চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল। এখানকার করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডের ফোকাল পার্সন ডা. আবদুর রব মাসুম বর্তমান তৃতীয় দফায় করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধিতে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে লিখেছেন ‘আমরা কি আবার সেই ভয়ংকর দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছি’।
একই হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. রাজদীপ বিশ্বাস লিখেছেন ‘গতবছরের অভিজ্ঞতার চেয়ে এখনকার অভিজ্ঞতা গুরুতর ও ভিন্ন। বিশ্বাস করবেন, ফোনকলগুলো আবারও আসা শুরু হয়েছে, লক্ষণগুলো ভীত করে তুলছে’।
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কর্মরত দুইজন চিকিৎসকের এমন উৎকণ্ঠা ভাবিয়ে তুলেছে। প্রতিদিনই নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যা। চিকিৎসকদের শঙ্কা, করোনার বর্তমান চোখ রাঙানি গত বছরের ভয়াবহ, দুর্বিষহ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি করতে না তো?
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে গত ১২ মার্চ ভর্তি ছিল ৩৪ জন, ১৩ মার্চ ৩৭ জন, ১৪ মার্চ ৩৬ জন ও ১৫ মার্চ ৩৯ জন। এর আগের সপ্তাহে গড়ে ভর্তি ছিল ২০ থেকে ২৫ জন করে। এ হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যা থাকলেও সবগুলো পূর্ণ থাকে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ১০০ শয্যায় চলছে করোনার চিকিৎসা। এখানে গত ১০ মার্চ ভর্তি ছিল ৬৮ জন, ১১ মার্চ ৭৮ জন, ১২ মার্চ ৮০ জন, ১৩ মার্চ ৮২ জন ও ১৪ মার্চ ৮১ জন। ১৫ দিন আগেও এখানে রোগী ভর্তি ছিল ৩০ থেকে ৪০ জন করে।
জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. রাজদীপ বিশ্বাস বলেন, আমরা যারা গতবছর করোনার ভয়াবহ চিত্র সরাসরি দেখেছি, তারাই সবাই আগে এই ভয় থেকে মুক্তি চাই। তাই কেউ না শুনলেও এবং মানুষের
মানুষের উপহাসের পাত্র হব জেনেও বলছি, যে শৈথিল্য, উদাসীনতা ও উল্লাস নিয়ে আমরা জন্মদিন, বিয়ে-বার্ষিকী, ফ্যামিলি-নাইট ও পিকনিকসহ পারিবারিক-সামাজিক অনুষ্ঠান এবং সভা-সমাবেশে জনসমাগম হচ্ছে তাতে বলা যায়, ভয়াবহ এক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পরিসংখ্যান নয়, গত কয়েকদিনের আইসিইউ অভিজ্ঞতা যে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে, তা গতবছরের অভিজ্ঞতার চেয়ে গুরুতর ও ভিন্ন। ফোনকলগুলো আবারও আসা শুরু হয়েছে।’
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, করোনা ভিন্ন রূপ নিয়ে সংক্রমণ শুরু করেছে। তাই সামাজিক সকল জমায়েত থেকে দূরে থাকা, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিরাপদ রাখা, গত বছরের মত স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলা, নিজে মাস্ক পড়া ও অন্যকে পড়তে বাধ্য করা, হাত সাবান দিয়ে বারবার ধোয়া ও অপ্রয়োজনে বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করা জরুরি।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. মাহমুদা সুলতানা আফরোজা বলেন, আক্রান্তের হার ২ শতাংশের আশ-পাশে থাকায় সবাই অনেকটা করোনা জয় করছে বলে মনে করেছেন। ফলে অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানায় যথেষ্ট শিথিলতা দেখাচ্ছেন। মাস্ক না পড়া, সামাজিক দূরত্ব না মানা, কোলাহল বেশি করা, পর্যটন ও বিপণীকেন্দ্রগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে ভিড় বেড়ে যায়। মাত্র এক-দুই মাসের মধ্যেই আমরা এর চরম খেসারত দিতে শুরু করেছি।
চিকিৎসকরা মনে করছেন, অনেকের ধারণা, ভ্যাক্সিনের প্রথম ডোজের পরপরই সুরক্ষিত হয়ে গেলেন। তাই মাস্ক ছাড়াই ঘুরাফেরা শুরু করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো- ভ্যাক্সিনের দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার দুই সপ্তাহ পরই প্রোটেক্টিভ এন্টিবডি রক্তে থাকবে। ভ্যাক্সিনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মারাত্মক কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা দেয়া। ভ্যাক্সিন দিলেও উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত এবং সঙ্গে রোগটি ছড়াতেও পারে।
করোনারোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ভাইরাস চলৎশক্তিহীন, নির্দিষ্ট জীবিত কোষ ছাড়া বংশবৃদ্ধি করতে পারেনা। তাই একে নির্মূল করার একমাত্র উপায় জীবিত কোষের সংস্পর্শে আসতে না দেয়া। জীবিত কোষ ছাড়া ৭২ ঘণ্টার বেশি এরা বাঁচতে পারেনা। তাই মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও নিয়মিত হাত ধোয়ার মাধ্যমে ভাইরাসটিকে রুখে দেয়া সম্ভব।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ মার্চ নতুন করে আক্রান্ত হয় ১৩০ জন, ১৪ মার্চ ১৫৩ জন, ১৩ মার্চ ৯৪ জন, ১২ ও ১১ মার্চ আক্রান্ত হয় ১৩১ জন করে, ৯ মার্চ আক্রান্ত হয় ১২৭ জন, ৮ মার্চ ১২২ জন, ৪ মার্চ ১০৭ জন ও ৩ মার্চ ৯৭ জন আক্রান্ত হয়। কিন্তু এর আগে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আক্রান্ত হয় ৩ জন, ১২ ফেব্রুয়ারি আক্রান্ত হয় ৭ জন, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৫ জন আক্রান্ত হয়।
গত জানুয়ারি মাসের ২০ দিন এবং ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ দিন আক্রান্তের সংখ্যা একশ’র নিচে ছিল। গত সোমবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট আক্রান্ত হয় ৩৬ হাজার ৬৮৬ জন। এর মধ্যে মহানগরে ২৮ হাজার ৯৪৮ জন ও ১৫ উপজেলায় ৭ হাজার ৭৪৮ জন। ইতোমধ্যে আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন ৩৮২ জন। এর মধ্যে মহানগরে ২৮১ জন এবং ১৫ উপজেলায় ১০১ জন। গত সোমবার একদিনে করোনায় মৃত্যু হয় দুইজনের।
বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর