শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

উত্থান-পতনে পোলট্রি শিল্প

মোঃ শামীম কাদির, জয়পুরহাট

উত্থান-পতনে পোলট্রি শিল্প

জয়পুরহাটের মুরগি খামারের অধিকাংশ কখনো লাভে আবার কখনো লোকসানে যায়। লাভ-লোকসানের এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে এ শিল্পে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানে থাকা কয়েক লক্ষাধিক মানুষের রুজি-রোজগারের পথও চলছে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকলেও কয়েক বছর ধরে পোলট্রি খামারিদের লোকসানই যেন নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে। তাই এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন পোলট্রি খামারি ও ব্যবসায়ীরা। জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য সোনালি মুরগি। আর জেলায় এ পোলট্রি শিল্পের বিপ্লব ঘটে প্রায় দুই যুগ আগে। জেলায় এ শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে জয়পুরহাট সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। জেলাজুড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে সাড়ে ১০ হাজারের বেশি মুরগির খামার আছে। পোলট্রি শিল্পকে ঘিরে ফিড মিলও গড়ে উঠেছে। জেলার আড়াই লাখ মানুষ এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। জেলায় পোলট্রি শিল্পে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এ শিল্পে সারা দেশের মধ্যে জয়পুরহাট দ্বিতীয় আর সোনালি মুরগি উৎপাদনের দিক থেকে প্রথম। সোনালি জাতের এই মুরগির উদ্ভাবনও জয়পুরহাটে। সরেজমিনে দেখা গেছে, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রুকিন্দীপুর ইউনিয়নের জামালগঞ্জে অবস্থিত সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। ব্রিটিশ আমলে অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে ৩০ বিঘা জমিতে সরকারি এ খামারটি নির্মিত হয়। তবে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হওয়ার পরে খামারটি সংস্কার না করায় জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে ১২টি শেড, এর মধ্যে চারটি শেড পরিত্যক্ত। পদসংখ্যা ২১ জন হলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ছয়জন। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জামালগঞ্জে অবস্থিত এই খামারের প্রথম নাম ছিল সরকারি হাঁস-মুরগির খামার। এখন হাঁস বাদ দিয়ে নামকরণ হয়েছে সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। ২০০০ সালের পর মূলত জেলায় পোলট্রি শিল্পের বিপ্লব ঘটে। তৎকালীন সরকারি হাঁস-মুরগি খামারের সহকারী পরিচালক মো. শাহ জামাল সোনালি জাতের মুরগি উদ্ভাবন করেন। প্রথমে শাহাপুর গ্রামের ১০টি মুরগির খামারে নতুন জাতের এ সোনালি মুরগি পরীক্ষামূলকভাবে লালনপালন শুরু হয়। নতুন উদ্ভাবিত সোনালি জাতের এ মুরগি দেখতে অনেকটা দেশি মুরগির মতো। মাংসের স্বাদও একইরকম হওয়ায় খুব সহজে এ মুরগির মাংস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।  ২০১০ সালে দেশব্যাপী নতুন জাতের এ সোনালি মুরগির বিস্তৃত লাভ করে। জয়পুরহাট জেলাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে একের পর এক বাণিজ্যিকভাবে সোনালি মুরগির খামার গড়ে ওঠে। আগে যে জমিতে ফসলের চাষ হতো, এখন সেখানে গড়ে উঠেছে চারতলা থেকে ছয়তলার মুরগির খামার। জয়পুরহাটসহ এ জেলার নিকটবর্তী কয়েকটি অঞ্চলগুলোতে ১১টি পোলট্রি ফিড কারখানা ও ৬৩টি হ্যাচারি নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি বৃহৎ পোলট্রি জোন। এখান থেকে প্রতিদিন ৩ লাখ এক দিনের সোনালি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন এবং খামারগুলো থেকে বছরে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন মুরগির মাংস ও প্রায় ৪০ কোটি ডিম উৎপাদন হতো। যা দেশের মানুষের আমিষের চাহিদার ৫০ ভাগ জোগান দিত এখানকার পোলট্রি খামারগুলো। তবে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ সরকারি হাঁস-মুরগি খামারকে কেন্দ্র করে এখানে পোলট্রি জোন গড়ে উঠার পর দীর্ঘ সময়ের মধ্যে নানা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে এখানকার শিল্প। কাঁচামালের শতকরা ৮০ ভাগ আমদানি নির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেশি। মুরগি ও ডিম রপ্তানি না হওয়া, চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের সমন্বয়হীনতা, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকা, খাদ্য-ওষুধ দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি।

