বাগেরহাটের অধিকাংশ হ্যাচারি বন্ধ থাকায় বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণুর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ সুযোগে চোরাইপথে ভারত থেকে আসা অবৈধ রেণু পোনা দখল করে নিয়েছে বাজার। জেলার ফকিরহাট উপজেলার ডাকবাংলা মোড়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ চিংড়ি রেণু মার্কেটসহ জেলার সর্বত্র অবাধে বিক্রি হচ্ছে ভারত থেকে আনা চিংড়ির রেণু। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নদী থেকে পোনা আহরণে নিষেধাজ্ঞা ও জেলার অধিকাংশ হ্যাচারি বন্ধের ফলে রেণুর চরম সংকট তৈরি হয়েছে। ফকিরহাটের চিংড়ি রেণু মার্কেটের ব্যবসায়ী শেখ ওহিদুজ্জামান বলেন, চাহিদা অনুযায়ী বাগেরহাটসহ দেশীয় হ্যাচারিগুলোতে রেণুর উৎপাদন হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে আমরা ভারতীয় রেণু আমদানি করছি। যদিও এটা অবৈধ। কিন্তু আমাদের করার কিছু নেই। একই মার্কেটের ভৈরব হ্যাচারির মালিক নন্দ সাহা বলেন, আমরা প্রথমদিকে হ্যাচারিতে যে পোনা উৎপাদন করতাম তার মান ভালো হতো না। এ ছাড়া পোনা নানা ভাইরাসে আক্রান্ত হতো। যে কারণে চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়তেন। তাই হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন বাদ দিয়ে আমরা অবৈধভাবে ভারত থেকে আসা বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু হ্যাচারিতে মজুত করে স্থানীয় চাষিদের কাছে বিক্রি করছি। ভারতীয় পোনার মান তুলনামূলক অনেক ভালো। তা দ্রুত বড় হয় এবং চাষিরা লাভবান হন। হ্যাচারিতে উৎপাদিত রেণুর মান ভালো না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ভৈরব হ্যাচারির অপর মালিক নুরুল শেখ বলেন, হ্যাচারিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণুর জন্ম হয়। কিন্তু এ রেণু মৎস্য ঘেরে ছাড়া হলে প্রকৃতিতে খাপখাইয়ে নিতে সময় লাগে। বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রেণু মারা যায়। কিন্তু ভারতে চিংড়ি রেণু তৈরি করা হয় প্রাকৃতিকভাবে। তারা নদীতে নেট জালের মাধ্যমে বিশাল একটা অংশ ঘিরে সেখানে পুরুষ ও স্ত্রী প্রজাতির চিংড়ি রেখে প্রাকৃতিকভাবেই রেণু উৎপাদন করে। ফলে তাদের রেণু প্রকৃতিতে দ্রুত খাপখাইয়ে নিতে পারে এবং গ্রোথ ভালো হয়। আমাদের এ রেণু সংকট কাটাতে হলে, ভারতের মতো আমাদেরও নদীতে প্রাকৃতিকভাবে রেণু উৎপাদন করতে হবে।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার চিংড়ি চাষি সুকান্ত মণ্ডল বলেন, ভারতীয় পোনার দাম বেশি হলেও এর গুণগতমান ভালো হওয়ায় উৎপাদন খরচ কম এবং লাভ বেশি হয়। তাই বেশি লাভের আশায় চাষিরা এখন ভারতীয় (মেদিনীপুর সুপার) রেণুর দিকে ঝুঁকছেন। ফকিরহাট চিংড়ি পোনা আড়তদার সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘নদী থেকে পোনা আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পাশাপাশি বাগেরহাটের অধিকাংশ হ্যাচারি এখন বন্ধ। ফলে পোনার চরম সংকট তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চিংড়ি শিল্প বাঁচাতে ভারতীয় পোনার বিকল্প দেখছি না।’ বর্তমান সংকট কাটাতে নদী থেকে পোনা ধরার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে হবে। তা না হলে এই শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়বে। বাগেরহাট থেকে সদ্য বদলি হওয়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম রাসেল বলেন, জেলায় প্রায় ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদা ও গলদা মিলিয়ে মৎস্য ঘের রয়েছে ৭৭ হাজার। জেলায় বছরে গলদা ও বাগদা চিংড়ির রেণুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ১০০ কোটি। এর বিপরীতে জেলার বিভিন্ন হ্যাচারি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২ থেকে আড়াই কোটি রেণু। বাগেরহাট জেলায় ১৩টি হ্যাচারির মধ্যে চালু রয়েছে মাত্র ৪টি। তাই চাহিদা মেটাতে পোনা ব্যবসায়ী ও চিংড়ি চাষিরা আহরণ নিষিদ্ধ নদীর পোনা ও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অবৈধ পথে পোনা আমদানি করছেন। এ সংকট সমাধানে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে নতুন নতুন হ্যাচারি তৈরি করতে হবে। দেশীয় হ্যাচারিগুলোতে ভাইরাসমুক্ত চিংড়ি রেণু উৎপাদন করা গেলে চাষিরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি রেণু সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।