বিখ্যাত সব গায়ক-গায়িকাদের গান তো সংগ্রহে রেখেছেনই এছাড়াও স্থানীয়ভাবে গাওয়া অসংখ্য গান সংগ্রহ করেছেন বাবুল। বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিখ্যাত মানুষগুলোকে তুলে ধরতেই শত কাজের মাঝেও তিনি এসব রেকর্ড সংগ্রহ করে চলছেন। শুধু সংগ্রহই নয়, রীতিমতো আসর বসিয়ে এলাকার মানুষকে তা শুনাচ্ছেনও তিনি।
আশপাশের কোনো এলাকায় কারো বিয়ে হলে নিজ উদ্যোগে সেখানে মাইক বাজিয়ে পুরনো গান বাজিয়ে ভুলে যাওয়া স্মৃতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন এই বাবুল। বিখ্যাত সব গায়ক গায়িকাদের গান শুনতে শুনতে তিনিও এখন এলাকায় বিখ্যাত হতে চলেছেন। তার কণ্ঠের গানও মুগ্ধ করে স্থানীয়দের।
গান পাগল এই মানুষটি হলেন ঠাকুরগাঁওয়ের মাসুদ রানা বাবুল। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ভেলাজান নামক স্থানে তার বাড়ি। চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। পাশাপাশি এসব শখের 'পাগলামি'তে মেতে থাকেন।
বর্তমান ডিজিটাল স্রোতে বাংলা গানের প্রতি এখনকার প্রজন্মের আগ্রহ খুব একটা দেখা যায় না। আর তার উপর যদি বাংলা সিনেমার গানের কথা উঠে, তাহলে তো কথাই নেই। তবুও পুরনো দিনের বাংলা ছবির এমন কিছু গান আছে যা এখনো চিরস্মরণীয়। হারানো দিনের সেই গানের কথা আর আবেগের বহিঃপ্রকাশ এখনকার বাংলা গানে খুব একটা দেখা যায়না।
আর পুরোনো দিনের গানের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য বাবুল সংগ্রহ করছেন পুরনো দিনের গানের দুর্লভ সব রেকর্ড, লং প্লেয়িং ও রেকর্ড এলপি।
১৯৭৫ সালে সদর উপজেলা ভেলাজান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। স্কুল জীবন শুরু হয় গ্রামের পাশেই পাহাড়ভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাবুল বলেন, 'ছোটবেলা থেকে দেখতাম বড় ভাই ডা. আনসারুল ইসলাম পুরনো দিনের গান শুনতেন। সেই গান শোনার জন্য গ্রামের সকল মানুষ কাজকর্ম শেষে সন্ধ্যায় বাড়ির আঙ্গিনায় গান শোনার জন্য আসর বসাতেন। আমিও মনোযোগ দিয়ে শুনতাম সেসব গান। সেই সব গান আমার হৃদয় স্পর্শ করতো তখনই।'
'১৯৮৭ সালে পাহাড়ভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। তারপর ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। যখন গ্রামের বাসায় যেতাম বন্ধুদের নিয়ে মাইকের মাধ্যমে সেই পুরনো দিনের গান বাজাতাম। গ্রামে কোনো বিয়ে বা অনুষ্ঠান হলে মাইক ছাড়া চলতোই না তখন। অনেক সময় মাইক না পাওয়া গেলে বিয়ে বা অনুষ্ঠানের তারিখ পরিবর্তন করা হতো।'
বাবুল আরও বলেন, 'গ্রামের বিয়েতে কয়েকজন নারী বিয়ের গান গাইতো, যা গ্রামের ‘গিত’ নামে পরিচিত ছিল। এখন আর কোনো বিয়েতে গিত গান গাওয়া হয় না। হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার গিত। আমি এসব গিত গান সংগ্রহ করতে চাই। ইতোমধ্যে এসব গান সংগ্রহের জন্য গ্রামের বয়স্ক নারীদের দিয়ে গিত গেয়ে রেকর্ড করেছি।'
'পড়ালেখার পাশাপাশি মনে হলো পুরনো দিনের গানগুলো তো হারিয়ে যেতে বসেছে। কেউ শুনে না সেই সব গান। এগুলো সংগ্রহ করা দরকার। না হলে এক সময় নতুন প্রজন্ম আগের ঐতিহ্যকে ভুলেই যাবে। শুরু করলাম গানের রেকর্ড সংগ্রহের কাজ। দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে প্রখ্যাত শিল্পীদের রেকর্ড সংগ্রহ করেছি।'
'পরবর্তীতে ২০০১ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ শুরু করি। কাজের পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া গানগুলোকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে গ্রামে বয়স্ক ও নতুনদের নিয়ে এখনো গানের আসর বসাই।'
মাসুদ রানা বাবুল জানান, 'ইন্টারনেটের যুগে পুরনো দিনের গান হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমান প্রজন্ম জানেই না আগের সময়ের গান অনেক মিষ্টি। সেসব গান এখনো শুনলে শরীর শিউরে ওঠে। আগের এসব গান মানুষের মনে জাগিয়ে রাখার জন্য আমার এই প্রচেষ্টা। আমি এখনো আমাদের গ্রামে আসর বসিয়ে আগের এসব গান শুনাই মানুষকে। ফোনে এসব গান রেকর্ড করে গানগুলো ছড়িয়ে দেই মানুষের মাঝে।'
নিজের কাছে এখনো পুরনো দিনের দুর্লভ প্রায় দুই হাজার রেকর্ড সংরক্ষিত রয়েছে বলে দাবি করেছেন বাবুল। কেএল সাইগেল, ভূপেন হাজারি, পান্না লাল ভট্টাচার্যের গান, আব্দুল আলীম, দেবব্রত বিশ্বাসসহ অনেক পুরনো দিনের গান রয়েছে বাবুলের কাছে। তিনি বলেন, 'আমি এগুলো এখনো কোনো বিয়ে হলে আমাদের এলাকায় বাজিয়ে শুনাই। এই গানের ক্যাসেটগুলো আমার সন্তানের মতো।'
বাবুল আরও বলেন, '৭৮ আরপিএম গালার রেকর্ড আজ আর আগের মতো মেলে না। রেকর্ড পাড়ায় আজ আকাল। গালার কালো চাকতি-বন্দি হারানো দিনের সেই সব গান আজও ছুঁয়ে যায় নস্ট্যালজিয়া। গ্রামোফোনে দম দিয়ে কালো লেবেলের সেই বিখ্যাত ‘কুকুর ও গ্রামোফোন’ মার্কা রেকর্ড চাপিয়েই শুরু হয়ে যেত গান। আর স্টাইলাসের ৭৮ স্পিডে ঘুরতে ঘুরতে মিশে যেত লেবেলের পরিচিত ছবি। ঠিক তেমনই যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষের রেকর্ড-সংস্কৃতি।'
ষাটের দশকে বন্ধ হয়ে যায় ৭৮ আরপিএম-এর গালার রেকর্ডের যুগ। শুরু হয় ইপি ও লং প্লেয়িং রেকর্ডের যুগ। তারপরে ২০০২-এ ভারতের রেকর্ড কালচার শতবর্ষ পেরিয়েছে। আর শতবর্ষের রেকর্ডে সঙ্গীত কেবল মাত্র বিনোদনের গন্ডি অতিক্রম করে আজ হয়ে উঠেছে ইতিহাস। তাই পুরনো রেকর্ড আজ গবেষণা ও সংগ্রহের বিষয়।
মাসুদ রানা বাবুল একজন গান সংগ্রহক নয় তিনি খুব সুন্দর গানও করেন। তিনি হারমুনিয়াম দিয়ে গান গেয়ে এলাকায় অনেক সুনাম অর্জন করেছেন। এলাকায় সকলের কাছে তিনি 'গান পাগল বাবুল' হিসেবে পরিচিত। যে কোনো অনুষ্ঠানে তার গাওয়া গান না হলে বা তার সগ্রহের গান না বাজলে অনুষ্ঠান যেন পূর্ণতা পায় না। তিনি বর্তমান প্রজন্মের একজন লুকায়িত গান সংগ্রহক ও গায়ক।
বিডি প্রতিদিন/৩০ অক্টোবর ২০১৬/হিমেল-০৯