এ ছাড়া অনেক সময় নিম্নমানের, খাদ্য-ওষুধ-ভিটামিনের খাওয়ানোর ফলে রোগ-ব্যাধিমুক্ত না হয়ে বরং মৃত্যু হার বৃদ্ধি পাওয়া বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঠিক ওজন না হওয়া। মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়া বা দালালদের দৌরাত্ম্য, পাইকারি ও খুচরা বাজার মূল্যের বিস্তর পার্থক্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যোগাযোগ বিঘ্নিত হলে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুরগি ও ডিম সরবরাহ বন্ধ হওয়া। মুরগির বাচ্চা-খাদ্য-ওষুধসহ বিভিন্ন উপকরণ বাকিতে বেচাকেনা, দরিদ্রসহ নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি কারণে দেশের মধ্যেই মুরগি ও ডিমের বাজার সীমিত হয়ে পড়ায় স্থানীয় বাজারগুলোতে বাড়তি চাপে অধিকাংশ সময় অস্থিতিশীল থাকে। এ ছাড়া করোনার কারণে ক্রমাগত লোকসানে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ লোকসানের পর বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজার পোলট্রি খামার চলমান রয়েছে। জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার জামালগঞ্জের শেফালি পোলট্রি খামারের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, তিনি প্রথমে খুব ছোট পরিসরে মুরগির খামার শুরু করেন। এখন ৩০টি খামার। তার মধ্যে চারটি ছয়তলা, একটি তিনতলা, বাকি সব একতলা বিশিষ্ট মুরগির খামার। সম্ভাবনাময় এ শিল্পটিতে বর্তমানে প্রায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। আবার প্রতিনিয়ত খাদ্যের দামও বাড়ছে। ওষুধের দাম চারগুণ বেড়েছে আবার শ্রমিকের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ওমর পোলট্রি খামারের মালিক মনোয়ার হোসেন বলেন, বর্তমানে তার তিনতলা বিশিষ্ট খামারে ১০ হাজার মুরগি রয়েছে। লাভজনক হওয়ায় অনেকেই এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। তবে এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। জয়পুরহটের আক্কেলপুর উপজেলার জগদীশপুর গ্রামের মোতালেব হোসেন ও মিন্নুর মিয়া বলেন, এক সময়ে এই পোলট্রি শিল্পে সুদিন থাকলেও ক্রমাগত লোকসানের কারণে খামার বন্ধ করে দিয়েছি। বিজলী ফিডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বু হোসাইন বলেন, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার বাজারে মুরগির দাম কম হওয়ায় অনেক খামারি লাভবান হতে পারছেন না। আর অনেক উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং আরও উদ্যোক্তা তৈরি করতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পদ্মা ফিড অ্যান্ড চিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল হক আনু জানান, কাঁচামালের মূল্য নির্ধারণ হয় ডলারের মূল্যের ওপরে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় মুরগি খাদ্যের দামও বৃদ্ধি হয়। দেশে জরুরি আমিষ সরবরাহকারী জয়পুরহাট পোলট্রি শিল্পে উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় চরম গাফিলতি কর্তৃপক্ষের। এমন মন্তব্য করে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মুরগি ও ডিম উৎপাদন নীতি বাস্তবায়নের দাবি জানান পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ঘনিষ্ঠরা। জয়পুরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও পোলট্রি ব্যবসায়ী আহসান কবির বিপ্লব বলেন, এ শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পোলট্রি শিল্প স্থবির না হয় ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা হলে পোলট্রি শিল্পে কর্মরত জেলায় লাখ লাখসহ সারা দেশের কয়েক লাখেরও বেশি নারী-পুরুষ বেকার হবে। তাই পোলট্রি শিল্পের এ দুরবস্থা থেকে রক্ষা করতে এখানে মুরগি মাংস প্রসেসিং প্ল্যান্টসহ হিমাগার প্রয়োজন। করোনার কারণে ক্রমাগত লোকসানে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ লোকসানের পর বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজার পোলট্র্রি খামার চলমান রয়েছে। করোনাকালীন সরকার খামারিদের স্বল্প সুদে সহজ শর্তে ঋণ দিলেও অনেকেই ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। এ ছাড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি ভর্তুকিসহ রপ্তানির জন্য সরকারের পদক্ষেপ আশু প্রয়োজন। জয়পুরহাট সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামারের উপপরিচালক জুয়েল রানা বলেন, সরকারি পুরাতন ও বড় খামারের মধ্যে প্রথম সারির খামার এটি। এই খামারকে কেন্দ্র করে জেলায় হাজারো উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। জেলার আড়াই লাখ মানুষ এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে বর্তমানে খামারটির ১২টি শেডের সব জরাজীর্ণ। এর মধ্যে চারটি পরিত্যক্ত। খামারে বর্তমানে মুরগি রয়েছে ৭ হাজার। খামারটি যদি দ্রুত গতিতে সংস্কার না করা হয় তবে খামারটির ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন হবে। জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাহফুজার রহমান বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর খামারিদের প্রশিক্ষণ, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও কারিগরি সহায়তায় নিবিড় তদারকি করছে। এ শিল্পের অব্যাহতি উন্নতি ধরে রাখার পাশাপাশি জনসাধারণের প্রাণিজ পুষ্টি নিশ্চিতকরণে কৃষি বিভাগের ন্যায় ভর্তুকি দেওয়া হলে দেশে আমিষের চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে এবং এ শিল্পে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে বলে তিনি আশা করেন।

সর্বশেষ খবর