরঙ্গিণী অসাধারণ সুন্দরী এক বারবণিতা; যে তার পেশাগত দক্ষতা, ছলাকলায় শীর্ষে। যার অঙ্গুলিহেলনে যে কোনো পুরুষের হৃদয় হেলতে সময় নেয় না অনুক্ষণের; কিন্তু তার এই গর্ব, এই ক্ষমতা মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায় ঋষ্যশৃঙ্গের উচ্চারিত প্রশ্নের মাধ্যমে- ‘আপনি কি কোনো পথভ্রষ্ট দেবতা? নাকি আমারই কোনো অচেতন সুকৃতির ফলে স্বর্গ থেকে অবতীর্ণ হয়েছেন? ... আনন্দ আপনার নয়নে, আনন্দ আপনার চরণে, আপনার ওষ্ঠাধর বিশ্বকরুণার বিকীরণ!’ প্রথমে এ প্রশ্নে তরঙ্গিণী কৌতুকবোধ করেন কিন্তু সময়ের স্রোতে এ প্রশ্নই তরঙ্গিণীর আপন সত্তা ও স্বাতন্ত্র্য খোঁজার প্রধান সহায়ক হয়ে দেখা দেয়। তখন জানতে চায়, বুঝতে চায় তিনি আসলে কে? কী তার জীবনের উদ্দেশ্য? পুরুষমাত্রই কি রূপের স্তুতিকারী? না পুরুষ মানে নারীর পরিপূর্ণতার সহায়?
তরঙ্গিণীকে পুরুষবধের সব কলা শেখানো হয়েছে; কিন্তু দেওয়া হয়নি পুরুষ সম্পর্কে কোনো ধারণা, যে পুরুষ কেবলই নিরপেক্ষ ভালোবাসার বাহন।
পুরুষ মানেই যে কেবল সম্পদ আহরণের মাত্রা নয়, পুরুষ যে নারীর আলাদা এক চরিত্র তা প্রকাশের সহায়ক, তরঙ্গিণী কেবল ঋষ্যশৃঙ্গের কথার মাধ্যমেই বুঝতে পেরেছে। নারী স্বতন্ত্র, নারী এক আলাদা সত্তা; যেখানে বহিরাবরণের সঙ্গে তার অন্তরাবরণের সংযোগ কেবল নির্লোভ একান্ত চাওয়ায়, যা বৈষয়িক চাওয়াপাওয়ায় ভাস্বর নয়, যেখানে নারীর বাহ্যিক রূপ প্রধান। ঋষ্যশৃঙ্গ তরঙ্গিণীকে তার অন্তরাবরণের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করান যেখানে তরঙ্গিণী কেবলই একান্ত নারী, ভোগের উপাচার নয়।
এ নাটকের দুই উল্লেখযোগ্য চরিত্র ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণী ছাড়াও রয়েছে লোলাপাঙ্গী, চন্দ্রকেতু, বিভাজক, রাজমন্ত্রী, অংশুমান ও রাজকুমারী শান্তা যারা সবাই তাদের জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য, পাপপুণ্য, লাভ-লোকসানের হিসাবে ষোল আনা পাকা; ঠিক তাদের উল্টো চরিত্র ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণী। যারা আপন সত্তার উদ্বোধনের সাধনায় আপনাকে জানতে ও খুঁজতে ব্যাকুল। বৈষয়িক লাভক্ষতির ঊর্ধ্বে কেবল মানবিক দিকের প্রকাশ। স্বতন্ত্র ব্যক্তি ও সত্তা হিসেবে মানবমূল্য খোঁজা ও বোঝার চেষ্টায় যারা রত।