সকালে ছিল ভিটেবাড়ি আর দুপুরের মধ্যে নিমিষেই বাড়িঘর তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়ে যায় আব্দুল কাইয়ুমের। চোখের সামনে এমন দৃশ্য মেনে নিতে পারছেন না কাইয়ুম। ভিটেবাড়ি হারিয়ে তিনি এখন দিশেহারা। শুধু কাইয়ুম নয়, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের ৭ নং গোবরধন ওয়ার্ডে বসবাসরত মান্নান, সাদেকুল, গফফার, তার ছেলে মশিয়ার, এছোব আলী, এছোব উদ্দিনসহ ১২টি পরিবারের বাড়িঘর বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যে তিস্তা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। নদী ভাঙ্গনের স্বীকার পরিবারগুলোর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে সেখানকার আকাশ-বাতাস। তিস্তার ভাঙ্গন থেকে বাড়িঘর কোন রকম রক্ষা করতে পারলেও রক্ষা করতে পারেনি মূল্যবান গাছপালা। শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে এসব পরিবার আজ দিশেহারা।
এমনই দৃশ্য দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নে।
সরেজমিন ঘুরে দেখাগেছে, তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ায় প্রবল স্রোত মহিষখোচা ইউনিয়নের সলেডি স্পার-২ সংলগ্ন এলাকা ও গোবরধন ৭ নং ও ৮ নং ওয়ার্ডের কিছু অংশে আঘাত হানে।
এদিকে বুধবার রাত এগারটার দিকে সলেডি স্পার-২ এর ভাটিতে থাকা ৮টি পরিবারের বাড়িঘর মাত্র ৩০ মিনিটের মাথায় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। খবর পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী ও স্থানীয় এলাকাবাসী তিস্তা নদীর হাত থেকে এসব পরিবারের বাড়িঘর উদ্ধার করে অন্যত্র সরিয়ে নেন। কিন্তু এসব পরিবারের মূল্যবান গাছপালা চোখের পলকে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। আর সলেডি স্পার-২ এর বাঁধটি তিস্তা নদী আঘাত হানতে শুরু করে। খবর পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্বাবধানে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মহিষখোচা ইউনিয়নের সলেডি স্পার-২ বাঁধটি রক্ষার জন্য প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ২ হাজার ৪শ জিও ব্যাগে বালু ভরাট করে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সেই সাথে মজুদ রাখা দেড় হাজার সিসি ব্লকও ফেলা হচ্ছে তিস্তা নদীতে।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সলেডি স্পার-২ এর উজানে গোবরধন ৭ নং ওয়ার্ডে তিস্তায় তীব্র আকার ভাঙ্গন দেখা গেছে। এসময় নিমিষেই সেখানে প্রায় ১২টি পরিবারের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। গত এক সপ্তাহ পূর্বে তিস্তায় ২২টি পরিবারের বাড়িঘর বিলীন হয়ে যায়। ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে রয়েছে গরীবের হাসপাতাল নামে পরিচিত গোবরধন কমিউিনিটি ক্লিনিকটি। যে কোন মূহুতেই এটি তিস্তার কড়াল গ্রাসে বিলীন হতে পারে বলে আশংকা করছেন এলাকাবাসী জানান।
৭ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হামিজার রহমান জানান, সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে তিস্তা নদীতে ১৪টি পরিবারের বাড়িঘর বিলীন হলেও এসব পরিবার মূল্যবান গাছপালা রক্ষা করতে পারেনি। তিনি আরও জানান, এসব পরিবার এখন তিস্তার নদীর ওপারে চাঁদের চরে আশ্রয় নিচ্ছেন।
মহিষখোচা ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী জানান, পানি কমার সাথে সাথে তিস্তা নদীতে তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। নদী ভাঙ্গনের বিষয়ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছেন বলে তিনি দাবী করেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মফিজুল ইসলাম জানান, সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে নদী ভাঙ্গনের স্বীকার পরিবারগুলোর তালিকা তৈরির জন্য বলা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত ওই ইউনিয়নে সরকারীভাবে ২৭ মেঃটন জিআর চাল, ২ লক্ষ টাকা আর ২শ পরিবারের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কৃষ্ঞ কুমার সরকার জানান, তিস্তা নদীর ভাঙ্গন রোধে সকাল থেকে জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক ফেলা হচ্ছে। তবে সলেডি স্পার-২ বাঁধটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে তিনি দাবী করেন।
আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসাদুজ্জামান জানান, সার্বক্ষণিকভাবে নদী ভাঙ্গনের স্বীকার পরিবারগুলোর খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। তিনি আরও জানান, ভাঙ্গন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জিও ব্যাগে বালুর বস্তা ও সিসি ব্লক তিস্তা নদী ফেলা হচ্ছে।
লালমনিরহাটের দোয়ানী পয়েন্টে বৃহস্পতিবার সকালে তিস্তা নদীর পানি কমে বিপদসীমার ২০ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে ২৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তায় পানি কমার সাথে সাথেই শুরু হয়েছে ব্যাপক ভাঙ্গন। অন্যদিকে তিস্তা–ধরলার চরে পানিবন্দি মানুষগুলোর মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ। এদিকে গত ৫ দিন থেকে চরাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি থাকলেও অধিকাংশ চরেই পৌঁছেনি ত্রাণ কিংবা সাহায্য সহযোগিতা, দুভোর্গে পড়েছে ভানবাসী মানুষ। সরকারিভাবে যে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন