মানিকগঞ্জ শহরের পশ্চিম বান্দুটিয়া এলাকায় কবি মহিদুল সড়কের একটি দোতলা বাড়ি থেকে একই পরিবারের তিন ব্যক্তির লাশ ২৩ সেপ্টেম্বর উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের পাশে বিষের ট্যাবলেট পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, মা তার দুই সন্তানকে বিষ খাইয়ে নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। পারিবারিক কলহের কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা স্থানীয় লোকজনের।
৯ সেপ্টেম্বর ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আফরিন ও তার মা তাহমিনা বেগমকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, হত্যাকারী মোবারক হোসেন একটি মাদরাসার খাদেম। জানা গেছে, সুমাইয়া ‘জিনে ধরা’ সমস্যায় ভুগছিলেন। মোবারক হোসেন এক মাস ধরে সুমাইয়াকে ঝাড়ফুঁক করছিলেন। ঘটনার দিন মোবারক সুমাইয়াকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান। তাহমিনা বেগম ঘটনাটি দেখে ফেলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মোবারক তাহমিনাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পরে সুমাইয়াকেও শ্বাসরোধে হত্যা করেন।
১৬ সেপ্টেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সাদুল্যাপুর বটতলা গ্রামে প্রবাসীর স্ত্রী ও কলেজপড়ুয়া ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মামলায় দাবি করা হয়েছে, কনসার্টে যেতে মোটরসাইকেল না দেওয়ার জের ধরে জিসান নামে এক আত্মীয় ওই মা-ছেলেকে হত্যা করেছে। পুলিশ বলছে, আসামি জিসান নিহত রানী বেগমের মামাতো ভাই।
১৫ সেপ্টেম্বর রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের পলাশবাড়ি গ্রামে মানসিক অসুস্থতায় ভোগা মা তুলসী রানী নিজের পাঁচ মাস বয়সি কন্যাকে ঘরে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করেন। এরপর রক্তাক্ত শিশুটিকে স্বামী বাবু লালের হাতে তুলে দেন। গত ৩১ আগস্ট কুমিল্লা নগরের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের রামনগর এলাকা থেকে মা ও মেয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয়রা বলছেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে ওই বৃদ্ধার ছেলে ও তার স্ত্রী তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করেছে।
১৩ আগস্ট কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের জালালাপুর গ্রাম থেকে মা ও মেয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিক ধারণায় পুলিশ বলছে, তারা আত্মহত্যা করেছে। পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে ঋণগ্রস্ত বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাদের ধারণা, ঋণের কারণে বিষপানে মা ও মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
গত ২৯ জুন রাজধানীর মগবাজারে হোটেল সুইট স্লিপে একই পরিবারের তিন ব্যক্তির রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২৮ জুন পরিবারটি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থেকে ছেলে নাঈমের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসেছিল। মনিরের স্ত্রীর খালাতো ভাই দেলোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, খাবারের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। শুধু এই ঘটনাগুলোই নয়, ঢাকাসহ সারা দেশে এমন ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। সামাজিক অস্থিরতা এখন চরমে। ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে মানুষ। মাদকাসক্ত, ঋণগ্রস্ত, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য কলহ, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মনোমালিন্য-ঝগড়া-হতাশা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পরকীয়াসহ বিভিন্ন কারণে এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এজন্য দায়ী।
এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে এসব ঘটছে। এসব ঘটনার পেছনে সহমর্মিতার অভাব এবং ব্যক্তিনির্ভর জীবন গড়ে ওঠাকে দায়ী করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা, একে অপরকে ছাড় দেওয়ার মনোভাব গড়ে তোলা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট, সুস্থ পারিবারিক বিনোদনের অভাব, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দিনদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে পরস্পরের সঙ্গে বন্ধনের জায়গায় ঘাটতি হচ্ছে। কোনো ঘটনা ঘটার আগে অনেকগুলো কারণ দৃশ্যমান হয়। এগুলো পরিবার, সমাজ ও আশপাশের মানুষকে বুঝতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পরকীয়া অনেক বেশি বেড়েছে। মানুষের মধ্যে যে ধৈর্যশীলতা থাকা দরকার তা নেই। নৈতিকতা, মূল্যবোধ কমে গেছে। এসব মানসিক অস্থিরতা সহিংসতার মূল কারণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, যে কারণেই খুনের ঘটনা সংঘটিত হোক না কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
এসব ঘটনায় যারা জড়িত তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলে অন্যরা এসব অন্যায় করতে ভয় পাবে এবং এসব ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসবে। এসব কারণ কেন ঘটছে সেগুলো নিয়েও গবেষণা করা দরকার। আর সম্পর্কে অবনতির কারণে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর হামলা করছে। মূলত সামাজিক অনুশাসন ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে পারিবারিক সহিংসতা উদ্বেজনকভাবে বাড়ছে।